আরব উপদ্বীপ

পশ্চিম এশিয়ার উপদ্বীপ

আরব উপদ্বীপ (আরবি: شبه الجزيرة العربية, Shibhu al-jazīra al-ʿarabiyya, অথবা جزيرة العرب, Jazīrat al-ʿarab, আক্ষ.'আরবদের দ্বীপ')[], বা শুধুই আরবিয়া, পশ্চিম এশিয়ার একটি উপদ্বীপ। এটি আফ্রিকার উত্তর-পূর্বে আরবীয় টেকটোনিক প্লেটের উপর অবস্থিত। এর আয়তন ৩২,৩৭,৫০০ কিমি (১.২৫ নিযুত মা), যা ভারতের সমান, এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম উপদ্বীপ।[][][][][]

আরব উপদ্বীপ
স্থানীয় নাম:
شبه الجزيرة العربية (আরবি)
আরব উপদ্বীপের স্যাটেলাইট চিত্র
ভূগোল
অবস্থানপশ্চিম এশিয়া
আয়তন৩২,৩৭,৫০০ বর্গকিলোমিটার (১২,৫০,০০০ বর্গমাইল)
প্রশাসন
জনপরিসংখ্যান
বিশেষণআরব, আরবীয়
জনসংখ্যা৯৫ মিলিয়ন (২০২৩ আনুমানিক)
জনঘনত্ব২৯.০ /বর্গ কিমি (৭৫.১ /বর্গ মাইল)
ভাষাআরবি

ভৌগোলিকভাবে, আরব উপদ্বীপে বাহরাইন,[] কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও ইয়েমেন, পাশাপাশি দক্ষিণ ইরাক এবং জর্ডান অন্তর্ভুক্ত।[] এই অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তম দেশ হলো সৌদি আরব। রোমান যুগে সিনাই উপদ্বীপকেও আরবিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

এই উপদ্বীপ গঠিত হয়েছিল লাল সাগরের রিফটিং (বিচ্ছেদ) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যা আনুমানিক ৫৬ থেকে ২৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে শুরু হয়। এর পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে লাল সাগর, উত্তর-পূর্বে পারস্য উপসাগরওমান উপসাগর, উত্তরে লেভান্তমেসোপটেমিয়া, এবং দক্ষিণ-পূর্বে আরব সাগরভারত মহাসাগর অবস্থিত। বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাসতেল মজুদের কারণে এই উপদ্বীপ আরব বিশ্বে এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্থান হিসেবে বিবেচিত।

আধুনিক যুগের আগে অঞ্চলটি মূলত চারটি স্বতন্ত্র অংশে বিভক্ত ছিল: কেন্দ্রীয় মালভূমি (নাজদ ও আল-ইয়ামামা), দক্ষিণ আরব (যেমন ইয়েমেন, হাদরামাউত ও দক্ষিণ-পশ্চিম ওমান), আল-বাহরাইন (পূর্ব আরব বা আল-আহসা ওয়াসিস), এবং হেজাজ (তিহামা উপকূলীয় অঞ্চলসহ), যেমনটি ইবন আল-ফাকিহ বর্ণনা করেছেন।[]

নামকরণ

সম্পাদনা

প্রাচীনকালে "আরবিয়া" শব্দটি বর্তমান "আরব উপদ্বীপ" শব্দের তুলনায় একটি বৃহত্তর অঞ্চলকে বোঝাত। এতে আরব মরুভূমি এবং সিরীয়–আরব মরুভূমির বিস্তৃত অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। হেলেনীয় যুগে অঞ্চলটি আরবিয়া (প্রাচীন গ্রিকἈραβία) নামে পরিচিত ছিল। রোমানরা "আরবিয়া" নামে তিনটি অঞ্চলকে অভিহিত করেছিল:

পটলেমীয় মিশরের একটি নোমের নাম ছিল আরবিয়া[১০]

আরবরা আরব ভূখণ্ডকে উত্তর-দক্ষিণ ভিত্তিতে ভাগ করত: আশ-শামআল-ইয়ামান, অথবা আরবিয়া দেজার্টাআরবিয়া ফেলিক্সআরবিয়া ফেলিক্স প্রথমে পুরো উপদ্বীপ বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও পরে শুধুমাত্র দক্ষিণাঞ্চলের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। তখন পুরো উপদ্বীপকে আরবিয়া বলা হতো। আরবিয়া দেজার্টা বোঝাত মরুভূমি অঞ্চল, যা আরবিয়া ফেলিক্স থেকে শুরু করে পালমাইরাইউফ্রেটিস পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং এর মধ্যে নাইলের পাশের পেলুসিয়াম থেকে শুরু করে বাবিলনের মধ্যবর্তী অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই অঞ্চলও কখনো কখনো 'আরবিয়া' নামে অভিহিত হতো এবং উপদ্বীপ থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করা হতো না।[১১]

