স্বামী প্রণবানন্দ

স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ

স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ ১৮৯৬ সালে ২৯ জানুয়ারি বুধবার মাঘীপূর্ণিমা তিথিতে মাদারিপুর জেলার বাজিতপুর গ্রামে বিষ্ণুচরণ ভূঞা ও মাতা সারদাদেবীর ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন।[১] বাল্য নাম ছিল বিনোদ। গ্রামটি ছিল সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। জমিদারের অত্যাচার থেকে প্রজাদের বাঁচাতে গিয়ে বিনোদনের পিতা বিষ্ণুচরণ ভুঁইয়া মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়েন। বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য গৃহদেবতা নীলরুদ্রের শরণাপন্ন হন তিনি। ভক্তের কাতর প্রার্থনায় দেবাদিদেব মহাদেব শিব প্রসন্ন হয়ে তাকে দর্শন দান করেন ও বলেন "ভয় নেই আমি তোমার পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করবো। আমার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ই তোমাদের বিপদের মেঘ কেটে যাবে। "

স্বামী প্রণবানন্দ
স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম(১৮৯৬-০১-২৯)২৯ জানুয়ারি ১৮৯৬
দর্শনসনাতন হিন্দু ধর্মের প্রচার, সন্ন্যাসী সংঘ গঠন, আর্ত-পীড়িত মানুষের ত্রাণ, সমাজ-সংস্কার, তীর্থ সংস্কার, ধর্মচক্র ও কর্মচক্রের প্রবর্তন প্রভৃতি
ঊর্ধ্বতন পদ
গুরুমহাযোগী বাবা গম্ভীরনাথজী
সম্মানস্বামীজি

গোরক্ষপুরের মহাযোগী বাবা গম্ভীরনাথজীর নিকট ১৯১৩ সালে ১৭ বৎসর বয়সে তিনি দীক্ষালাভ করেন এবং ১৯১৬ সালে মাত্র ২০ বৎসর বয়সে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। ১৯২৪ সালে প্রয়াগে অর্দ্ধকুম্ভমেলায় স্বামী গোবিন্দানন্দ গিরির নিকট আনুষ্ঠানিক সন্ন্যাস গ্রহণ পূর্বক স্বামী প্রণবানন্দ নামে পরিচিত হন। ১৯৪১ সালে ৮ জানুয়ারি মাত্র ৪৫ বৎসর বয়সে তিনি দেহ ত্যাগ করেন।

জীবনী সম্পাদনা

 
স্বামী প্রণবানন্দ

জন্ম সম্পাদনা

তিনি বর্তমান বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলায় কুমার নদী থেকে প্রায় এক মাইল দূরে বাজিতপুর গ্রামে বিষ্ণুচরণ ভুঁইয়া ও সারদা দেবীর সন্তান। বিষ্ণুচরণ ছেলের জন্মের পর দীর্ঘদিনের পুরোনো মামলায় জয়ী হয়েছেন, তাই ছেলের নাম রাখেন “জয়নাথ”। পরে নাম দেওয়া হয় বিনোদ। তিনি বুধবার জন্মে ছিলেন বলে তাঁর নাম হয় বুধো।[২]

সন্ন্যাস সম্পাদনা

সিদ্ধি লাভের দীর্ঘ ৮ বৎসর পর ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রয়াগধামের অর্ধকুম্ভের সময় স্বামী গোবিন্দানন্দ গিরি মহারাজের কাছ থেকে থেকে ব্রহ্মচারী সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন। তখন তার নাম হয় “আচার্য স্বামী প্রণবানন্দ।” উক্ত বছরেই মাঘি পূর্ণিমা তিথিতে তিনি চিহ্নিত প্রথম সাত জন সঙ্ঘ সন্তানকে সন্ন্যাস দীক্ষায় দীক্ষিত করনে।

বিপ্লবীদের সাথে সম্পর্ক সম্পাদনা

ব্রহ্মচারী বিনোদ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করতেন। তিনি বিপ্লবী দল মাদারিপুর সমিতির সদস্য ছিলেন এবং ১৯১৪ সালে মাদারিপুরের চারপাশে ডাকাতিতে পুলিশ ফরিদপুর ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯১৪) বিনোদকে গ্রেফতার করে মাদারিপুর ও পরে ফরিদপুর জেলে আটক রাখা হয়।

