আকিলিস
অ্যাকিলিস (প্রাচীন গ্রিক: Ἀχιλλεύς) গ্রিক পুরাণের একটি চরিত্র। হোমারের ট্রয় যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত ইলিয়াড মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যাকিলিস উক্ত যুদ্ধের নায়ক তথা শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। ধারণা করা হয়, ট্রয়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত যোদ্ধৃবর্গের মধ্যে অ্যাকিলিস ছিলেন সর্বাপেক্ষা সুদর্শন। [১]
পরবর্তীকালে রচিত কিংবদন্তি [২] অনুসারে, গোড়ালি ছাড়া অ্যাকিলিসের সমগ্র শরীর ছিল অপরাজেয়। গোড়ালির এই দুর্বলতা সত্ত্বেও এই কিংবদন্তিতে অ্যাকিলিসকে অর্ধ-অবিনশ্বর বলে উল্লেখ করেছে। গোড়ালিতেই বিষাক্ত তির বিঁধে অ্যাকিলিসের মৃত্যু ঘটে। এই কারণে "অ্যাকিলিস হিল" (বা, অ্যাকিলিসের গোড়ালি) শব্দবন্ধটির দ্বারা কোনো ব্যক্তির প্রধান দুর্বলতাকে নির্দেশিত করার রীতি প্রচলিত হয়।
জন্ম
সম্পাদনাঅ্যাকিলিস ছিলেন নিম্ফ থেটিস ও মিরমিডন-রাজ পেলেউসের সন্তান। জিউস ও পসেইডন দুজনেই থেটিসের পাণিপ্রার্থী ছিলেন। এই কারণে উভয়ের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এদিকে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে থেটিস এমন এক সন্তানের জন্ম দেবেন যে তার পিতার তুলনায় অনেক বেশি শক্তিমান হবে। অগ্নি-আনয়নকারী প্রমিথিউস এই ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে জিউসকে সতর্ক করে দিলে উভয় দেবতাই থেটিসকে বিবাহ করার সংকল্প পরিত্যাগ করেন এবং পেলেউসের সঙ্গে তার বিবাহ দেন।[৩]
অধিকাংশ পুরাণকথার মতোই এই ঘটনাসমূহ অপর একটি উপকথায় ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে: অ্যার্গোনটিকা (চার, ৭৬০) গ্রন্থে বলা হয়েছে, হেরা পরোক্ষভাবে থেটিসের কৌমার্যব্রতকে জিউসের কামলোলুপতার সম্মুখে এনেছিলেন; কিন্তু থেটিস হেরার বৈবাহিক বন্ধনটির প্রতি অত্যন্ত আনুগত্যপরায়ণা ছিলেন বলে, তিনি ঠাণ্ডা মাথায় জিউসকে প্রত্যাখ্যান করেন।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে স্ট্যাটিয়াস রচিত অ্যাকিলেইড-এর অ্যাকিলেইস খণ্ডাংশ থেকে জানা যায়, অ্যাকিলিসের জন্ম হলে সদ্যোজাতকে অবিনশ্বর করার মানসে থেটিস তাকে স্টিক্স নদীতে একবার নিমজ্জিত করেন। কিন্তু গোড়ালির যে অংশ ধরে থেটিস অ্যাকিলিসকে জলে ডুবিয়েছিলেন, সেই অংশটি জেয়ই থেকে যায়। (আরও দেখুন: অ্যাকিলিস হিল, অ্যাকিলিস টেন্ডন) তবে অন্য কোনো সূত্র থেকে এই কাহিনির সমর্থন পাওয়া যায়নি। এও পরিষ্কার নয় যে পূর্বে উক্ত ঘটনার ব্যাখ্যানটি পরিচিত ছিল কিনা। অন্য একটি বিবরণী অনুসারে, থেটিস শিশু অ্যাকিলিসের সারা শরীরে অ্যামব্রোজিয়া মাখিয়ে তাকে আগুনের উপর ধরেন, যাতে তার দেহের সমস্ত নশ্বর অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু পেলেউস তাকে বাধা দিলে, ক্রুদ্ধ থেটিস পিতা ও পুত্র উভয়কেই পরিত্যাগ করে চলে যান।[৪]
যদিও স্ট্যাটিয়াসের আগে কেউই অ্যাকিলিসের এই অজেয়ত্বের কাহিনি শোনাননি। অপরপক্ষে, হোমার ইলিয়াড মহাকাব্যে অ্যাকিলিসের আহত হওয়ার যে বর্ণনা নিয়েছেন, তা এইরূপ: একবিংশতি পর্বে পেলাগণের পুত্র পিয়োনিয়ান যোদ্ধা অ্যাসটারোপায়ুস স্ক্যামান্ডার নদীর তীরে অ্যাকিলিসকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। তিনি যুগপৎ দুটি বর্শা নিক্ষেপ করেন, যার একটি অ্যাকিলিসের কনুই ছুঁয়ে যায় ও "ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে"।
এছাড়াও মহাকাব্য চক্রের যেসকল খণ্ডকাব্যে অ্যাকিলিসের মৃত্যুবৃত্তান্ত পাওয়া যায় সেগুলি হল: সাইপ্রিয়া (লেখক অজ্ঞাত), আর্কটিনাস অফ মিলেটাস রচিত আইথিওপিস ও ইলিউ পারসিস এবং লেচে অফ মিটিলেন রচিত লিটল ইলিয়াড। তবে তার সাধারণ অজেয়ত্ব বা তার বিখ্যাত দুর্বলতার (গোড়ালি) উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না; পরবর্তীকালের কলস-চিত্রকলায় অ্যাকিলিসের যে মৃত্যুদৃশ্য অঙ্কিত হয়, সেখানে দেখানো হয় এক (বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাধিক) তির দেহে বিঁধে তার মৃত্যু হচ্ছে।
পেলেউস পেলিয়ন পর্বত-নিবাসী সেন্ট্যুর চিরনের হাতে অ্যাকিলিসের লালনপালনের ভার অর্পণ করেছিলেন।[৫]
ট্রয়যুদ্ধে অ্যাকিলিস
সম্পাদনাইলিয়াড মহাকাব্যের প্রথম পঙক্তিদুটি নিম্নরূপ:
- μῆνιν ἄειδε θεὰ Πηληϊάδεω Ἀχιλῆος
- οὐλομένην, ἣ μυρί' Ἀχαιοῖς ἄλγε' ἔθηκεν,
