মীর জুমলা

বাংলার সুবাদার
(Mir Jumla থেকে পুনর্নির্দেশিত)

মীর জুমলা (১৫৯১ - ৩০ মার্চ ১৬৬৩) মুঘল ভারতের সুবাহ বাংলার সুবাদার ছিলেন। তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি ছিলেন।[১][২]

মীর জুমলা (দ্বিতীয়)
জন্ম
মীর মুহাম্মদ সাইদ আর্দেস্তানি

১৫৯১
আর্দিস্তান, ইস্পাহান
মৃত্যু৩০ মার্চ ১৬৬৩(1663-03-30) (বয়স ৭১–৭২)
খিজিরপুর
সমাধিগারো পাহাড়, মেঘালয়
উপাধিমু'আজম খান, খান-ই-খানন, সিপাহ সালার এবং ইয়ার-ই-বাফাদার
সন্তানমুহাম্মদ আমিন খান
পাগলা সেতু (১৮১৭), সেতুটি মীর জুমলা ১৬৬০ সালে নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়।

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

মীর জুমলা ১৫৯১ সালে মির্জা হাজারু নামে ইস্পাহানের এক দরিদ্র তেল ব্যবসায়ীর কাছে ইরানের মীর মোহাম্মদ সৈয়দ আরদিস্তানি হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তার বাবা-মা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন, তবুও তার চিঠিগুলি শেখার সুযোগ ছিল যা সম্ভবত তাকে একজন হীরে ব্যবসায়ীর অধীনে কেরানি হিসাবে চাকরি খুঁজে পেতে পরিচালিত করে, যার সাথে গোলকোন্ডা রাজ্যের সংযোগ ছিল।[৩][৪] এই অঞ্চলটি হীরার খনির জন্য বিখ্যাত ছিল। পরে তিনি ১৬৩০ সালের প্রথম দিকে গোলকোন্ডায় আসেন। একজন শেখ উল ইসলাম এবং তার দেশে সাধারণ দুঃশাসনের আর্থিক ঋণের কারণে তিনি গোলকোন্ডায় অভিবাসিত হন।[৫] তিনি তার নিজস্ব হীরার ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যিক প্রচেষ্টায় জড়িত হয়েছিলেন যা তার সম্পদ বাড়িয়েছিল।

জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়, তিনি গোলকোন্ডার রাজার কাছে উপহার নিয়ে আসেন এবং সুলতানের দরবারে ঘুষ দেন।[৬] মীর জুমলা গোলকোন্ডার সুলতানের সেবায় প্রবেশ করেন এবং রাজ্যের উজির (প্রধানমন্ত্রী) পদে উন্নীত হন।[৭]

অবদান সম্পাদনা

তিনি নিজে ব্যবসায়ী হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে ব্যবসা বাণিজ্যের অবদান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তার আমলে পর্তুগীজদের ব্যবসার অবনতি ঘটে। তবে ওলন্দাজ ও ইংরেজ কোম্পানিগুলোর উত্থান ঘটে । তিনি ইউরোপীয়সহ বিদেশি বণিকদের রাজকীয় ফরমানে প্রদত্ত সুবিধা গ্রহণে সহায়তা করেন। তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব যিনি কেরানি হিসাবে জীবন শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন শ্রেষ্ঠতম সেনানায়ক এবং মোগল সাম্রাজ্যের একজন যোগ্যতম গভর্নর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন ।

ঢাকা ও শহরতলী এলাকায় মীরজুমলার নির্মাণ কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে দ্রুত সৈন্য চলাচল, যন্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ প্রেরণ এবং জনকল্যাণে নির্মিত দুটি রাস্তা ও দুটি সেতু। কৌশলগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনে তিনি কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন। একটি দুর্গ ছিল টঙ্গী জামালপুরে, যা ঢাকাকে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে (বর্তমানে ময়মনসিংহ রোড) সড়কটির নিরাপত্তা বিধান করত। অন্য সড়কটি পূর্বদিকে চলে গিয়ে রাজধানীকে ফতুল্লার (পুরাতন ধাপা) সঙ্গে যুক্ত করেছে, যেখানে দুটি দুর্গ রয়েছে। আরও বিস্তৃত হওয়া এই সড়কটি দিয়ে খিজিরপুর পর্যন্ত যাওয়া যেত এবং সেখানেও দুটি দুর্গ অবস্থিত ছিল। ফতুল্লার অদূরে পাগলা সেতুটি এই রাস্তায় অবস্থিত। মীর জুমলা নির্মিত সড়ক ও দুর্গগুলির কিছু অংশ এখনও বিদ্যমান রয়েছে।

