সালোকসংশ্লেষণ

উদ্ভিদ, শৈবাল, সায়ানোব্যাকটেরিয়া ও প্রোটিস্টে সংঘটিত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যেখানে আলোকশ

সালোকসংশ্লেষণ শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ photos (অর্থ: আলোক; এখানে সূর্যালোক) ও synthesis (অর্থ: সংশ্লেষণ, বা তৈরি করা) এর সমন্বয়ে গঠিত।[১][২][৩] আবার সালোকসংশ্লেষণ কথাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,সালোক শব্দটির অর্থ হলো--সূর্যালোকের উপস্থিতি এবং সংশ্লেষণ শব্দটির অর্থ—কোনো কিছু উৎপাদিত হওয়া। এক কথায় সালোকসংশ্লেষণ এর অর্থ দাঁড়ায় সূর্যালোকের উপস্থিতিতে রাসায়নিক সংশ্লেষ। যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সবুজ উদ্ভিদ কোষে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে, পরিবেশের বায়ুমণ্ডল থেকে গৃহীত কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) ও মূল দ্বারা শোষিত জলের বিক্রিয়ায় শর্করা জাতীয় খাদ্যের সংশ্লেষ ঘটে এবং গৃহীত কার্বন ডাইঅক্সাইডের সমপরিমাণ অক্সিজেন (O₂)প্রকৃতিতে নির্গত হয়, তাকে সালোকসংশ্লেষণ বলে। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার উপজাত হল অক্সিজেন। এই প্রক্রিয়ায় সজীব উদ্ভিদকোষে উপস্থিত ক্লোরোফিল নামক রঞ্জক আলোকশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং তা উৎপন্ন শর্করাজাতীয় খাদ্যের মধ্যে স্থিতিশক্তি রূপে সঞ্চিত রাখে। এই শক্তি পরবর্তীকালে স্বভোজী উদ্ভিদ দ্বারা অথবা শাকাহারী প্রাণীদের গৌণ পুষ্টিতে সাহায্য করে। সবুজ উদ্ভিদ ছাড়া কিছু জীবাণু এবং কিছু আদ্যপ্রাণীর মধ্যেও এই প্রক্রিয়া পরিদৃষ্ট হয়। এরকম কিছু জীবাণু, আদ্যপ্রাণী ও ক্লোরোফিল যুক্ত সজীব কোষে (উদ্ভিদ) শারীরবৃত্তিয় জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়ায় সূর্যালোকের উপস্থিতিতে, পরিবেশ থেকে গৃহীত কার্বন ডাই অক্সাইড ও মূলরোম দ্বারা শোষিত জলের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সরল শর্করা জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয় ও কার্বন ডাই অক্সাইডের সমপরিমান অক্সিজেন উৎপন্ন হয়ে সৌরশক্তির আবদ্ধ ঘটার মাধ্যমে সালোকসংশ্লেষণ সম্পূর্ণ হয়। উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ দিনের বেলা ঘটে।

সূর্যের আলোতে সালোকসংশ্লেষণ চলমান
সালোকসংশ্লেষের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া।

সালোকসংশ্লেষণকারী জীব সম্পাদনা

সালোকসংশ্লেষণকারী উদ্ভিদ সম্পাদনা

কয়েক প্রকার ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ও উচ্চশ্রেণীর উদ্ভিদ, যাদের সালোকসংশ্লেষণকারী রঞ্জক পদার্থ থাকে, তারাই সালোকসংশ্লেষ করতে সক্ষম। মূলত পাতায় সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া সংঘটিত হলেও কিছু উদ্ভিদের মূল বা কাণ্ডেও এটি হতে পারে।

  • সালোকসংশ্লেষণকারী মূল: গুলঞ্চের আত্তীকরণ মূল, পটলের মূল, অর্কিডের বায়বীয় মূল (ভেলামেন)।
  • সালোকসংশ্লেষণকারী কাণ্ড: ফনীমনসা, বাজবরণ ও অন্যান্য উদ্ভিদের সবুজ কাণ্ড।

সালোকসংশ্লেষণকারী প্রাণী সম্পাদনা

যদিও সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া সবুজ উদ্ভিদে ঘটে, তবুও কয়েকটি এককোষী প্রাণী, যেমন-- ইউগ্লিনা, ক্রাইস‍্যামিবা প্রভৃতিতে ক্লোরোফিল থাকায় সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি হয়।

  • যেসব উদ্ভিদে ক্লোরোফিল থাকে না তারা সালোকসংশ্লেষে অক্ষম। ছত্রাকজাতীয় উদ্ভিদে ক্লোরোফিল বা সালোকসংশ্লেষীয় রঞ্জকপদার্থ না থাকার জন্য সালোকসংশ্লেষ ঘটে না।
    উদাহরণ: মিউকর, ইস্ট প্রভৃতি