আরবরা এবং অটোমানরা আরব উপদ্বীপের পশ্চিম অংশকে যেখানে আরবরা বাস করত তা বিলাদ আল-আরব (আরবের ভূমি)—আরবিয়া হিসেবে বিবেচনা করত। এই অঞ্চলের প্রধান উপবিভাগগুলো ছিল: বিলাদ আশ-শাম (লেভান্ট), বিলাদ আল-ইয়ামান (ইয়েমেন) এবং বিলাদ আল-ইরাক (ইরাক)।[১২] অটোমানরা আরবিস্তান শব্দটি একটি বিস্তৃত অর্থে ব্যবহার করত, যা সিলিসিয়া থেকে শুরু করে যেখানে ইউফ্রেটিস নদী সিরিয়ায় প্রবেশ করে, ফিলিস্তিন হয়ে সিনাই উপদ্বীপ ও আরব উপদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[১৩]

আরবিয়ার প্রদেশসমূহ ছিল: আল-তিহ, সিনাই উপদ্বীপ, হেজাজ, আসির, ইয়েমেন, হাদরামাউত, মাহরা ও শিলু, ওমান, হাসা, বাহরাইন, দাহনা, নুফুদ, হাম্মাদ—যার মধ্যে সিরিয়া, মেসোপটেমিয়াব্যাবিলনের মরুভূমি অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১৪][১৫]

 
আরব উপদ্বীপের ভৌগোলিক অঞ্চলসমূহের মানচিত্র

আরব উপদ্বীপ এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত এবং এটি ঘড়ির কাঁটার দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে সীমাবদ্ধ: উত্তর-পূর্বে পারস্য উপসাগর, পূর্বে হরমুজ প্রণালীওমান উপসাগর, দক্ষিণ-পূর্বে আরব সাগর, দক্ষিণে আডেন উপসাগরগার্দাফুই প্রণালী, দক্ষিণ-পশ্চিমে বাব-আল-মানদেব প্রণালী, এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিমে লাল সাগর[] উপদ্বীপের উত্তর অংশ সিরীয় মরুভূমির সঙ্গে মিশে গেছে, যেখানে নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই। তবে সাধারণভাবে উপদ্বীপের উত্তর সীমানা হিসেবে সৌদি আরবকুয়েতের উত্তর সীমান্ত এবং ইরাকের দক্ষিণাঞ্চল ও জর্ডানের দক্ষিণ অঞ্চলকে ধরা হয়।[]

এই উপদ্বীপের প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হলো বিস্তৃত মরুভূমি। তবে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পর্বতশ্রেণী রয়েছে, যেখানে উপদ্বীপের অন্যান্য অংশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। হাররাত আশ শাম হলো একটি বিশাল আগ্নেয় শিলা ক্ষেত্র, যা উত্তর-পশ্চিম আরব থেকে শুরু করে জর্ডানদক্ষিণ সিরিয়ার দিকে বিস্তৃত।[১৬]

ইতিহাস

সম্পাদনা

মধ্য প্যালিওলিথিক যুগের পাথরের তৈরি অস্ত্র এবং অন্যান্য প্রাণীর জীবাশ্ম সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তি’স আল ঘাদা নামক স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব আবিষ্কারের ভিত্তিতে গবেষকরা ধারণা করেন, প্রায় ৩,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ বছর আগে হোমিনিনরা একটি "সবুজ আরবিয়া" অঞ্চল অতিক্রম করে অভিবাসন করেছিল।[১৭] আল-কাসিম প্রদেশের পূর্বাংশে শুয়াইব আল-আদঘামে ২,০০,০০০ বছরের পুরোনো পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত করে যে ওই এলাকায় একসময় বহু প্রাগৈতিহাসিক বসতি ছিল, যেগুলো নদী ব্যবস্থার আশপাশে গড়ে উঠেছিল।[১৮]

রিয়াদ অঞ্চলের সাদাকায় পাওয়া আশুলিয়ান পাথরের যন্ত্রপাতি প্রমাণ করে যে প্রায় ১,৮৮,০০০ বছর আগে হোমিনিডরা আরব উপদ্বীপে বসবাস করত।[১৯] আরও গবেষণায় জানা গেছে, আরবে মানব বসতি স্থাপন সম্ভবত ১,৩০,০০০ বছর আগেও শুরু হয়ে থাকতে পারে।[২০]

নেফুদ মরুভূমির আল-উস্তা নামক স্থানে একটি জীবাশ্মকৃত হোমো স্যাপিয়েন্সের আঙুলের হাড় পাওয়া গেছে, যার বয়স আনুমানিক ৯০,০০০ বছর। এটি আফ্রিকা ও লেভান্ত অঞ্চলের বাইরের সবচেয়ে প্রাচীন মানব জীবাশ্ম। এই আবিষ্কার নির্দেশ করে যে এই সময়ে আফ্রিকা থেকে আরবে মানব অভিবাসন ঘটে ছিল।[২১]