- গাও, দেবী, পেলিউস-তনয় অ্যাকিলিসের দুর্বার ক্রোধের গাথা
- যে অভিশপ্ত ক্রোধ সহস্রাধিক এচিয়নের দুঃখের নিমিত্ত হয়।
অ্যাকিলিস ছিলেন একমাত্র নশ্বর যিনি দুর্বার ক্রোধ অনুভব করতেন। কখনও কখনও তার ক্রোধ ছিল অস্থিরমতি, কিন্তু অন্যান্য সময় তা সহজে জুড়াতে চাইত না। যুদ্ধের ঘটনাবলির দ্বারা অ্যাকিলিসের মানবীকরণ আখ্যায়িকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু।
টেলিফাস
সম্পাদনাট্রয়যুদ্ধের পথে যাত্রা করে একবার পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই গ্রিকদের থামতে হয় রাজা টেলিফাস শাসিত রাজ্য মাইসিয়ায়। ফলে উভয়পক্ষে যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধে টেলিফাস অ্যাকিলিসের হাতে জখম হন। বহু চেষ্টাতেও তার জখম না সারলে রাজা ওরাকল বা ভবিষ্যদ্বক্তার শরণাপন্ন হন। ভবিষ্যদ্বক্তা বলেন, "যে আঘাত করেছে, সেই আঘাত সারাবে"। ভবিষ্যদ্বক্তার কথা শুনে রাজা টেলিফাস আর্গোয় উপস্থিত হন। সেখানে অ্যাকিলিস এই শর্তে রাজাকে সারিয়ে তোলেন যে তিনি ট্রয়ের পথে তাদের পথপ্রদর্শক হবেন।
টেলিফাস সম্পর্কে ইউরিপিডস রচিত একটি হারানো নাটক সম্পর্কিত কয়েকটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, টেলিফাস ভিখারির ছদ্মবেশে অলিসে উপস্থিত হন এবং অ্যাকিলিসের কাছে প্রার্থনা করেন তার ক্ষত নিরাময় করার জন্য। অ্যাকিলিস চিকিৎসাবিদ্যায় নিজের অজ্ঞতার কথা বলে তাকে সহায়তা করতে অস্বীকার করেন। তখন টেলিফাস অরেস্টেসকে পণবন্দী করেন। তার মুক্তির বিনিময়ে তিনি দাবি করেন নিজের ক্ষত নিরাময়ে অ্যাকিলিসের সাহায্য। ওডিসিয়াস মতপ্রকাশ করেন, যেহেতু বর্শার ফলায় ওই ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল, তাই নিশ্চয়ই বর্শাই তা নিরাময় করতে পারবে। বর্শার কয়েকটি টুকরো ক্ষতস্থানের উপর বুলিয়ে দেওয়া হলে টেলিফাস আরোগ্য লাভ করেন।
ট্রলিয়াস
সম্পাদনামহাকাব্য চক্রের যে গ্রন্থে অ্যাকিলিসের মহাক্রোধ বিবরণীর পূর্বের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, সেটি হল সাইপ্রিয়া। এই গ্রন্থ অনুসারে, অ্যাকিয়ানরা ঘরে ফিরতে চাইলে অ্যাকিলিস তাদের সংযত করেন। পরে তিনি ইনিসের পশুর দলকে আক্রমণ করেন, প্রতিবেশী শহরগুলিতে লুণ্ঠন চালান ও ট্রলিয়াসকে হত্যা করেন।[৬]
ডেয়ার্স ফ্রিজিয়াস-এ বর্ণিত অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ডেস্ট্রাকশন অফ ট্রয়[৭] নামক একটি লাতিন সারাংশের মাধ্যমে অ্যাকিলিসের কাহিনি মধ্যযুগীয় ইউরোপে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই কাহিনি অনুসারে, ট্রলিয়াস ছিলেন এক ট্রোজান রাজপুত্র। তিনি ছিলেন রাজা প্রিয়াম (অন্যমতে, অ্যাপোলো) ও হেক্যুবার সর্বকণিষ্ঠ বৈধ সন্তান। বয়সে তরুণ হলেও ট্রলিয়াস ছিলেন প্রধান যোদ্ধাদের অন্যতম। ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে ট্রয়ের নিয়তির সঙ্গে ট্রলিয়াসের নিয়তি অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে ছিল। তাই অপহরণের একটি প্রচেষ্টার পর থেকে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়। অ্যাকিলিস ট্রলিয়াস ও তার ভগিনী পলিজেনা উভয়ের সৌন্দর্যেই বিমোহিত হয়েছিলেন। কামলালসায় জর্জরিত হয়ে তিনি তরুণ ট্রলিয়াসকেই কামনা করে বসেন। কিন্তু ট্রলিয়াস অ্যাকিলিসের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করলে অ্যাপোলোর মন্দিরে (ওম্ফ্যালোজ) বেদীর উপর তার শিরোশ্চেদ করা হয়। এই কাহিনির পরবর্তীকালীন পাঠান্তরে বর্ণিত হয়েছে, অতিভাবাবেগে আচ্ছন্ন প্রণয়ালিঙ্গণে অ্যাকিলিস ভুলবশত ট্রলিয়াসকে হত্যা করেছিলেন। এই পাঠ অনুসারে, অ্যাকিলিসের মৃত্যু উক্ত অপবিত্রকরণের শাস্তিস্বরূপ নেমে এসেছিল।[৮] প্রাচীন লেখকদের রচনায় ট্রলিয়াস ছিলেন সেই মৃত শিশুসন্তানদের উপমা, যাদের মৃত্যুতে তাদের পিতামাতারা শোকাচ্ছন্ন হতেন। প্রথম ভ্যাটিকান পুরাণবিদের মতে যদি ট্রলিয়াস বয়ঃপ্রাপ্তি অবধি বেঁচে থাকতেন, তবে ট্রয় অপরাজেয় হত।
ইলিয়াড মহাকাব্যে