সালোকসংশ্লেষণকারী অঙ্গসমূহ সম্পাদনা

  • পাতার সবুজ অংশ
  • কচি সবুজ কাণ্ড
  • থ্যালয়েড সবুজ উদ্ভিদের থ্যালাস
  • ফুলের সবুজ বৃতি ও বৃন্ত
  • ফলের সবুজ ত্বক
  • সাইটোপ্লাজম

সালোকসংশ্লেষণের উপাদান সম্পাদনা

সালেকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সম্পাদনা

সালেকসংশ্লেষণ এর বিক্রিয়া:-

6CO2 + 12H2O +তাপ→ C6H12O6+6H2O+6O2 সালেকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ২টি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়-

  1. আলোক নির্ভর পর্যায়
  2. অন্ধকার পর্যায়
  • সালোকসংশ্লেষণের সামগ্রিক প্রক্রিয়া*:

কার্বন ডাই-অক্সাইড+পানি (আলো/ক্লোরোফিল)= গ্লুকোজ + অক্সিজেন + পানি।

সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতি:- সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় আলোক শক্তির রাসায়নিক স্থির শক্তিতে পরিণত হয়।এতে শক্তি সঞ্চিত হয়। যেসব কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট আছে কেবল সে সব কোষে এই প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়।সূর্যালোকের উপস্থিতিতে এ প্রক্রিয়া চলে। পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর প্রধান উপাদান।একটি উপচিতি প্রক্রিয়া, তাই উদ্ভিদের ওজন বাড়ে। এখানে শর্করা ও অক্সিজেন উৎপন্ন হয়।ক্লোরোফিল বিশিষ্ট উদ্ভিদে চলে।শুধুমাত্র কোষের ক্লোরোপ্লাস্টে এটি সংঘটিত হয়।উদ্ভিদ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে।

সালোকসংশ্লেষণ বা সালোকসং‌শ্লেষের তাৎপর্য সম্পাদনা

উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ জীবকূলের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সালোকসংশ্লেষজাত বিভিন্ন প্রকার খাদা, জ্বালানী বা অন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমরা সবসময় গ্রহণ করি। উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনধারণ তথা পারস্পরিক নির্ভরতার ক্ষেত্রে সালোকসংশ্লেষের অবদান অনস্বীকার্য।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সালোকসংশ্লেষের তাৎপর্য তথা গুরুত্ব নীচে বর্ণনা করা হল:

[১] সৌরশক্তি সংগ্রহ: সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তি উদ্ভিদদেহে রাসায়নিক শক্তি বা খাদ্য হিসেবে জমা হয়। সৌরশক্তির মাত্র ১% থেকে ২% সালোকসংশ্লেষে কাজে লাগে। প্রকৃতপক্ষে এই শক্তিই সমগ্র জীবজগৎ সংগ্রহ করে তা নিজের কাজে লাগায়।

[২] খাদ্যসংশ্লেষ ও বিভিন্ন জীবে সরবরাহ: সালোকসংশ্লেষে উৎপন্ন খাদ্যই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রহণ করে জীবনধারণ করে।

(ক) কার্বোহাইড্রেটজাতীয় খাদ্য (Carbohydrates):

(i) শর্করা (Saccharides): আখ, খেজুর ও তালগাছের রস, ফল, বীট ইত্যাদি থেকে আমরা শর্করা-জাতীয় খাদ্য পাই। যেমন- গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সুক্রোজ ইত্যাদি।

(ii) স্টার্চ বা শ্বেতসার (Starch): উদ্ভিদের বীজপত্রে, মূলে, ভূনিম্নস্থ কান্ডে প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ বা শ্বেতসার পাওয়া যায়। আমরা তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি।

(iii) সেলুলোজ (Cellulose): উদ্ভিদকোষের কোষপ্রাচীর সেলুলোজ নামে কার্বোহাইড্রেট দিয়ে গঠিত। শাকাশী প্রাণীরা, যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি এইপ্রকার খাদ্য গ্রহণ ও হজম করতে পারে।

(খ) প্রোটিন (Proteins): ডাল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে। প্রাণীরা তা গ্রহণ করে প্রোটিনের চাহিদা মেটায়।

(গ) স্নেহ ও তেলজাতীয় পদার্থ (Fats and Oils): এই খাদ্যগুলি সাধারণত উদ্ভিদের বীজে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাদাম, নারকেল, সরষে, তিসি ইত্যাদি।

(ঘ) ভিটামিন (Vitamins): বিভিন্ন সবুজ তাজা শাকসবজি, তরিতরকারী, ফলমূল ইত্যাদিতে প্রচুর ভিটামিন থাকে। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে আমরাও ভিটামিন গ্রহণ করি।

উল্লেখ করা যেতে পারে, উদ্ভিদদেহের অতিরিক্ত খাদ্যই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে। তাই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই খাদ্যগুলি উৎপন্ন না হলে জীবের জীবনধারণ সম্ভব হত না।