গবেষণায় আরও ধারণা করা হয়েছে যে, আরব উপদ্বীপ হতে পারে তথাকথিত ‘বেসাল ইউরেশীয়’ জনগোষ্ঠীর আদি আবাসভূমি, যারা আফ্রিকা থেকে বের হওয়ার কিছু পরেই অন্য ইউরেশীয়দের থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং একসময় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়, প্রায় ২৫,০০০ বছর আগে। এই মধ্যপ্রাচ্যের জনগোষ্ঠীগুলো পরে নবপালীয় বিপ্লবের মাধ্যমে বেসাল ইউরেশীয় বংশধারা পশ্চিম ইউরেশিয়ায় ছড়িয়ে দেয়।[২২]

গ্যালারি

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Nijim, Basheer K.। "Arabia"Encyclopædia Britannica। ২২ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুন ২০১৮ 
  2. Niz, Ellen Sturm (২০০৬-০৪-১০)। Peninsulas । Capstone। পৃষ্ঠা 19আইএসবিএন 9780736861427 
  3. McColl, R. W. (২০১৪-০৫-১৪)। "Peninsula"। Encyclopedia of World Geography। Infobase। আইএসবিএন 9780816072293। ১৯ মে ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মে ২০২০ 
  4. Condra, Jill (২০১৩-০৪-০৯)। Encyclopedia of National Dress: Traditional Clothing Around the World [2 Volumes]। ABC-CLIO। আইএসবিএন 9780313376375। ১৯ মে ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মে ২০২০ 
  5. Dodge, Christine Huda (২০০৩-০৪-০১)। The Everything Understanding Islam Book: A Complete and Easy to Read Guide to Muslim Beliefs, Practices, Traditions, and Culture। Simon and Schuster। আইএসবিএন 9781605505459। ৩১ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মে ২০২০ 
  6. "15 Largest Peninsulas in the World"WorldAtlas। ১৭ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১০-২১ 
  7. Cohen, Saul Bernard (২০০৩)। Geopolitics of the World System। Rowman & Littlefield। পৃষ্ঠা 337। আইএসবিএন 9780847699070। ১ অক্টোবর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  8. Ibn al-Faqih (c. 903)। Mukhtasar Kitab al-Buldan (আরবি ভাষায়)। 20 April 2021 তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 20 April 2021  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  9. "Arabia Petraea"Encyclopædia Britannica। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ 
  10. De Jong, Janneke (২০১৭)। Arabia, Arabs, and "Arabic" in Greek Documents From Egypt in "New Frontiers of Arabic Papyrology Arabic and Multilingual Texts from Early Islam"। Brill। আইএসবিএন 9789004345171 
  11. Frankfurter, David (১৯৯৮)। Pilgrimage and Holy Space in Late Antique Egypt। Leiden: Brill। পৃষ্ঠা 163। আইএসবিএন 90-04-11127-1 
  12. Salibi, Kamal Suleiman (১৯৮৮)। A House of Many Mansions: The History of Lebanon Reconsidered। University of California Press। পৃষ্ঠা 60–61। আইএসবিএন 978-0-520-07196-4। ১৩ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ অক্টোবর ২০১৫ 
  13. See for example Palestine: The Reality, Joseph Mary Nagle Jeffries, Published by Longmans, Green and co., 1939, Page 11
  14. see Review of Reviews and World's Work: An International Magazine, Albert Shaw ed., The Review of Reviews Corporation, 1919, page 408]
  15. "Arabia"। New International Encyclopedia (2nd সংস্করণ)। ১৯১৪। ২৪ জুন ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০২০ 
  16. Weinstein, Y. (১ জানুয়ারি ২০০৭)। "A transition from strombolian to phreatomagmatic activity induced by a lava flow damming water in a valley"। Journal of Volcanology and Geothermal Research159 (1–3): 267–284। ডিওআই:10.1016/j.jvolgeores.2006.06.015বিবকোড:2007JVGR..159..267W 
  17. Roberts, Patrick; Stewart, Mathew; Alagaili, Abdulaziz N. ...।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  18. "Saudi Arabia's Qassim stone axe find points to prehistoric 'crossroads'"Arab News। ২ জানুয়ারি ২০২১। 
  19. Scerri, Eleanor M. L. ...।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  20. Uerpmann, Hans-Peter ...।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  21. "First human migration out of Africa more geographically widespread than previously thought"Eurek Alert। ৯ এপ্রিল ২০১৮। ২ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৮ 
  22. Vallini, Leonardo ...।  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা



উদ্ধৃতি ত্রুটি: "lower-alpha" নামক গ্রুপের জন্য <ref> ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="lower-alpha"/> ট্যাগ পাওয়া যায়নি