বাংলায় মীরজুমলার শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত নীতি, যার দ্বারা তিনি সীমান্তবর্তী কামরূপ এবং আসাম রাজ্যগুলি জয় করেছিলেন।

নিজের চেষ্টায় সামান্য অবস্থা থেকে অতি উচ্চপদে উন্নীত মীরজুমলা ছিলেন সতেরো শতকে ভারতের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। একজন সাধারণ কেরানি হিসেবে জীবন শুরু করে তিনি মুগল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও সুবাহদার হয়েছিলেন।

ড. মুনতাসীর মামুন ‘ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামানের খোঁজে’ গ্রন্থতে বুড়িগঙ্গার তীরে মীর জুমলার স্থাপন করা ২টি কামানের কথা উল্লেখ করেছেন ।ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট ও গ্রন্থাকার ডি. আয়লির মতে মগ জলদস্যুদের হাত থেকে ঢাকাকে রক্ষার জন্য তিনি এটিকে সোয়ারী ঘাটের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর মধ্যে মোগলাই চরে বসিয়েছিলেন।[৮][৯] ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মকর্তা রবার্ট লিণ্ডসে (১৭৯১-১৮৫৫) তার স্মৃতিচারণমূলক বইতে "কালে খাঁ জমজম সম্বন্ধে" বলেছেন[১০][১১]

৩৬ ফুট লম্বা, পেটানো লোহায় তৈরি এই কামান যে কারো দৃষ্টি কাড়ে। কামানটির বিশাল ব্যারেলের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে বসানো ছিল চৌদ্দটি শক্তিশালী লৌহনির্মিত দণ্ড এবং সেইসব শক্তিধর লৌহদণ্ডের ওপর দিয়ে একের পর এক বসানো ছিল প্রবল শক্তিধর লৌহচক্র। কামানটির পাশে আছে একটি পাথরের গোলক। এই গোলকটি কামানের গোলার সমান আকৃতির। গোলকটি এত ভারী যে, সবচেয়ে শক্তিশালী লোকও এটাকে হাঁটুর চেয়ে উঁচুতে তুলতে পারবে না। গোলকটি লোহা দিয়ে বানানো হলে এর ওজন হত কমপক্ষে ১২শ পাউন্ড। কামানটি দেখতে সুন্দর, তবে এর সবটা সমানুপাতিক নয় । ওজন হবে ৬৪ হাজার ৮১৪ পাউন্ড।[১২]

বিখ্যাত ভূগোলবিদ রেনেল ও তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন কালে খাঁ জমজমের বিষয়ে।[১৩] ব্রিটিশ শাসকদের অবহেলায় কালে খাঁ জমজম ১৭৮০ সালে বুড়িগঙ্গা নদীতে তলিয়ে যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এটি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা এখনো রয়েছে। অপর কামানি হচ্ছে বিবি মরিয়ম কামান[১৪]

১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মীর জুমলা ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীতে জলদস্যুদের নিধন করার জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরবর্তী সোনাকান্দা এলাকায় সোনাকান্দা দুর্গ স্থাপন করেন।[১৫] বারভূঁইয়াদের দমনের উদ্দেশ্যে এবং ঢাকাকে জলদস্যুদের কবল থেকে রক্ষার জন্য তিনি ১৬৬০ সালে ইদ্রাকপুর কেল্লা নির্মাণ করেন।[১৬]