[৩] বিভিন্ন জৈববস্তু উৎপাদন: আমাদের পরিধেয় বস্ত্র, দড়ি, কাছি, থলে, বস্তা ইত্যাদি তৈরি করতে যে বস্তুর প্রয়োজন হয় তার নাম তন্তু (Fibre)। তুলো, পাট, শণ ইত্যাদি জৈব তন্তু প্রকৃতপক্ষে সালোকসংশ্লেষজাত পদার্থ।

বাড়ি নির্মাণে, আসবাবপত্রে যে কাঠ প্রয়োজন হয় তাও সালোকসংশ্লষের ফল। ভেষজ উদ্ভিদ থেকে যে সমস্ত ওষুধ পাওয়া যায় সেগুলিও সালোকসংশ্লেষের দান।

[৪] জ্বালানীর উৎস: কাঠ ও কয়লা বর্তমান যুগে অন্যতম প্রধান জ্বালানী। এই জ্বালানীগুলিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে মানুষ সভ্যতার আলোকে প্রবেশ করেছে। কয়লা দিয়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিন চলে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে খনিতে যে কয়লা পাওয়া যায় তা উদ্ভিদ-জাত। হাজার হাজার বছর ধরে বিরাট বনজঙ্গল তথা কাঠ মাটির নীচে চাপা পড়া অবস্থায় থেকে কয়লার সৃষ্টি করেছে। কাঠ সালোকসংশ্লেষ জাত। তাই জ্বালানী কয়লাও সালোকসংশ্লেষের অবদান।

অন্যদিকে পেট্রোলিয়াম-জাত জ্বালানী, যেমন পেট্রোল, কেরোসিন, ডিজেল ইত্যাদিও পরোক্ষভাবে সালোকসংশ্লেষের দান। কারণ, সুদূর অতীতের নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ থেকেই এগুলি উৎপন্ন হয়েছে।

[৫] পরিবেশে O₂ ও CO₂-এর ভারসাম্য রক্ষা: বাতাসে O2 এবং CO2-এর শতকরা পরিমাণ হল যথাক্রমে 20.60 এবং 0.03 ভাগ। সালোকসংশ্লেষে সবুজ উদ্ভিদ বাতাসে O2 উপজাত পদার্থ হিসেবে ত্যাগ করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বাতাসের O2-এর সিংহভাগই সালোকসংশ্লেষের দান। দহনে এবং জীবের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) সবাত শ্বসনে বায়ুমণ্ডল থেকে 02 অপসারিত হয়, এবং দহনে ও শ্বসনে উৎপন্ন CO₂ বায়ুমণ্ডলে আসে। এই CO₂ সবুজ উদ্ভিদ সালোক- সংশ্লেষে ব্যবহার করে এবং বায়ুমণ্ডলে উপজাত 02 ত্যাগ করে। এই 02 আবার জীবকর্তৃক শ্বসন-প্রক্রিয়ায় গৃহীত হয়। ফলে বায়ুমণ্ডলে 02 এবং CO2-এর শতকরা পরিমাণ মোটামুটি ঠিক থাকে। অর্থাৎ, পরিবেশে O₂ ও CO₂-এর ভারসাম্য বজায় থাকে। সেজন্য পৃথিবীর সমস্ত জীব স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে। সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া পৃথিবীর বুকে না থাকলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের ঘাটতি হতো এবং বায়ু CO₂-এ ভরে যেত। এককথায় বায়ুমণ্ডল দূষিত হয়ে সমগ্র জীবজগৎ ধ্বংস হত। তাই সালোকসংশ্লেষ বায়ু দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে সমগ্র জীবকূলকে এই ধরণীর বুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি নিম্নলিখিত ভাবে দেখানো যায়। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন, ২০.৬০% ---->দহন এবং বিভিন্ন জীব কর্তৃক শ্বসনে অক্সিজেন ব্যবহার---->কার্বন ডাই অক্সাইড এর উৎপত্তি---->বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড,০.০৩%---->উদ্ভিদ কর্তৃক সালোকসংশ্লেষে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ---->সালোকসংশ্লেষে উপজাত হিসেবে অক্সিজেন ত্যাগ---->বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন,২০.৬০% । উল্লেখ্য, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে অক্সিজেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ মোটামুটি একই থাকে ফলে প্রত্যেক জীব সুস্থভাবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে পারে। [৬] ভবিষ্যৎ জ্বালানীর উৎস সন্ধানে: প্রকৃতির সালোকসংশ্লেষের অনুকরণে মানুষ ভবিষ্যতের জ্বালানীর সন্ধানে বর্তমানে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে। বিজ্ঞানী ব্রোডা(Broda,1975)র মতে সালোকসংশ্লেষের অনুকরণে সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে জল থেকে আমরা যদি শক্তিযুক্ত হাইড্রোজেন অণু সংগ্রহ করতে পারি তাহলে জ্বালানীর সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে।

{{ তথ্য সূত্র: মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান সহায়িকা, ষন্নিগ্রহী-ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, এপ্রিল ১৯৮৬, পৃঃ২০,২১}}

তথ্যসূত্র সম্পাদনা