সম্পাদনাহোমারের ইলিয়াড ট্রয়যুদ্ধে অ্যাকিলিস কী করেছিলেন তার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় উপাখ্যান। এই হোমারীয় মহাকাব্যে ট্রয়যুদ্ধের মাত্র কয়েক সপ্তাহের বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে; এখানে অ্যাকিলিসের মৃত্যুর বর্ণনাও দেওয়া হয়নি। অ্যাকিয়ান বাহিনীর প্রধান সেনাপতি অ্যাগামেনন কর্তৃক অপমানিত হয়ে অ্যাকিলিসের যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কাহিনির মাধ্যমে এর সূত্রপাত। অ্যাগামেনন ক্রিসেইস নামের একটি মেয়েকে ক্রীতদাসী করে রেখেছিলেন। মেয়েটির বাবা ক্রিসেস ছিলেন অ্যাপোলোর পুরোহিত। তিনি অ্যাগামেননের কাছে নিজ কন্যাকে ভিক্ষা চাইলে, অ্যাগামেনন তাকে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন। এতে অ্যাপোলো ক্রুদ্ধ হয়ে গ্রিকদের মধ্যে মহামারী প্রেরণ করেন। ভবিষ্যদ্বক্তা ক্যালকাস এই দুর্বিপাকের কারণ সঠিকভাবে অণুধাবন করেন। কিন্তু যতক্ষণ না অ্যাকিলিস তাকে নিরাপত্তা দেন, ততক্ষণ তিনি মুখ খোলেন না। অ্যাকিলিসের কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়ে ক্যালকাস ঘোষণা করেন যে ক্রিসেইসকে তার পিতার কাছে ফেরত পাঠাতে হবে। অ্যাগামেনন রাজি হন। কিন্তু বদলে আদেশ করেন, অ্যাকিলিসের যুদ্ধোপহার ব্রিসেইসকে ক্রিসেইসের বদলে তার কাছে পাঠাতে হবে। এতে অসম্মানিত হয়ে (কারণ, পরে অ্যাকিলিস জানিয়েছিলেন যে তিনি ব্রিসেইসকে ভালবাসেন) [৯] এবং থেটিসের প্ররোচনায় অ্যাকিলিস যুদ্ধ করতে বা তার সেনাদের অন্যান্য গ্রিক সেনাদের সঙ্গে পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন।
যুদ্ধ গ্রিকদের বিপক্ষে চলে গেলে, নেস্টর ঘোষণা করেন যে ট্রোজানরা যুদ্ধে জয়লাভ করতে চলেছে। কারণ অ্যাগামেনন অ্যাকিলিসকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছেন। তিনি বলেন যে অ্যাগামেননের উচিত অ্যাকিলিসকে শান্ত করে ফিরিয়ে আনা। অ্যাগামেনন রাজি হন। তিনি ওডিসিয়াস ও অন্য দুই গ্রিক প্রধানকে ব্রিসেইস ও অন্যান্য উপহার অ্যাকিলিসের কাছে পাঠান। কিন্তু অ্যাকিলিস প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান গ্রিকদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করা উচিত, যেমনটি তিনি করার পরিকল্পনা করছেন।
যদিও এরপরই যুদ্ধক্ষেত্রে অণুপস্থিত থাকার জন্য হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের আশায় অ্যাকিলিস তার জননী থেটিসের কাছে প্রার্থনা জানান যে তিনি যেন জিউসের কাছে আবেদন করে ট্রোজানদের দ্বারা গ্রিকদের হঠিয়ে দেন।
হেক্টরের নেতৃত্বে ট্রোজানরা সত্যসত্যই গ্রিক বাহিনীকে হঠিয়ে সৈকত পর্যন্ত নিয়ে আসে। সেখানে তারা গ্রিক জাহাজগুলি লুণ্ঠন করেন। ধ্বংসের মুখোমুখি গ্রিক বাহিনীকে রক্ষার জন্য মিরমিডন বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে আসেন প্যাট্রোক্ল্যাশ। অ্যাকিলিস কিন্তু তাঁবুতেই রয়ে যান। প্যাট্রোক্ল্যাশ ট্রোজানদের সৈকত থেকে হঠিয়ে দিতে সমর্থ হন। কিন্তু ট্রয় নগরীকে যথার্থভাবে জয় করার আগেই হেক্টরের হাতে তিনি নিগত হন।
হেক্টর বধ
সম্পাদনাঅ্যাকিলিস নেস্টরের পুত্র অ্যান্টিলোকাসের নিকট হতে প্যাট্রোক্ল্যাসের মৃত্যুসংবাদ পেলেন। ঘণিষ্ঠ সহচরের মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়লেন তিনি। তার সম্মানে আয়োজন করলেন একাধিক অন্ত্যেষ্টি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার। মা থেটিস শোকার্ত অ্যাকিলিসকে সান্ত্বনা দিতে এলেন। তিনি হেফাস্টাসকে বলে একটি বর্ম নির্মাণ করালেন। কারণ অ্যাকিলিসের যে বর্মটি পরে প্যাট্রোক্ল্যাস যুদ্ধে গিয়েছিলেন, সেটি হেক্টর নিয়ে যান। এই নতুন বর্মের অংশ ছিল অ্যাকিলিসের ঢাল, যেটির সুন্দর ও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন কবি।
প্যাট্রোক্ল্যাসের মৃত্যুতে ক্রোধান্বিত অ্যাকিলিস মন পরিবর্তন করেন এবং যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্রোধের বশে তিনি অনেককে হত্যা করেন এবং হেক্টরকে খুঁজতে থাকেন। এমনকি অ্যাকিলিস নদীদেবতা স্ক্যামান্ডারের সঙ্গেও যুদ্ধে লিপ্ত হন। স্ক্যামান্ডার ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কারণ অ্যাকিলিস নরহত্যা করে মৃতদেহ দিয়ে নদীপথ রুদ্ধ করে দিচ্ছিলেন। স্ক্যামান্ডার অ্যাকিলিসকে ডুবিয়ে দিতে গেলে হেরা ও হেফাস্টাস তাকে বাধা দেন। জিউস স্বয়ং অ্যাকিলিসের ক্রোধে বিচলিত হয়ে ওঠেন এবং দেবতাদের পাঠিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন, যাতে তিনি ট্রয় নগরীকে আক্রমণ না করে বসেন। কারণ, ট্রয় ধ্বংসের উপযুক্ত সময় তখনও আসেনি। অবশেষে অ্যাকিলিস তার শিকারের সন্ধান পান। অ্যাথেনা তিন বার হেক্টরের প্রিয় ভাই ডেইফোবাসের ছদ্মবেশে হেক্টরকে অ্যাকিলিসের সঙ্গে সম্মুখসমরে যেতে নিষেধ করেন। অ্যাকিলিস ট্রয়ের প্রাচীরের চারিধারে তিন বার হেক্টরকে ধাওয়া করেন। অবশেষে অ্যাকিলিসের রণকৌশলটি ধরতে পেরে হেক্টর বুঝে যান যে মৃত্যু অনিবার্য। তিনি নিজের নিয়তিকে মেনে নেন। সম্মুখ সমরে এসে কেবল একটি তরবারি নিয়ে অ্যাকিলিসকে আক্রমণ করেন তিনি। অ্যাকিলিস হেক্টরের ঘাড়ে একটিমাত্র আঘাত করে তাকে বধ করেন এবং নিজের প্রতিশোধ তোলেন। তারপর হেক্টরের দেহ নিজের রথের সঙ্গে বেঁধে নয় দিন ধরে যুদ্ধক্ষেত্রময় তা হেঁচড়ে নিয়ে বেড়ান।