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অভিযান সম্পাদনা

মীর জুমলার সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল কামরুপ ও আসাম রাজ্য দখল করা। তখন কোচবিহার ছিল একটি করদরাজ্য। কোচবিহারের রাজা প্রাণ নারায়ণ মোগল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতার সুযোগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৬৩৯ সালে মোগল-আসাম চুক্তি ভঙ্গ করে আসামের রাজা জয়দববাজ সিং কামরুপের অংশবিশেষ দখল করে নেন। এই অংশ পূর্বে মোগল সাম্রাজ্যের বঙ্গ সুবার সঙ্গে একীভূত ছিল। ১৬৩৬ সালে একজন অহমীয় মুসলিম বণিকের হত্যাকাণ্ড ছিল মোগল-অহম যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ। মীর জুমলা একটি বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। তিনি কামরুপ রাজ্যের বিরুদ্ধে তার মূল সৈন্যবাহিনী ও নৌবহর পাঠান। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অগ্রসর হন কোচবিহারের বিরুদ্ধে। তার অগ্রযাত্রার মুখে রাজা প্রাণ নারায়ণ দেশ ছেড়ে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান। দেড় মাসের মধ্যে কোচবিহার দখল করা হয়। তারপর মীর জুমলা কামরুপ অভিমুখী মূল বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হন। আসামের রাজা কামরুপ পরিত্যাগ করলেও মীর জুমলা আসাম দখলের সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৬১ সালের ১লা নভেম্বর মীর জুমলা ১২ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ৩২৩টি জাহাজ ও নৌকার একটি বহর নিয়ে আসাম অভিমুখে এগিয়ে যান। তার নৌবহরে পর্তুগীজ, ওলন্দাজইংরেজ নাবিকও ছিল। মীর জুমলা ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে কর্মরত ৪০-৬০ জন জার্মান সৈন্য ও নাবিককে সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি করেছিলেন।

আসাম, কোচবিহার ও কামরুপ অঙ্চল দখল করতে এসে ভূরুঙ্গামারীতেবেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি একটি মসজিদ তৈরী করেন। মীর জুমলা মসজিদটি কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারীর পাইকের ছড়া ইউনিয়নের ফুটানী বাজারের দক্ষিণে অবস্থান।এটি অতি প্রাচীন মসজিদ নামেও পরিচিত। মসজিদ এক গম্বুজ বিশিষ্ট, তিনটি প্রবেশ দরজা বিশিষ্ট দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট, প্রস্থ ২২ ফুট এবং মসজিদের  উত্তর পার্শ্বে একটি দরগা রয়েছে। এখন মসজিদটি ভেঙ্গে ঐ স্থানে নতুন মসজিদ তৈরী করেছে মসজিদ কমিটি।তবে দরগাটি এখনো দাড়িয়ে আছে। পাইকের ছড়া ইউনিয়নের কৃর্তি সন্তান  স্বনামধন্য জনদরদী চেয়াম্যান ও শিক্ষানুরাগী আবুল হাসান মীর জুমলা মসজিদের স্মৃতি ও আকৃতি টিকিয়ে রাখতে নিজ বাড়ির সামনে মীর জুমলা মসজিদের আদলে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

বাদশা আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করে ঢাকায় প্রেরণ করেন।মীর জুমলা ঢাকায় আসার পর প্রথমে আসাম ও কোচবিহার রাজাকে তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত জবাব ও উত্তর বঙ্গ উদ্ধারের জন্য   প্রচুর সৈন্যসহ রনতরী, কামান ও অন্যান্য রসদ নিয়ে কোচবিহার অভিমুখে পাঠান। এবং পুর্বে প্রেরিত সৈন্যদের ও যুদ্ধ নৌকাগুলোকে অপ্রসিদ্ধ পথ ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদী ( দুধকুমর নদী) দিয়ে গয়াবাড়িতে ( ভূরুঙ্গামারী) অবস্থান করতে বলা হয়। মীর জুমলা স্বয়ং ১২ হাজার অশ্বারোহী ও বহু পদাতিক সৈন্য নিয়ে স্থল পথে রওয়ানা হয়ে গয়াবাড়ি (ভূরুঙ্গামারী) পৌছান।গয়াবাড়ি পৌছার পর প্রতিকুল আবহাওয়ার শিকার হন।ফলে যাত্রা বিরতি করেন।এবং সকল সৈন্যসহ গয়াবাড়িতে দির্ঘ্য দিন অবস্থান করেন। এই সময় তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

এই মসজিদটি মীর জুমলা মসজিদ নামে পরিচিত। এখানে থেকেই মীর জুমলা কোচবিহার ও আসাম যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে মোঘল সৈন্যরা এই জায়গাতে অনেক দিন অবস্থান করে ছিল।[১৭]

যুদ্ধের রসদ ও সৈনিক:

