আবুল হাসান আলী হাসানী নদভীর দাওয়াতি চিন্তাধারা

আবুল হাসান আলী হাসানী নদভী (১৯১৩ – ১৯৯৯)

আবুল হাসান আলী হাসানী নদভী (১৯১৩ – ১৯৯৯) বিংশ শতাব্দীর ভারতের একজন ইসলামি বুদ্ধিজীবী এবং ইতিহাস, জীবনী, সমসাময়িক ইসলাম, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর অসংখ্য বইয়ের লেখক।[১][২] তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ এবং দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার ছাত্র ছিলেন।[৩] তিনি দীর্ঘকাল দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার রেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে তিনি আরব জাতীয়তাবাদ এবং সর্ব-আরববাদকে একটি নতুন আইয়ামে জাহেলিয়া হিসেবে কঠোরভাবে মোকাবেলা করেছিলেন। তিনি বিশ্ব মুসলিম লীগের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সর্ব-ইসলামবাদের প্রচারক ছিলেন। দাওয়াতি সংগঠন তাবলিগ জামাতের সাথেও তার আজীবন সম্পর্ক ছিল।[১] তিনি অবিসংবাদিতভাবে ইসলামের একজন দাঈ ছিলেন।[৪] তিনি লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেন।[৫][৬] তার দৃষ্টিতে দাওয়াতের তত্ত্বকথা ও মর্মবাণী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মোট ২০টি স্তম্ভের উপর। এ গুলিই তার দাওয়াতের মূল উৎস ও ভিত্তি।[৭][৮][৯][১০]

আবুল হাসান আলী হাসানী নদভী (১৯১৩ – ১৯৯৯)

দাওয়াতি চিন্তাধারা সম্পাদনা

তার দাওয়াতি চিন্তাধারার ২০টি স্তম্ভ:

বস্তুবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গভীর ঈমান সম্পাদনা

তার দাওয়াতের তত্ত্বকথার বিশটি স্তম্ভের প্রথম স্তম্ভ হলো — আল্লাহর প্রতি গভীর ঈমান ও বিশ্বাস রাখা এবং তাওহীদের অকপট স্বীকৃতি প্রদান করা। এই বিশ্বাস লালন করে বস্তুবাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে এবং এর আগা গোড়া সবটাকেই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। কারণ এর দর্শন হলো— এ মহাবিশ্বের কোনো স্রষ্টা নেই, কোনো পরিকল্পক ও নিয়ন্তা নেই। মানুষের আত্মা বা রূহ আল্লাহর সৃষ্টি নয়। পরকাল বলতেও কিছু নেই। স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষ জন্ম নিয়ে মাটির পেটে হারিয়ে যায়। মৌলিক বিশ্বাসগত এ স্তম্ভটির কথা নদভী তার অনেক গ্রন্থেই বিধৃত করেছেন। বিশেষত ঈমান ও বস্তুবাদের সংঘাত, মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো এবং মুসলিম বিশ্বে ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব গ্রন্থত্রয়ীতে।[১১]


শিশু-কিশোরদের প্রতি গুরুত্ব সম্পাদনা

সপ্তদশ স্তম্ভ হলো — শিশু ও কিশোরদের প্রতি গুরুত্ব প্রদান এবং তাদের জন্যে গঠনমুখী সাহিত্য রচনা করা। তারাই আগামী দিনের দিক দিশারী এবং মুসলিম ইতিহাসের নির্মাতা। নদভী ত্রিশ বছর বয়সে এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি কাসাসুন নাবিয়্যিন রচনা করেন। নবী কাহিনীর আড়ালে মুসলিম শিশু মানস গঠনে প্রয়োজনীয় উপাদান এতে সংযোজনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সাইয়েদ কুতুবও এই সিরিজের প্রশংসা করেছেন। সীরাতে খাতামুন নাবিয়্যিন লিখে তিনি এ সিরিজকে পূর্ণতা দেন। শিশু-কিশোরদের জন্যে তার আরেকটি গ্রন্থ হলো- গল্পে আঁকা ইসলামি ইতিহাস। এক জায়গায় নদভী এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, আমি শিশু-কিশোর সাহিত্যে একটি পরিকল্পনা পেশ করলাম মাত্র। আশা করি এ পথ ধরে আগামী দিনে শিশু - কিশোর সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হবে, আরো প্রাণবন্ত হবে। আরো ডালপালা ছড়াবে। আর এই দায়িত্বটা নিতে হবে তাদেরকেই, যারা শিশু-কিশোরদের ঘিরে স্বপ্ন দেখেন সুন্দর একটি আগামীর। একটি আদর্শ প্রজন্মের।[১২]