দেবতা হার্মিসের সহযোগিতায় হেক্টরের পিতা প্রিয়াম অ্যাকিলিসের তাঁবুতে গিয়ে অ্যাকিলিসকে অণুরোধ করেন হেক্টরের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে দিতে। ইলিয়াড-এর সর্বশেষ স্তবকে বর্ণিত হয়েছে হেক্টরের শেষকৃত্যের বর্ণনা। যার পর ট্রয়ের পতন ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র।
পেন্থেসিলিয়া
সম্পাদনাপ্রিয়ামের সঙ্গে সাময়িক যুদ্ধবিরতির পর অ্যাকিলিস আমাজনীয় যুদ্ধনায়িকা পেন্থেসিলিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। প্রথমে পেন্থেসিলিয়ার রূপে মুগ্ধ অ্যাকিলিস তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাননি। পরে তিনি বুঝতে পারেন পেন্থেসিলিয়ার রণকৌশল তার অপেক্ষাও উন্নত এবং তার প্রতি আকর্ষণ অ্যাকিলিসের কাছে মারাত্মক হতে পারে। এই কারণে তিনি যুদ্ধ করেন ও পেন্থেসিলিয়াকে হত্যা করেন। কিন্তু এমন সুন্দরী নারীকে হত্যা করে তিনি শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন এবং বিলাপ করতে থাকেন। এতে থেরসিটাস নামে এক কুখ্যাত গ্রিক উপহাসকারী হেসে তাকে উপহাস করলে তার মুখে এক ঘুষি মেরে অ্যাকিলিস থেরসিটাসকে হত্যা করেন।
মেমন, এবং অ্যাকিলিসের পতন
সম্পাদনাপ্যাট্রোক্ল্যাসের মৃত্যুর পর, অ্যাকিলিসের নিকটতম সহচর হন নেস্টরের পুত্র অ্যান্টিলোকাস। ইথিওপিয়ার রাজা মেমন অ্যান্টিলোকাসকে বধ করলে আর একবার ক্রোধের বশে প্রতিশোধকল্পে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন অ্যাকিলিস। অ্যান্টিলোকাসকে নিয়ে অ্যাকিলিস-মেমন যুদ্ধ ছিল প্যাট্রোক্ল্যাসকে নিয়ে অ্যাকিলিস-হেক্টর যুদ্ধেরই অণুরূপ। কেবল হেক্টর মেমনের মতো দেবীপুত্র ছিলেন না।
অনেক হোমার-বিশেষজ্ঞের মতে, এই পর্বটি ইলিয়াড মহাকাব্যে প্যাট্রোক্ল্যাসের মৃত্যু ও তারপর অ্যাকিলিসের প্রতিক্রিয়ায় অনেক বিস্তারিত বর্ণনাকে অণুপ্রাণিত করে। এই পর্বটিই পরে মহাকাব্য চক্রের ইথিওপিস গ্রন্থের ভিত্তি রচনা করে, যা ইলিয়াড-এর পর সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে রচিত হয়। বর্তমানে এই গ্রন্থটি হারিয়ে গেছে। কেবলমাত্র পরবর্তীকালের লেখকদের রচনা থেকে উদ্ধার করা এই গ্রন্থের বিভিন্ন উল্লেখ থেকে এর কথা জানা যায়।
মৃত্যুকালে হেক্টর যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেন, সেই অনুযায়ী প্যারিসের তীরের আঘাতে (স্ট্যাটিয়াসের মতে গোড়ালিতে) অ্যাকিলিসের মৃত্যু হয়। কাহিনির কোনো কোনো পাঠ অনুসারে অ্যাপোলো এই তিরটিকে পরিচালনা করেছিলেন। এই দুই পাঠেই লক্ষ্যনীয়ভাবে হত্যাকারীকে বীরের সম্মান দিতে অস্বীকার করেছে। সাধারণভাবেও মনে করা হয়, প্যারিস ছিলেন ভিতু এবং অ্যাকিলিস যুদ্ধভূমিতে অপরাজেয়ই থেকে যান। তার দেহাবশেষ প্যাট্রোক্ল্যাসের দেহাবশেষের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। আয়োজিত হয় অন্ত্যেষ্টি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। হারিয়ে যাওয়া ট্রয়যুদ্ধকেন্দ্রিক মহাকাব্য আর্কটিনাস অফ মিলেটাস-এর মতে, মৃত্যুর পর অ্যাকিলিস ড্যানিউব নদীর মোহনায় লিউক দ্বীপে বাস করতে থাকেন (নিচে দেখুন)। অ্যাকিলিসের মৃত্যুসম্বন্ধিত অন্য একটি কাহিনি অনুসারে, তিনি ট্রয়ের রাজকুমারী পলিজেনার প্রেমে মজেন। অ্যাকিলিস প্রিয়ামের কাছে পলিজেনার পাণিগ্রহণের অণুমতিও চান। প্রিয়াম রাজি হয়ে যান। কারণ তাঁক কাছে এই বিবাহের অর্থ ছিল যুদ্ধের অন্ত ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বীরের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন। তিনি গোপনে অ্যাকিলিস ও পলিজেনার বিবাহের আয়োজন করেন। এদিকে অ্যাকিলিস প্যারিসের ভগিনীকে বিবাহ করলে তাকেও হেলেনের উপর থেকে দাবি প্রত্যাহার করতে হবে, এজন্য প্যারিস ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে দিব্য তিরের সাহায্যে অ্যাকিলিসকে হত্যা করেন।
পরে ফিলোকটেটস হেরাক্লেসের বিশাল ধনুকের সাহায্যে প্যারিসকে হত্যা করেছিলেন।
অ্যাকিলিসের বর্ম
