হুমগুটি
হুমগুটি হল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটায় তালুক-পরগনার সীমানায় অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা। ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের জমি পরিমাপের বিরোধের মীমাংসা করতে আয়োজন হয়েছিল এই খেলার। পরবর্তীতে আমন ধান কাটা শেষ, বোরো ধান আবাদের আগে প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য জমিদারদের এই পাতানো খেলা চলছে আড়াইশো বছরেরও অধিক সময় ধরে।[১]
বৈশিষ্ট্যসমূহ | |
---|---|
ধরন | দলগত খেলা |
খেলার সরঞ্জাম | হুমগুটি |
ভেন্যু | বড়ই আটাবন্ধ মাঠ, ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ |
প্রচলন | |
দেশ বা অঞ্চল | ফুলবাড়িয়া,ময়মনসিংহ,বাংলাদেশ |
ইতিহাস
সম্পাদনা২৫০ বছর আগে মুক্তাগাছার রাজা শশীকান্ত আচার্য্যের সঙ্গে ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। তখনকার দিনে তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের জমিতে দুই নীতির কারণে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই বিরোধ মীমাংসা করার জন্য লক্ষ্ণীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে ‘তালুক-পরগনার সীমানায়’ এই গুটি খেলার আয়োজন শুরু করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’। মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয় জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায়।[২]
স্থানীয় মোড়ল পরিবার বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে এই খেলার আয়োজন করে আসছে। [৩]
হুমগুটি
সম্পাদনাহুমগুটি হচ্ছে একটি পিতলের তৈরি ৪০ কেজির গোলাকার বল। এ বল নিয়ে মাঠে লাখো মানুষের কাড়াকাড়ি হয় এর দখল নিয়ে। সবার মুখে উচ্চারিত হয় “জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে হেইও...।[৪]
সাধাররণত ফাল্গুনে আমন ধান ও তৎপরবর্তী রবিশস্য তোলার পর চৈত্রের শেষে অথবা প্রথমে ফসলবিহীন দিগন্ত বিস্তীর্ণ তৃর্ণ খোলা প্রান্তরে এ খেলা জমে উঠে। প্রধানত গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া কৃষাণ পরিবার সুস্থ্য, সবল, সাহসী যুবক থেকে শুরু করে প্রাকপ্রবীণ বযসীরাই এ খেলায় অংশ গ্রহন করে। খেলায় থাকে একটি মাত্র অদ্ভুদ উপকরণ। বৃহদাকার পিতলের কলসির গলার নিচের গোলাকার যে অংশ ঠিক সেরকমের একটি অংশের ভিতরে এমনভাবে মাটি ঠেসে ভরা হয় যে, মুখ বন্ধের পর তাতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েও মাটি বের করা যায় না।
খেলার সময়
সম্পাদনাপৌষ মাসের শেষ দিনকে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পুহুরা। এই দিনেই যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই খেলা। বিকেল সোয়া ৪টায় শুরু হয় এই খেলা। খেলা চলে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। কোন কোন বছর পরেরদিন পর্যন্ত খেলা চলার রেকর্ডও আছে। রাতের বেলায় টর্চ লাইটের সাহায্যে চলে এ খেলা।[৪]
খেলার মাঠ
সম্পাদনাফুলবাড়িয়া সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষ্মীপুর ও ১০ মাইলের মাঝামাঝি “বড়ই আটাবন্ধ” নামক বড় মাঠ হলো খেলার কেদ্রস্থল। এই স্থানটি মুক্তাগাছা-ত্রিশাল জমিদার আমলে তালুক বনাম পরগনার সীমানা ছিল।[২]
খেলার নিয়ম