প্রত্যেকটি বড় জাহাজ বা গুরবে ছিল ১৪টি করে কামান এবং ৫০/৬০ জন কামান চালক। প্রত্যেকটি বড় জাহাজের সঙ্গে ছিল চারটি করে কোশা। তলদেশ অত্যন্ত প্রশস্ত কয়েকটি জাহাজ ছিল। এসব জাহাজে কোনো মাস্তুল ছিল না। মাস্তুলবিহীন এসব জাহাজেও কামান বহন করা হয়। মীর জুমলা অবস্থান করতেন অশ্বারোহী বাহিনীর মাঝখানে। তার সামনে অবস্থান করতো হস্তীবাহী রণবাদ্য বাহক। তার পেছনে অবস্থান করতো আরো ২০টি হাতি। প্রত্যেক রণহস্তীর পিঠে ছিল দু’টি করে কামান, দু’জন গোলন্দাজ এবং দু’জন চার্জার। ইউরোপীয় অভিযাত্রী ম্যানুয়েল মানুচি স্টোরিয়া দো মগোর (Storia do Mogor) শিরোনামে তার স্মৃতিকথায় এ অভিযানের বর্ণনা দিয়েছেন।[৬] এ স্মৃতিকথা অবলম্বনে ফরাসি ঐতিহাসিক ফ্রাঁসোয়া ক্যাত্রো ১৭১৫ সালে হিস্টরিক জেনারেল দ্যল এম্পায়ার দু মোগল (Historic Generale de l’Empire du Mogol) শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। মানুচি মোগল নৌবাহিনীতে কর্মরত ব্রিটিশ নাবিক টমাস প্রাটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। মীর জুমলা প্রাটিকে একজন নাবিক হিসাবে মোগল নৌবাহিনীতে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি নৌযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় রণনৌকা এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করতেন। ঐসময় আসাম ছিল একটি বিরাট দেশ। এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশ বঙ্গদেশ থেকে ভিন্নতর হলেও মীর জুমলা দমে যাননি।

অভিযান সম্পাদনা

গৌহাটি থেকে রওনা দেয়ার ৬ সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে তিনি আসামের রাজধানী গড়গাঁও পর্যন্ত জয় করেন। আসাম ছিল পাহাড় পর্বতে পরিপূর্ণ একটি দেশ। আসামের রাজা জয়দববাজ রাজধানী পরিত্যাগ করে পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ে আশ্রয় নিলে তার সব সম্পদ মোগলদের হাতে পড়ে। সম্পদগুলোর মধ্যে ছিল ৮২টি হাতি, ৩ লাখ স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ৬৭৫টি বড় কামান, বাঙ বোঝাই ৪ হাজার ৭৫০ মণ গোলাবারুদ, ৭ হাজার ৮২৮টি বর্ম, এক হাজার পুরনো জাহাজ এবং ১৭৩টি চালের গুদাম। মীর জুমলা গৌহাটি থেকে মানাস নদী পর্যন্ত খুব সহজে অসমীয়াদের দুর্বল প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেন। তিনি একটির পর একটি দুর্গ দখল করে নেন। পান্ডু, গৌহাটি ও কজালির পতন ঘটে। এসময় মোগলরা ছিল অপ্রতিহত। অহমীয়দের মধ্যে পারস্পরিক অসন্তোষ মীর জুমলাকে দ্রুত বিজয় লাভে সহায়তা করে। শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও অফিসারদের প্রায় সকলেই ছিলেন অহমীয়। রাজা জয়দববাজ সিং ভাটি আসামের গভর্নর এবং সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসাবে একজন কায়স্থকে নিয়োগ করলে সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এ অফিসার ছিলেন বেজদোলোই পরিবারের মানন্থির ভারালি বড়ুয়া। তাকে পর্বতীয়া ফুকান হিসাবেও নিয়োগ দেয়া হয়। তার নিয়োগে বংশানুক্রমিক অহমীয় সভাসদ ও কমান্ডারদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের জন্ম হয়। অসন্তোষ বিরাজ করায় তাদের প্রতিরোধ ছিল নামমাত্র। অনেকে সপক্ষ ত্যাগ করে মীর জুমলার সঙ্গে যোগ দেয়। তবে মীর জুমলা কালিয়াবোরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেলে অহমীয়দের হুঁশ ফিরে আসে। তারা সিমালুগড় এবং সামধারা দুর্গ প্রতিরক্ষায় তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে। ১৬৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মীর জুমলা সিমালুগড় অবরোধ করেন। ভয়ংকর হাতাহাতি লড়াইয়ের পর অহমীযরা দুর্গ পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়। সিমালুগড়ের পতন ঘটলে নদীর বিপরীত তীরে সামধারায় মোতায়েন অহমীয় সৈন্যরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বিনা প্রতিরোধে পলায়ন করে। এ বিস্ময়কর বিজয় লাভের পর মীর জুমলা ১৬৬২ সালের ১৭ মার্চ বীর বেশে অহমের রাজধানী গড়গাঁয়ে প্রবেশ করেন। তিনি কেবলমাত্র আসামের রাজধানী দখল করেছিলেন। সে দেশের রাজাকে বন্দি কিংবা গোটা রাজ্য দখল করতে পারেননি। মীর জুমলা গড়গাঁয়ে গিয়ে থেমে যান।