সম্পাদনাঅ্যাকিলিসের মৃত্যুর পর তার বর্মটিকে নিয়ে ওডেসিয়াস ও তেলামোনিয়ান অ্যাজাক্সের (অ্যাজাক্স দ্য গ্রেটার) মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয়। বর্মটির উত্তরাধিকার পাওয়ার লক্ষ্যে উভয়ে বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাদের বাগযুদ্ধের বিষয় ছিল অ্যাকিলিসের পর কে শ্রেষ্ঠতর বীর এবং তাদের এই বাগযুদ্ধের বিচারক ছিলেন ট্রোজান যুদ্ধবন্দীগণ। দুই যোদ্ধার তুলনামূলক আলোচনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ওডেসিয়াসই অ্যাকিলিসের পর শ্রেষ্ঠতর বীর। ওডেসিয়াস জয়লাভ করেন। ক্রোধান্বিত হয়ে অ্যাজাক্স ওডেসিয়াসকে অভিশাপ দিয়ে বসেন। এতে দেবী এথেনা মর্মাহত হন। তিনি সাময়িকভাবে শোক ও ক্রোধের দ্বারা অ্যাজাক্সকে উন্মত্ত করে তোলেন। অ্যাজাক্স মেষগুলিকে তার সঙ্গী মনে করে তাদের হত্যা করতে থাকেন। খানিক বাদে এথেনা অ্যাজাক্সের উপর থেকে এই উন্মত্ততা প্রত্যাহার করে নিলে, অ্যাজাক্স দেখেন যে তিনি আসলে মেষ হত্যা করছিলেন। বিব্রত হয়ে তিনি আত্মঘাতী হন। পরে ওডেসিয়াস বর্মটি অ্যাকিলিসের পুত্র নিওপ্টোলেমাসকে দান করেন।
প্যাম্পিলিয়ান উপসাগরের তীরে অবস্থিত লাইসিয়ার বন্দর ও দুর্গশহর (অ্যাক্রোপলিস) ফাসিলিসের এথেনার মন্দিরে রক্ষিত একটি প্রত্নবস্তুকে অ্যাকিলিসের ব্রোঞ্জের সম্মুখভাগবিশিষ্ট বর্শা বলে দাবি করা হয়। ৩৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার এই শহরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। আলেকজান্ডার নিজেকে নব্য অ্যাকিলিস রূপে দেখতেন এবং নিজের সঙ্গে একটি ইলিয়াড বহন করতেন। তথাপি তার সভাজীবনীকারদের রচনায় এই বর্শাটির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে আলেকজান্ডার পরম উত্তেজনার সঙ্গে এই বর্শাটি স্পর্শ করেছিলেন।[১০] অবশ্য খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে পসেনিয়াসের সময়কালে এই বর্শাটি প্রদর্শিত হত।[১১]
অ্যাকিলিস ও প্যাট্রোক্ল্যাশ
সম্পাদনাঅ্যাকিলিস-সংক্রান্ত পুরাণকথার একটি অত্যন্ত আলোচিত বিষয় হল প্যাট্রোক্ল্যাশের সঙ্গে অ্যাকিলিসের সম্পর্ক। ধ্রুপদি যুগ থেকে আধুনিক কাল অবধি এই সম্পর্কের যথার্থ প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। ইলিয়াড মহাকাব্যে তাদের সম্পর্ককে এক গভীর ও বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের সম্পর্কের আদর্শ রূপে দর্শানো হয়েছে। যদিও ধ্রুপদি যুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত টীকাকারেরা নিজ নিজ সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর এথেন্সে এই সম্পর্ককে পেডেরাস্টিক সম্পর্ক বলে ব্যাখ্যা করা হত। বর্তমান যুগের পাঠকেরা সাধারণত এই দুই যোদ্ধাকে যৌনসম্পর্কহীন "সমরবান্ধব" অথবা সমতাবাদী (ইগালেটারিয়ান) সমকামী যুগল হিসেবেই ব্যাখ্যা করে থাকেন।
প্রাচীন যুগের অ্যাকিলিস সংস্কৃতি
সম্পাদনাপ্রাচীনকালে বর্তমান রোমানিয়া ও ইউক্রেনের উপকূলভাগের অদূরে কৃষ্ণসাগরের হোয়াইট আইল্যান্ড লিউস-এ অ্যাকিলিসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিল এক বীরপূজার সংস্কৃতি। এখানকার অ্যাকিলিস মন্দির ও ওর্যাকল রোমান যুগ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।[১২]
এইথিওপিস মহাকাব্যটি ইলিয়াড মহাকাব্যের প্রলম্বিত অংশ রূপে কথিত। মাইলটোসের আর্কটিনাসকে এই মহাকাব্যের রচয়িতা বলে মনে করা হয়। এই মহাকাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী, অ্যাকিলিসের মৃত্যুর পর তার মা থেটিস এসে বিলাপ করতে থাকেন। তিনি অ্যাকিলিসের চিতা থেকে তার চিতাভস্ম অপসারিত করে নিয়ে আসেন ড্যানিয়ুব নদীর মোহনায় অবস্থিত লিউসে। এখানে একিয়ানগণ একটি সমাধিঢিবি (টিউমুলাস) নির্মাণ করেন এবং আয়োজন করেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রতিযোগিতার।
প্লিনির ন্যাচারাল হিস্ট্রি[১৩] গ্রন্থে একটি সমাধিঢিপির উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থ অনুসারে, ড্যানিয়ুব বদ্বীপ অঞ্চলে পেউস থেকে পঞ্চাশ রোমান মাইল দূরে অ্যাকিলিসের প্রতি উৎসর্গীকৃত একটি দ্বীপ ছিল; এই দ্বীপে অ্যাকিলিসের একটি মন্দিরও ছিল (Insula Akchillis tumulo eius viri clara)। তবে আজ আর এই সমাধিঢিপিটির কোনো অস্তিত্ব নেই। পসেনিয়াসের লিখেছেন যে এই দ্বীপটি "অরণ্য এবং বন্য ও পালিত পশুতে আকীর্ণ ছিল। এই দ্বীপে অ্যাকিলিসের একটি মন্দির ও একটি মূর্তিও ছিল"।[১৪] ১৮২৩ সালে ক্যাপ্টেন ক্রিটজিকলি ৩০ মিটার বাহুবিশিষ্ট একটি বর্গাকার মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। সম্ভবত এটিই ছিল অ্যাকিলিসের সেই মন্দির। তবে এই অঞ্চলে কোনো আধুনিক পুরাতাত্ত্বিক খননকার্য চালানো হয়নি।