সম্পাদনা১ মণ ওজনের পিতলের তৈরি গুটি করায়াত্ত করে নিজ গ্রামে নিয়ে গুম করা পর্যন্ত চলে এই খেলা। শুরুতে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ভাগবাটোয়ারা করে খেলা শুরু হলেও পরে আর কোন দিক থাকেনা। একেক এলাকার একেকটি নিশানা থাকে এবং ঐ নিশানা দেখে বুঝা যায় কারা কার পক্ষের লোক। গুটিটি কোন দিকে যাচ্ছে তা চিহিৃত করা হয় নিশানা দেখেই। এই গুটিটি মাঠের আসার পরপরই তার উপর ঝাপিয়ে পরে লাখো জনতা। দখল নিতে শুরু হয় টানাটানি, ধাক্কাধাক্কি, ধস্তাধস্তি। গুটিটি নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়।লক্ষ্মীপুরের বড়ই আটায় খেলা শুরু হলেও আস্তে খেলাটি ছড়িয়ে পড়ে ৫/৮ কিলোমিটার দূরের গ্রামেও। গুটিটি গুম না হওয়া পর্যন্ত চলে এ খেলা।[৪] মানুষের ভিড়ে কে গুটি নিয়ে দৌড় দিয়ে গুম করে কেউ জানেনা। খেলায় কোন রেফারি থাকেনা, খেলোয়াড়রাই থাকেন এ খেলার বিচারক।[৫] গুটি নিয়ে দলের কাড়াকাড়ি,আপন আপন গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং যারা নিতে পারবে তারাই হবে বিজয়ী।
অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়
সম্পাদনাআশেপাশের ময়মনসিংহ সদর উপজেলা, মুক্তাগাছা উপজেলা, ত্রিশাল উপজেলা ও ফুলবাড়িয়া উপজেলা থেকে আসা খেলোয়াড়রা অংশগ্রহণ করে।[২][৪]
খেলা শেষে
সম্পাদনাগ্রামের পর গ্রাম ভেঙ্গে গুটি নিয়ে নিজ গ্রামের সীমানার ভেতর প্রবেশ করার সাথে সাথে খেলার সমাপ্তি। বিজয়ী দল গুটি নিয়ে গ্রামের ধনাঢ্য বাড়ি গিয়ে উঠে। নানা উপঢৌকন এবং ভুরিভোজনে আপ্যায়ন করে তাদের বরণ করা হয়। চলমান বছর শেষ না হওয়া পর্যন্ত হুমগুটি বরণকারীর বাড়িতেই রক্ষিত থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান কৃষি ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে,তার ফলে এখন আর ফসলহীন বিস্তিৃণ খোলা প্রান্তর কমে যাওয়ায় হুমগুটি খেলা বিলুপ্ত হতে চলেছে।
উৎসব
সম্পাদনাঅতি প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্ণীপুর,কাটাখালী,বড়ই আটা, বালাশ্বর,শুভরিয়া,কালীবাজাইল,তেলিগ্রাম,সারুটিয়া, গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা, কুকরাইল, বরুকা, ফুলবাড়ীয়া পৌর সদর, আন্ধারিয়াপাড়া, জোরবাড়ীয়া, চৌধার, দাসবাড়ী,কাতলাসেনসহ আশে-পাশের ১৪ থেকে ১৫টি গ্রামে উৎসব শুরু হয় এই খেলাকে কেন্দ্র করে।[২] এই খেলা উপলক্ষ্যে আশেপাশের গ্রামগুলোতে নাইওর আসে বাড়ির বউ এবং কণ্যারা। মেজবানির জন্য করা হয় গরু খাসি জবাই দেওয়া হয়। ঘরে ঘরে পিঠা পুলির উৎসব শুরু হয়।[৪] এই খেলা উপলক্ষ্যে নতুন নতুন জামাও কেনে এই অঞ্চলের লোকেরা।[২]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "ফুলবাড়ীয়ায় ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলায় মানুষের ঢল"। .jugantor.com। দৈনিক যুগান্তর। জানুয়ারি ১৪, ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৯।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী খেলা হুমগুটি!"। ntvbd.com। এনটিভি। জানুয়ারি ১৪, ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "ময়মনসিংহে হুমগুটি খেলায় তেলিগ্রাম বিজয়ী"। ntvbd.com। এনটিভি। জানুয়ারি ১৪, ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৯।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ ""হুমগুটি" : একটি গুটি, মানুষ লাখ"। priyo.com। ২০১৮-০১-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-১২।
- ↑ "ঐতিহ্যের হুমগুটি খেলা"। samakal.com। দৈনিক সমকাল। জানুয়ারি ১৪, ২০১৭। ৯ মার্চ ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০১৯।