আখ্যান (থিয়েটার) ছিল ঐতিহ্যপূর্ণ সাংগীতিক থিয়েটার এবং তার সঙ্গে মধ্যযুগীয় রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গুজরাতিরাজস্থানি কবিতা।[১] ভারতের গুজরাত এবং রাজস্থান রাজ্যে এই ধরনের আখ্যান প্রচলিত ছিল।

ভারতীয় থিয়েটারের একটি দৃশ্য

ব্যুৎপত্তি ও বর্ণনা সম্পাদনা

আখ্যান শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল সংস্কৃত ভাষায় বলা অথবা বর্ণনা করা। ১২ শতকের সর্বজ্ঞ পণ্ডিত হেমচন্দ্র তাঁর কাব্যানুশাসন বইতে আখ্যান সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, আখ্যান হল গ্রন্থিকারের (পেশাদার গল্প কথক) বলা ধর্মীয় কাহিনি থেকে পার্শ্ব গল্প, যা দর্শক-শ্রোতাদের কাছে গান এবং অভিনয় করে পরিবেশন করা হোত। নরসিংহ মেহতা প্রমুখের অ-পৌরাণিক গল্পের কথকদের বিবৃতি এই বর্ণনার সঙ্গে মেলেনা। সাধারণভাবে আখ্যানকে বর্ণনা করা যায় যে, এটা হল ধর্মীয় নির্দেশের জন্যে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে গান এবং অভিনয়সহ গল্প কথকদের প্রদর্শন। দোলারি মানকড় একে অভিনয়ের সুযোগ নিয়ে বাদ্যযন্ত্রসহ কবিতার ধরন হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

আখ্যান সম্পাদনা

যে সমস্ত কথক বা পেশাদার গল্প কথক আখ্যান আবৃত্তি করত তাদের মনভাট অথবা গাগারিয়া-ভাট বলা হোত। তারা সংগীতের সুরে কবিতা মিলিয়ে একক অভিনয় করত। তারা তাদের আঙুলগুলোতে রুপো বা তামার আংটি পরত যা অতিমাত্রায় তামা দ্বারা তৈরি জলের কলসি বা বড়ো গোলাকার ধাতব পাত্রের সংকীর্ণ মুখ এবং স্ফীত মধ্যভাগে সুরগুলি বাজানোর জন্য ব্যবহৃত হত। মন বা গাগরের গুজরাতিতে আক্ষরিক অর্থ হল পাত্র। [২][৩][৪] এছাড়া সাংগীতিক সহযোগে থাকত করতাল (ঝাঁঝ), পিপা ড্রাম (পাখোয়াজ), তবলা এবং হারমোনিয়াম

যারা আখ্যান আবৃত্তি করত তারা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ছিল, এভাবে অন্য সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তির লেখা হলে সেটা তাকে আবৃতির জন্যে দিয়ে দেওয়া হোত। মধ্যযুগের গুজরাতি সাহিত্যে নকর নামে এরকম একজন অ-ব্রাহ্মণের তথ্য পাওয়া যায়, তিনি বেনিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন।[২] তাঁরা প্রধানত দক্ষিণ গুজরাতের অধিবাসী ছিলেন।

আখ্যান বিভিন্ন স্তবকে ভাগ করা হয়েছিল, যাকে বলা হোত কদবুনকদবুন সংস্কৃত শব্দ কদবাক থেকে এসেছে, যার অর্থ হোল ' একত্র করা বিভিন্ন সাংগীতিক তান এবং মাত্রা থেকে নেওয়া'। কদবুন অথবা আবৃত্তির তিনটে অংশ: মুখবন্ধ (ভূমিকা অথবা প্রস্তাবনা), ধল (বিবরণ) এবং বলন (সারাংশ)। মুখবন্ধ হল প্রথম দুপংক্তি যা বক্তব্যের বিষয় এবং ঘটনার পরিচয় দ্যায়। ধল হল ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ। বলন বলা হয় শেষ দুপংক্তিকে, প্রথম কথিত ঘটনার বিবৃত সারাংশ এবং দ্বিতীয় যে ঘটনা বলা হবে। সকল আখ্যানের কথন এই কদবুনের তিন ভাগে বিবৃত করা হয়। অনেক সময় আবেগের বশে আখ্যানের কথন এবং বিবরণের মাঝখানে পদ প্রকার ব্যবহার করা হয়ে থাকে।[২]

আখ্যান যেহেতু ধর্মীয় কবিতার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত, এটা শুরু হয় গণেশ বন্দনা দিয়ে, যিনি সকল বাধা দূর করেন, পরবর্তী প্রদর্শন বিদ্যার দেবী সরস্বতী (দেবী) বন্দনা। এর পর কথকের বর্ণনায় থাকে পুরাণ, মহাকাব্য অথবা উপাসকদের জীবন থেকে নেওয়া ঘটনা। বিবরণের পর কথক পুস্তকের শেষ আবৃত্তি করেন। পুস্তকের শেষে থাকে লেখকের নাম, গ্রন্থণার তারিখ, জায়গা অথবা বাড়ির মতো কিছু জীবনপঞ্জী, তাঁর পূর্বসূরি অথবা পিতার নাম, তাঁর পরিবারের তথ্য। কবিতা শেষ হয় এক কিংবা একাধিক বস্তুগত সুবিধার ফলশ্রুতি দিয়ে। এটা যোগ করা হয় দর্শক-শ্রোতাকে আকর্ষণ করার জন্যে। দর্শক-শ্রোতাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় পাপস্খালনের সুবিধে, মোক্ষ, শারীরিক অসুখের শেষ, শিশু জন্ম, সম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে। গল্পকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে অনেক সময় গল্পের আসল উৎস এবং এমনকি কবিতার পর্বগুলোও ঘোষণা করা হয়। যদিও গল্পগুলো মহাকাব্য এবং পুরাণ কাহিনি থেকে নেওয়া হয়, কখনোবা দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জনের জন্যে গল্পগুলোকে বিভিন্নভাবে পরিবেশন করা হয়। সময়ের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্যে তাদের আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া হয়। সংস্কৃত নাটকের মতো সুখী বার্তা দিয়ে আখ্যান শেষ করা হয়।[২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Datta, Amaresh (১৯৮৭)। Encyclopaedia of Indian Literature। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 28, 29, 121–122। আইএসবিএন 8126018038 
  2. Datta, Amaresh (১৯৮৭)। Encyclopaedia of Indian Literature। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 28, 29, 121–122। আইএসবিএন 8126018038 Datta, Amaresh (1987). Encyclopaedia of Indian Literature. Sahitya Akademi. pp. 28, 29, 121–122. ISBN 8126018038.
  3. Mukherjee, Sujit (১৯৯৯)। A Dictionary of Indian Literature: Beginnings-1850Orient Blackswanআইএসবিএন 8125014535 
  4. "Dharmiklal Pandya struggles to save dying art of Gujarat Manbhat Akhyan"India Today 12012004। ১২ জানুয়ারি ২০০৪। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১৬