পম্পোনিয়াস মেলা লিখেছেন, বরিসথেন ও ইস্টারের মধ্যবর্তী অ্যাকিলিয়া নামে এক দ্বীপে অ্যাকিলিসকে সমাহিত করা হয়েছিল[১৫]। ডমিটিয়ানের সমসাময়িক গ্রিক ভূগোলবিদ বিথিনিয়ার ডায়োনিসাস পেরিগেটাস এই দ্বীপটিকে লিউস নামে উল্লেখ করেছেন, "কারণ এই দ্বীপের অধিবাসী জীবজন্তুদের গাত্রবর্ণ ছিল সাদা। কথিত আছে, লিউস দ্বীপে অ্যাকিলিস ও অন্যান্য যোদ্ধৃবর্গের আত্মা বাস করেন। তাঁরা দ্বীপের নির্জন উপত্যকাগুলিতে ঘুরে বেড়ান। এইভাবেই জোভ সেই সব ব্যক্তিদের সম্মানিত করেন যাঁরা নিজ গুণে তাঁদের স্থান সাধারণের থেকে পৃথক করে নেন। কারণ এই গুণাবলির মাধ্যমেই তাঁরা লাভ করেন চিরকালীন সম্মাননা।"[১৬]
পেরিপ্লাস অফ দি ইউজিন সি গ্রন্থে নিম্নলিখিত বর্ণনাটির উল্লেখ আছে: “কথিত আছে, দেবী থেটিস তাঁর পুত্র অ্যাকিলিসের জন্য এই দ্বীপটি সমুদ্রগর্ভ থেকে উত্থিত করেন। অ্যাকিলিস এখানেই বাস করতেন। এখানে অবস্থিত তাঁর মন্দির ও মূর্তি একটি পুরাকীর্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। এই দ্বীপে মনুষ্যবসতি নেই। কেবলমাত্র যাঁরা অ্যাকিলিসের উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করতে জাহাজে এই দ্বীপে আসেন, তাঁদের ছাগল এখানে চরে বেড়ায়। যদিও তাদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। এই মন্দিরে অনেক মূল্যবান পবিত্র উপহার, পাত্র, অঙ্গুরীয় ও দামি পাথর রক্ষিত আছে। এগুলি অ্যাকিলিসের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত হয়েছিল। গ্রিক ও লাতিনের রচিত মন্দিরের অভিলেখটি আজও লোকে পড়তে পারেন। এই অভিলেখে অ্যাকিলিসের বন্দনা করা হয়েছে। কয়েকটি আবার লিখিত হয়েছে প্যাট্রোক্ল্যাশের সম্মানে। কারণ লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, প্যাট্রোক্ল্যাশকে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে অ্যাকিলিসের অণুগ্রহ পাওয়া যায়। এছাড়াও এই দ্বীপে অসংখ্য পাখি রয়েছে যারা মন্দিরের দেখাশোনা করে। প্রতিদিন তারা উড়ে গিয়ে সমুদ্রের জলে ডানা ভেজায়। তারপর মন্দিরের উপর উড়ে এসে সেই ভিজে ডানা ঝাপটায়। এইভাবে জল ঝাপটিয়ে তারা মন্দিরের যজ্ঞবেদী পরিষ্কার করে দেয়। লোকে আরও বলে যে কেউ কেউ এই দ্বীপে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন। তাঁরা জাহাজে করে বলি উৎসর্গের পশু সঙ্গে আনেন। কোনো কোনো পশুকে তারা বধ করেন, আবার কোনো কোনো পশুকে অ্যাকিলিসের সম্মানে দ্বীপে চরার জন্য ছেড়ে দেন। কিন্তু কেউ কেউ ঝড়ের কবলে পড়ে এই দ্বীপে এসে উঠতে বাধ্য হন। তাঁদের কাছে বলির পশু থাকে না। তাঁরা দ্বীপের দেবতার কাছ থেকে বলির পশু পাওয়ার জন্য এখানকার ওর্যাকলের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁরা অর্থের বিনিময়ে এখানকার স্বাধীনভাবে বিচরণকারী পশুগুলির একটিকে বলি দেওয়ার অণুমতি চান। কিন্তু ওর্যাকল যদি মনে করতেন যে পশুর দাম যথেষ্ট হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে এই অণুমতি পাওয়া যায় না। তখন যতক্ষণ না অণুমতি পাওয়া যায় ততক্ষণ পশুর দাম বাড়ানো হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত যখন ওর্যাকল মনে করেন যে যথেষ্ট দাম পাওয়া গেছে, তখন শিকার পশুটি আর পালিয়ে যায় না। সে ধরা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এই ভাবে বলির পশুর দাম হিসেবে মন্দিরে প্রচুর রূপা সঞ্চিত হয়। কথিত আছে, যাঁরা এই দ্বীপে আসতে চান তাঁদের স্বপ্নে দেখা দেন অ্যাকিলিস। কেউ কেউ আবার নৌচালনার সময় অ্যাকিলিসের দিব্যদর্শন পান। অ্যাকিলিস তাঁদের নোঙর ফেলার উপযুক্ত স্থানের সন্ধান দেন।”[১৭]
লিউস দ্বীপের অ্যাকিলিস বীরপূজার রীতি কেবলমাত্র কৃষ্ণসাগর অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং যেসকল শহরের সঙ্গে কৃষ্ণসাগর-সংলগ্ন অঞ্চলের নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল সেখানেও ছড়িয়ে পড়ে।
