হেমন্ত
হেমন্ত হলো ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু, যা কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের সমন্বয়ে গঠিত। শরৎকালের পর এই ঋতুর আগমন। এর পরে আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। কৃত্তিকা ও আর্দ্রা এ দুটি তারার নাম অনুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের। ‘মরা’ কার্তিকের পর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মৌসুম’। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা করেছিলেন।
ফসল ও ফলফুলসম্পাদনা
এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, বকফুল।
নবান্ন উৎসবসম্পাদনা
হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন (অর্থঃ নতুন অন্ন) পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।[১]
বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়।
নবান্নে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।
অন্যান্য অঞ্চলেসম্পাদনা
ইউরোপে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে হেমন্তের শুরু। সেখানে একে বলা হয় বৈচিত্র্যময় রঙ ও পাতা ঝরার ঋতু। ঝাউ গাছগুলো ছাড়া সব গাছেরই পাতা এ সময় ঝরে যেতে শুরু করে এবং শীতের আগমনের আগেই সব বৃক্ষই ন্যাড়া হয়ে যায়।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেসম্পাদনা
নবান্ন, হেমন্ত ঋতুর শান্ত প্রকৃতি অনেক কবি সাহিত্যিক নানা ভাবে তাদের রচনায় তুলে ধরেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সুফিয়া কামাল, জসীম উদ্ দীন, জীবনানন্দ দাশ, গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ।
কাজী নজরুল ইসলামের ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় নবান্নের চিত্রটি বেশ উপভোগ্য। হেমন্ত ঋতুতে নিয়ে কবি সুফিয়া কামালের ছড়া-কবিতা হেমন্ত।
সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?
এছাড়াও এই ঋতুকে নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমের রাতে ওই গানটিতে লিখেছেনঃ
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’
বিশ্বকবি তার নৈবদ্যে স্তব্ধতা কবিতায় লিখেছেনঃ
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসম্পাদনা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে ষড়ঋতুর মধ্যে চারটি ঋতুর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। আর বাকি দুটি ঋতু হেমন্ত ও বসন্ত প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে।[২]
আরোও দেখুনসম্পাদনা
বহিঃসংযোগসম্পাদনা
- জার্মানিতে হেমন্ত, ডয়েচভেলে বাংলায় ছবি গ্যালারি
- মুনীর মোরশেদ, সম্পাদক (২০১০)। ঋতুপিডিয়া। ঢাকা: ঘাস ফুল নদী। আইএসবিএন 98482151542
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: length (সাহায্য)।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, ড. দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত, আকাদেমি অফ ফোকলোর, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৩২১-২২
- ↑ জলবায়ু পরিবর্তনে হারিয়েছে হেমন্ত ও বসন্ত ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ড. আইনুন নিশাতের সাক্ষাৎকার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