যুগ সচেতন আলেম ও দাঈ তৈরী সম্পাদনা

অষ্টদশ স্তম্ভ হলো — যুগ সচেতন আলেম ও মুত্তাকী দাঈ তৈরীর জন্যে অবিরাম সাধনা করে যাওয়া। যারা একদিকে শরিয়তের গভীর জ্ঞান ও নিগূঢ় তাৎপর্যে দক্ষতা অর্জন করবেন, অপরদিকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানেও থাকবে সচেতন পদচারণা। পাশাপাশি তারা মুত্তাকী হবে। তার মতে বর্তমানে মুসলমানরা গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও যুগ সচেতন আলেম ও দাঈর সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী। যারা মুসলিমদের যেকোনো কঠিন সমস্যায় শক্ত হাতে হাল ধরতে সক্ষম হবে। যখন ফায়সালা প্রদানের প্রশ্ন আসবে, তখন তারা ফায়সালা প্রদান করবেন ন্যায়সঙ্গতভাবে। ফতওয়া প্রদানের প্রশ্ন আসলে ফতওয়া প্রদান করবেন দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে। স্থান, কাল, পাত্রভেদে মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করবে।[১৩]

ইসলামি জাগরণ ও আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্পাদনা

ঊনবিংশ স্তম্ভ হলো — বিশ্বময় যে ইসলামি জাগরণের শুরু করেছে, তার জন্যে সঠিক দিক নির্ণয় করে দেয়া। এটি বুদ্ধি, হৃদয় ও দৃঢ় সংকল্পের জাগরণ। কিন্তু মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ কারণে এটি বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এর কারণ কতিপয় মুসলিমদের নিরর্থক সীমালংঘন ও বাড়াবাড়ি। জরুরি ও আবশ্যিক বিষয়কে পাশ কাটিয়ে অপ্রয়োজনীয়, প্রান্তিক ও মতবিরোধপূর্ণ বিষয় নিয়ে মাতামাতি। নদভী ছিলেন মধ্যপন্থী। এ মধ্যপন্থা ছিলো তার জীবনের নিবিড় ও অচ্ছেদ্য অংশ। তিনি প্রাচীনপন্থী ছিলেন — কিন্তু প্রয়োজনে নতুনের স্বীকৃতিও দিয়েছেন।[১৪]

অমুসলিমদের প্রতি ইসলামের দাওয়াত সম্পাদনা

সর্বশেষ স্তম্ভ হলো — অমুসলিম সম্প্রদায়কে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেওয়া। তবেই দাঈ হিসেবে পরিগনিত হবে। নদভী ২২ বছর বয়সেই এই কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে মুম্বই সফর করেন। নদভী মনে করতেন, অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায়ের চেয়ে মুসলিমদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে ইসলামের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, না দেওয়ার উপর।[১৫]