লিউস দ্বীপের অ্যাকিলিসকে পোন্টার্কেস বা কৃষ্ণসাগরের প্রভু তথা নাবিক ও জাহাজের রক্ষাকর্তা মনে করা হয়। এই পথে যাতায়াতকারী নাবিকেরা অ্যাকিলিসের উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করেন। গ্রিক জলভাগ অঞ্চলে অ্যাকিলিসের নামে একাধিক শহরও উৎসর্গিত হয়েছে: এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মেসেনিয়ার অ্যাকিলেনিয়ন[১৮] ও ল্যাকোনিয়ার অ্যাকিলিওস[১৯]। নিকোলে ডেনসুসিয়ানু[২০] আরও মনে করেন, ড্যানিয়ুব বদ্বীপের উত্তর ভাগে চিলিয়া ("অ্যাকিলি") শাখায় অবস্থিত অ্যাকুইলিয়ার নামটিও অ্যাকিলিসের নাম থেকে উৎসারিত। এ থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে প্রাচীন সামুদ্রিক আইন অনুযায়ী, পোন্টোস বা কৃষ্ণসাগরের উপর সার্বভৌম ক্ষমতা ছিল লিউসের।
চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবেও লিউসের খ্যাতি ছিল। পসেনিয়াস[২১] লিখেছেন, ডেলফিক পাইথিয়া ক্রোটোনের এক ভূস্বামীকে বুকের ক্ষত সারাবার জন্য এখানে প্রেরণ করেন। অ্যামিয়ানাস মার্সেলিনাস[২২] এই দ্বীপের জলের ঔষধি ক্ষমতার কথা লিখেছেন।
আধুনিক যুগের অ্যাকিলিস সংস্কৃতি : কর্ফুর দ্য অ্যাকিলিয়ন
সম্পাদনাগ্রিসের করফু শহরের দক্ষিণে অবস্থিত গ্যাসটৌরি (Γαστούρι) অঞ্চলে অস্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞী এলিসাবেথ অফ ব্যাভেরিয়া (অপর নাম সিসি) ১৮৯০ সালে একটি গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ নির্মাণ করে। এই প্রাসাদের সাজসজ্জার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল অ্যাকিলিসের উপাখ্যান। এই প্রাসাদটিকে প্লেটোনিক রোম্যান্টিসিজমের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন বলে মনে করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রাসাদটি অ্যাকিলিসের নামাঙ্কিত: অ্যাকিলিয়ন (Αχίλλειον)। এই নয়নাভিরাম সুবৃহদ প্রাসাদটির কেন্দ্রীয় হল তথা উদ্যান উভয়ই অ্যাকিলিসের চিত্র, মূর্তি ও ট্রয়যুদ্ধের নানা মুহূর্তের চিত্র দ্বারা সুসজ্জিত।
অ্যাকিলিসের নামসমূহ
সম্পাদনাঅ্যাকিলিসের নাম দুটি শব্দ -ἄχος (অ্যাকস) "দুঃখ" এবং λαός (লাওস)"জনগণ,গোষ্ঠী,জাতি" এর মিলন হিসাবে বিশ্লেষণ করা যায়। অ্যাকিলিস মানুষের দুঃখের প্রতীক। "দুঃখ" অনেকবার 'ইলিয়াড' এর গল্পে একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অ্যাকিলিসের চরিত্রে দুঃখের বীর এবং গৌরবের বীর এর অপূর্ব সম্মিলন হয়েছে।
এবং লাওস বলতে বোঝায় সৈন্যের দল অথবা মনিব । কবিতাটিতে নামটির দ্বৈত অর্থ পাওয়া যায় >> যখন সে সঠিক কাজ করতে থাকে, তখন তার লোকেরা শত্রুদের কাছে দুর্দশা এনে দেয় । আর যখন সে ভুল কাজ করতে থাকে , তখন তার লোকেরা দুর্দশা ভোগ করতে থাকে। কবিতাটিতে নেতৃত্বের রাগের কারণে ভুল ঘটনাপ্রবাহের প্রতি আলোকপাত করা হয়।
পুরাণপাঠ (অডিও)
সম্পাদনাগল্পকথক দ্বারা কথিত অ্যাকিলিসের উপাখ্যান |
---|
পুনর্সৃজনের গ্রন্থপঞ্জি: হোমার ইলিয়াড, ৯.৩০৮, ১৬.২, ১১.৭৮০, ২৩.৫৪ (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দ); পিন্ডার অলিম্পিয়ান ওডস, নয় (খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৬ অব্দ); অ্যাসেচিলাস মিরমিডনস, এফ ১৩৫-৩৬ (খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৫ অব্দ); ইউরিপিডিস ইফিজেনিয়া ইন অলিস, (খ্রিস্টপূর্ব ৪০৫ অব্দ); প্লেটো সিম্পোসিয়াম, ১৭৯ ই (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৮ -৩৬৭ অব্); স্ট্যাটিয়াস অ্যাকিলেইড, ১৬১, ১৭৪, ১৮২ (৯৬ খ্রিষ্টাব্দ) |
উত্তরকালীন শিল্পে অ্যাকিলিস
সম্পাদনানাটক
সম্পাদনা- উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত ট্রলিয়াস অ্যান্ড ক্রেসিডা নাটকে অ্যাকিলিসকে এক প্রাক্তন যোদ্ধারূপে চিত্রিত করা হয়েছে। নাটকে দর্শিত হয়েছে অ্যাকিলিস অলস এবং প্যাট্রোক্ল্যাশের প্রেমে নিবেদিতপ্রাণ।
- ট্রয়যুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে জন ইংলিশ ও ডেভিড ম্যাককি কর্তৃক রচিত প্যারিস নামক সঙ্গীতালেখ্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র হলেন অ্যাকিলিস। অস্ট্রেলিয়ায় ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে এই নাটকটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়।
টেলিভিশন
সম্পাদনা- ক্লাস অফ দ্য টাইটানস অ্যানিমেটেড টেলিভিশন সিরিজে আর্চি নামক চরিত্রটি অ্যাকিলিসের অণুসরণে সৃষ্ট; অ্যাকিলিসের গোড়ালির দুর্বলতা ও তার অর্ধ-অপরাজেয়ত্ব দুইই এই চরিত্রের মধ্যে দেখা যায়।
উক্তি
সম্পাদনাIf Achilles was anything, he was a man who believed his own press releases.