মোগল সেনাদের যুদ্ধে বিপত্তি সম্পাদনা

বর্ষাকাল শুরু হলে মোগল সৈন্যরা কয়েকটি উঁচু ভূমিতে আটকা পড়ে। পানিতে রাস্তাঘাট নিমজ্জিত হয়ে যায়। জলাভূমি এমনকি নালা পর্যন্ত বড় বড় নদীর রূপ নেয়। তাই ঘোড়া এবং সৈন্য নিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ সুযোগে অসমীয়ারা নৈশকালে চারদিক থেকে মোগল সৈন্যদের হয়রানি করতো। তারা লাখনোর পূর্বদিকে তাদের হারানো সকল ভূখণ্ড অনায়াসে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কেবলমাত্র গড়গাঁও এবং মথুরাপুর ছিল মোগলদের অধিকারে। আসামের রাজা আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসে তার রাজ্য থেকে মোগলদের হটিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। খাবার ও বিশুদ্ধ পানি না থাকায় মোগলরা মথুরাপুর শিবির পরিত্যাগ করে। তাদের কাছে রসদ পৌঁছানো বন্ধ হয়ে যায়। শিবিরে খাদ্যের তীব্র ঘাটতি দেখা দেয়। মানুষের জীবন বাঁচাতে সৈন্যরা সুসজ্জিত ঘোড়া জবাই করে। সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে মোগলরা পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়। মীর জুমলা লাখনো ও ঢাকায় মোতায়েন রাজকীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পেরেছিলেন। খাদ্য ঘাটতি ছাড়াও মথুরাপুরে মোগল শিবিরে মহামারী দেখা দেয়। মহামারী দেখা দেয়ায় মীর জুমলা তার দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্য হারান। তিনি নিজেও আমাশয়ে আক্রান্ত হন। এমন প্রতিকূল পরিবেশে যে কোনো সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে যেতো। কিন্তু মীর জুমলার দৃঢ় নেতৃত্বে মোগল সৈন্যবাহিনী তাদের আক্রমণাত্মক অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ প্রাকৃতিক দুর্যোগের অবসান ঘটে। বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসে। বন্যার পানি নেমে যায়। রাস্তাঘাট জেগে উঠলে যোগাযোগ সহজতর হয়ে যায়। লাখনোতে মোগল নৌবহরের সঙ্গে মীর জুমলার সৈন্যদের পুনরায় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মোগল শিবিরে দুর্দশার ইতি ঘটে। মীর জুমলার সৈন্যরা দেবালগাঁয়ে মোতায়েন নৌবহরের সঙ্গে মিলিত হয়। রাজা জয়দববাজ সিং আবার পাহাড়ে পালিয়ে যান। ডিসেম্বরে মীর জুমলা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সৈন্যরা অগ্রযাত্রা করতে অস্বীকৃতি জানায়। ইতিমধ্যে আসামের রাজা পুনরায় শান্তি চুক্তি করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। অবশেষে ১৬৬৩ সালের জানুয়ারিতে ঘিলাজহরিঘাটে একটি চুক্তি হয়।