তাবলিগ জামাত ও নদভী সম্পাদনা

পয়ামে ইনসানিয়াত ও নদভী সম্পাদনা

নদভী উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ভারতের বিশাল অমুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে দৈহিক এবং রাজনৈতিক শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়াটা মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতি পদক্ষেপ এবং সমস্ত কিছুতে চরম নিরাপত্তাহীনতা ডেকে আনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তিনি ভারতীয় মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে প্রতিবেশী অমুসলিমদের মানবতা ও সহমর্মিতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার এবং নিজেদের নৈতিক চরিত্রের শ্রেষ্ঠতার মাধ্যমে তাদের উপর প্রভাব ফেলার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ১৯৫১ সালে লখনউয়ের আমিনুদ্দৌলা পার্কে এক হিন্দু-মুসলিম জনসভার মাধ্যমে তিনি তার এ মানবতাবাদী দাওয়াতি কার্যক্রমের সূচনা করেন। "খোদা পুরস্তি আওর নফস পুরস্তি" নামে তিনি একটি ভাষণ দেন। এরপর তিনি সারা ভারতে এই পয়গাম নিয়ে সফর করেন। ১৯৫৪ সালে লখনউয়ের গঙ্গা প্রসাদ মেমোরিয়াল হলে পয়ামে ইনসানিয়াতের সভা হয়। আস্তে আস্তে ১৯৭৪-এ এসে পয়ামে ইনসানিয়াত আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। কিন্তু বিশেষ কারণে পয়ামে ইনসানিয়াতকে তিনি সাংগঠনিকরূপ দেননি। এর জন্য কোন কমিটিও ছিল না, কোন ফান্ডও ছিল না। তিনি নিজেই ছিলেন এ আন্দোলনের ভিত্তি।[১৬] এই আন্দোলন আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের উন্নতির জন্য স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর অন্যতম।[১৭]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. এস্পোসিতো, জন এল. (২০০৩)। দ্য অক্সফোর্ড ডিকশনারি অফ ইসলাম (ইংরেজি ভাষায়)। অক্সফোর্ড, ইংল্যান্ড: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। আইএসবিএন 978-0-19-512558-0ডিওআই:10.1093/acref/9780195125580.001.0001/acref-9780195125580-e-1686 
  2. নদভী, আব্দুল হাই হাসানী আলী (২০১৭)। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী রহ. দাওয়াত ও চিন্তাধারা। ফারুকী, শহীদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদিত। বাংলাদেশ: মাকতাবাতুল হেরা। 
  3. মুহাম্মদ সালমান, মাওলানা (২০০২)। আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. জীবন ও কর্ম। মিরপুর, ঢাকা: আল ইরফান পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা ৬৪,৬৬। 
  4. রবিউল হক, মুহাম্মাদ (২ ডিসেম্বর ২০২০)। "মুসলিম উম্মাহর দরদী দাঈ সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী"যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুলাই ২০২১ 
  5. মুহাম্মদ উসমান এল মুহাম্মদ, আসমা (২০১৮)। "Islam and interfaith dialogue: the da'wah approach of Sayyid Abu al-Hasan al-Nadwi" [ইসলাম এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ: সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভীর দাওয়াহ পদ্ধতি]। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইসলামিক টথ (ইংরেজি ভাষায়)। (১): ২৭–৩৯। আইএসএসএন 2306-7012 [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  6. আহমদ, খলিল; আলী, মুহাম্মদ মুমতাজ; সিদ্দিকী, ইউসুফ আজিম (১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০)। "Religious Harmony in India's Post-Independence Phase: A Comparative Study of the Approach of Abul Hasan Ali Nadawi and Wahiduddin Khan" [ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী পর্যায়ে ধর্মীয় সম্প্রীতি: আবুল হাসান আলী নদভী এবং ওয়াহিদউদ্দিন খানের দৃষ্টিভঙ্গির একটি তুলনামূলক অধ্যয়ন]। আল-ইতকান: জার্নাল অব ইসলামিক সাইন্সেস এন্ড কম্পারেটিভ স্টাডিজ (ইংরেজি ভাষায়)। (২): ৩৩–৪৯। আইএসএসএন 2600-8432 
  7. আল-কারযাভী, ইউসূফ (২০০১)। আশ শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী : কামা আরাফাতুহু [আবুল হাসান আলী নদভী : এমন ছিলেন তিনি]। নদভী, ইয়াহইয়া ইউসুফ কর্তৃক অনূদিত। দামেস্ক; ঢাকা: দারুল কলম; মাকতাবাতুল আজহার। পৃষ্ঠা ১০৪, ১১৫। ওসিএলসি 48048069 
  8. চৌগলেই, আব্দুল কাদের (২০০৪)। দাওয়াহ, পিচ এন্ড ডায়লগ ইন দ্যা রাইটিংস অব সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (১৯১৩–১৯৯৯) (গবেষণাপত্র) (ইংরেজি ভাষায়)। স্নাতকোত্তর অভিসন্দর্ভ। রেন্ড আফ্রিকান বিশ্ববিদ্যালয় 
  9. আহমদ সিদ্দিক, খলিল; আলী, মুহাম্মদ মুমতাজ (২০১৯)। "দ্য ডেভলপমেন্ট অব ইসলামিক টথ ইন পোস্ট-ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্ডিয়া এন এপ্রাসল অব দ্য ভিউস অব আবুল হাসান আলী নদভী অন মাল্টিরিলিজিয়াস হারমনি এন্ড মুসলিম আইডেন্টিটি"জার্নাল অব ইসলাম ইন এশিয়া (ইংরেজি ভাষায়)। ১৬ (২): ৩০১–৩২০। আইএসএসএন 1823-0970 
  10. আহমদ, নূর ফারিহা; সুলায়মান, মাশিতা (২০২১)। "The Prominence And Contribution Of Abu Hassan Ali Al-Nadwi On Strengthening The Spread Of Da'wah In Muslim World, 1913-1999"E-Proceedings Of The International Conference On Da’wah And Islamic Management (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 2821-3270 
  11. আল-কারযাভী ২০০১, পৃ. ১১৫, ১১৬।
  12. আল-কারযাভী ২০০১, পৃ. ১৩৬,১৩৭।
  13. আল-কারযাভী ২০০১, পৃ. ১৩৭,১৩৮।
  14. আল-কারযাভী ২০০১, পৃ. ১৩৮,১৩৯।
  15. আল-কারযাভী ২০০১, পৃ. ১৩৯,১৪০।
  16. আল-কারযাভী ২০০১, পৃ. ১৬২–১৬৩।
  17. কাসবেকর, দুর্গেশ (২০১৭)। Religious dialogue as a peace building tool between India and Pakistan : the Ulema as peace builders [ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি নির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে ধর্মীয় সংলাপ: শান্তি নির্মাতা হিসেবে উলামা] (গবেষণাপত্র) (ইংরেজি ভাষায়)। কানাডা: রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি। পৃষ্ঠা ১০১।