—রজার এবার্ট,[২৩] ধ্রুপদী বর্ণনায় অ্যাকিলিসের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন।
পাদটীকা
সম্পাদনা- ↑ Plato, Symposium, 180a
- ↑ কিংবদন্তি: যার সূত্রপাত প্রথম খ্রিষ্টাব্দে রচিত স্ট্যাটিয়াসের একটি কবিতার মাধ্যমে।
- ↑ Aeschylus, Prometheus Bound 755-768; Pindar, Nemean 5.34-37, Isthmian 8.26-47; Poeticon astronomicon (ii.15)
- ↑ Apollonius of Rhodes, Argonautica 4.869-479.
- ↑ Hesiod, Catalogue of Women, fr. 204.87-89 MW; Iliad 11.830-32
- ↑ "Proclus' Summary of the Cypria"। ৯ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুন ২০০৯।
- ↑ "Dares' account of the destruction of Troy, Greek Mythology Link."। ২৮ জুন ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ জুন ২০১২।
- ↑ James Davidson, "Zeus Be Nice Now" in London Review of Books; 19 July 2007 [১] accessed October 23rd, 2007
- ↑ Iliad 9.334-343.
- ↑ "Alexander came to rest at Phaselis, a coastal city which was later renowned for the possession of Achilles' original spear." (Robin Lane Fox, Alexander the Great1973.144.
- ↑ Pausanias, iii.3.6; see Christian Jacob and Anne Mullen-Hohl, "The Greek Traveler's Areas of Knowledge: Myths and Other Discourses in Pausanias' Description of Greece", Yale French Studies 59: Rethinking History: Time, Myth, and Writing (1980:65-85) esp. p. 81.
- ↑ Guy Hedreen, "The Cult of Achilles in the Euxine" Hesperia 60.3 (July 1991), pp. 313-330.
- ↑ IV.27.1
- ↑ III.19.11
- ↑ De situ orbis, II, 7
- ↑ Orbis descriptio, v. 541, quoted in Densuşianu 1913
- ↑ quoted in Densuşianu
- ↑ Stephanus Byzantinus
- ↑ Pausanias, III.25,4
- ↑ Densuşianu 1913
- ↑ III.19,13
- ↑ XXII.8
- ↑ "Roger Ebert, Review of Troy"। ২ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- Homer, Iliad
- Homer, Odyssey XI, 467-540
- Apollodorus, Bibliotheca III, xiii, 5-8
- Apollodorus, Epitome III, 14-V, 7
- Ovid, Metamorphoses XI, 217-265; XII, 580-XIII, 398
- Ovid, Heroides III
- Apollonius Rhodius, Argonautica IV, 783-879
- Dante Alighieri, The Divine Comedy, Inferno
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- Ileana Chirassi Colombo, “Heroes Achilleus— Theos Apollon.” In Il Mito Greco, ed. Bruno Gentili & Giuseppe Paione, Rome, 1977;
- Anthony Edwards:
- “Achilles in the Underworld: Iliad, Odyssey, and Æthiopis”, Greek, Roman, and Byzantine Studies, 26 (1985): pp. 215–227 ;
- “Achilles in the Odyssey: Ideologies of Heroism in the Homeric Epic”, Beitrage zur klassischen Philologie, 171, Meisenheim, 1985 ;
- “Kleos Aphthiton and Oral Theory,” Classical Quarterly, 38 (1988): pp. 25–30 ;
- Hedreen, Guy (১৯৯১)। "The Cult of Achilles in the Euxine"। Hesperia। 60 (3): 313–330। ডিওআই:10.2307/148068।
- Kerenyi, Karl (১৯৫৯)। The Heroes of the Greeks। New York/London: Thames and Hudson।
- Hélène Monsacré, Les larmes d'Achille. Le héros, la femme et la souffrance dans la poésie d'Homère, Paris, Albin Michel, 1984;
- Gregory Nagy:
- The Best of The Acheans: Concepts of the Hero in Archaic Greek Poetry, Johns Hopkins University, 1999 (rev. edition);
- The Name of Achilles: Questions of Etymology and 'Folk Etymology', Illinois Classical Studies, 19, 1994;
- Dale S. Sinos, The Entry of Achilles into Greek Epic, Ph.D. thesis, Johns Hopkins University;
- Hamilton, Edith, Mythology, New York: Mentor, 1942
Thomas Bullfinch, Myths of Greek and Rome
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- Achilles An animated short depicting the story of Achilles as told by Homer, by Barry JC Purves
- The Story of Achilles and Patroclus
- Trojan War Resources
- Nicolae Densuşianu, Dacia Preistorică, 1913, I.4 Cult of Achilles: literary references to the island Leucos in Antiquity
- Gallery of the Ancient Art: Achilles
- Explore paintings that depict stories about Achilles, including 'Achilles Among the Daughters of Lycomedes' and 'The Death of Achilles'