অভিযানে জয় সম্পাদনা

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অসমীয়ারা পশ্চিম আসাম মোগলদের কাছে সমর্পণ করে। তিন লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ এবং ৯০টি হাতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, আসামের রাজা মোগলদের সার্বভৌমত্ব মেনে নেবেন এবং শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ তিনি দু’জন অসমীয় রাজকুমারীকে মোগল দরবারে পাঠাবেন। মোগল দরবারে প্রেরিত রাজকুমারীদ্বয়ের একজন ছিলেন রাজার নিজের মেয়ে রোমনি গাবোরু এবং আরেকজন ছিলেন রাজার ভাতিজি তিপাম রাজার কন্যা রহমত বেগম। পরবর্তীকালে রোমনি গাবোরু আওরঙ্গজেবের পুত্রবধূতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। চুক্তির শর্ত অনুকূলে হলেও মীর জুমলা সৈন্য প্রত্যাহার করার সঙ্গে সঙ্গে দখলীকৃত অহমীয় ভূখণ্ড মোগলদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

ক্ষতিপূরণে আপত্তি সম্পাদনা

দ্রুত যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ নিয়ে মোগলদের সঙ্গে অসমীয়াদের বিরোধ বাধে। রাজা জয়দববাজ ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ করেন। কিন্তু মীর জুমলা আসাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা মাত্র অহমীয়ারা ক্ষতিপূরণ স্থগিত করে দেয়। জয়দববাজের উত্তরসূরি চক্রধাবাজ সিং নীতিগতভাবে ছিলেন যে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিপক্ষে।

মৃত্যু সম্পাদনা

আসাম থেকে ফিরে আসার পথে মীর জুমলা ১৬৬৩ সালের ৩০ মার্চ খিজিরপুরের অদূরে নৌকায় মারা যান। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে গারো পাহাড়ের কাছে একটি উঁচু টিলায় তাকে কবর দেয়া হয়। তার কবর দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. আবদুল করিম (২০১২)। "মীরজুমলা"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  2. R. C. Majumdar, General Editor (১৯৭৪)। History and Culture of the Indian People, Volume 07, The Mughul Empire। Public Resource। Bharatiya Vidya Bhavan। পৃষ্ঠা ৪৭৫–৪৭৬। 
  3. Richards, John F. (১৯৯৫)। The Mughal Empire। Cambridge [England]। পৃষ্ঠা ১৫৫। আইএসবিএন 0-511-58406-7ওসিএলসি 70782077 
  4. Sarkar, Jagadish Narayan (১৯৫১)। Life of Mir Jumla (সোয়াহিলি ভাষায়)। 
  5. "Mir Jumla-Iran Correspondence"। The Journal Of The Bihar And Orissa Research Society, Vol.28, 1942। ১৯৪২। 
  6. Irvine, William (১৯০৭)। Storia Do Mogor Vol.1 
  7. Gommans, Jos J. L. (২০০৩)। Mughal warfare : Indian frontiers and highroads to empire, 1500-1700। London: Routledge। পৃষ্ঠা ৭৮। আইএসবিএন 0-203-40258-8ওসিএলসি 52996650 
  8. "From Jahangirnagar to Dhaka"Forum। The Daily Star। ২১ আগস্ট ২০০৮। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  9. মুনতাসীর মামুন, "ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী", ৩য় সংস্করণ, ৪র্থ মূদ্রণ, জানুয়ারি ২০০৪, অনন্যা প্রকাশনালয়, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৮০, আইএসবিএন ৯৮৪-৪১২-১০৪-৩
  10. "Prothom Alo | Most popular bangla daily newspaper"। ২০১৯-১০-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-২৫ 
  11. "'গুলিস্তানের কামান দেখ...' | রাজধানী | The Daily Ittefaq"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-২৫ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  12. "LINDSAY, James (1791-1855), of Balcarres and Leuchars, Fife and 14 Lower Berkeley Street, Mdx. | History of Parliament Online"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-২৫ 
  13. "চরাচর-ঢাকার কামান by সাজ্জাদ কবির"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-২৫ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  14. ঢাকাবাসীকে ভয়, ভক্তি আর রোমাঞ্চের অনুভূতি এনে দিয়েছিল যে দুটি কামান, দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২
  15. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, নারায়ণগঞ্জ জেলা, বন্দর উপজেলা
  16. ইদ্রাকপুর কেল্লা, প্রথম আলো, ২১ এপ্রিল ২০১৫
  17. admin (২০২১-০৫-১৬)। "ভূরুঙ্গামারীর মীর জুমলা মসজিদ (Mir jumla mosque) : সাহিত্য ও কৃষ্টি"sristy.net (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-০৫