আশ্রম স্থাপন সম্পাদনা

তিনি ভারত সেবাশ্রম সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন।[৩] ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি আশ্রম স্থাপন করেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রচন্ড ঝড়ের ফলে বহু লোক মারা গেলে তিনি সেবার কাজে এগিয়ে আসেন। সেবাকার্য শেষে মাদারিপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধে "মাদারিপুর সেবাশ্রম" স্থাপিত করেন। এর কিছুবছরের মধ্যে খুলনা, নওগাঁ, আশাশুনি প্রভৃতি জায়গাতে সেবাশ্রম স্থাপিত হয়। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতার বাগবাজারে ডিস্পেনসারী লেনে ঘর ভাড়া করে কলকাতায় প্রথম আশ্রম স্থাপন করা হয়। ঐ বৎসরেই ভাদ্র মাসে ১১৮নং শোভাবাজার ষ্ট্রীটে ১৮ টাকা ভাড়ায় দুইখানি কোঠা ঘর ভাড়া লইয়া সেখানে কলিকাতা আশ্রম স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯২৪ খ্রীঃ জুন মাসে ২৭নং বহুবাজার ষ্ট্রীটে আশ্রম উঠিয়া আসে। ইং ১৯২৬ খ্রীঃ ১৬২ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে আশ্রম স্থানান্তরিত হয়। ইং ১৯২৭ খ্রীঃ জুলাই মাসে ২৪/৩, মীর্জ্জাপুর স্ট্রীটে (বতর্মানে সূর্য্যসেন স্ট্রীট) আশ্রম উঠিয়া আসে। পরে বালিগঞ্জে ডিহি শ্রীরামপুর লেনে কয়েক মাস থাকার পর ইং ১৯৩২ খ্রীঃ মে মাসে সঙ্ঘের প্রধান কার্য্যালয় ২১১, রাজবিহারী এভিনিউ, বালিগঞ্জে নিজস্ব জমি ও বাড়ীতে স্থাপিত হয়।

তীর্থ সংস্কার সম্পাদনা

আচার্য স্বামী প্রণবানন্দ জানতেন তীর্থস্থান গুলি ভারতের অখণ্ডতার সূত্র ধরে আছে, হিন্দু সমাজ সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে হিন্দুজাতি গঠন তার লক্ষ ছিল, তাই মিলন মন্দির ও রক্ষিদল গঠন এবং বহুবিধ জনহিতকর সেবামূলক কাজ তিনি তার প্রতিষ্ঠিত ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মাধ্যমে করেছেন। জনকল্যাণে তিনি যে সব কাজ করেছেন তার অন্যতম তীর্থ সংস্কার। ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী দের দারা দখল হয়ে যাওয়া তীর্থস্থান গুলি উদ্ধারের জন্য তিনি অন্দোলন চালিযেছিলেন। তীর্থসংস্কার আদির দ্বারা ভারতের পবিত্র তীর্থ গুলির জবরদখল মুক্ত করার জন্য প্রয়াশ করেন। সেখানে তীর্থ গুলিতে দরিদ্র অবহেলীত শ্রেণীর প্রবেশের জন্য দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন তিনি।

হরিজনদের বলপূর্বরক মন্দিরে প্রবেশ করাতে চাইলে তিনি তার বিরোধ করে বলেন যে – মন্দির সামাজিক কোঁদলের স্থান নয়। জোর করে মন্দিরে প্রবেশ করালেই অবহেলিত সমাজ রাতারাতি বড় হয়ে জায় না, তার জন্য সকলের পথ উন্মুক্ত করে হিন্দু মিলন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি হিন্দু দের কে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈষ্য চণ্ডাল নমঃশুদ্র ইত্যাদি কোন নামে ডাকেননি তিনি হিন্দু দের হিন্দু নামেই ডেকে ছিলেন। সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য তাৎক্ষণিক সমাধানের পথে না গিয়ে তিনি ব্যক্তি চরিত্র নির্মাণ, আদর্শ পরিবার গঠন ইত্যাদিকে সোপান হিসাবে ব্যবহার করেছেন তিনি। জন্মজাত শুদ্রত্বের তিনি বিরোধ করেছিলেন। তিনি শুদ্রদের “পকান্ন” চেয়ে খেয়েছেন। তাঃদের সংঙ্গে পঙ্‌ক্তি ভোজন, “ঔঁ স্বাহা” মন্ত্রোচ্চার পূর্বক বৈদিক যজ্ঞ তিনি তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন – হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, চণ্ডাল আদির কোন ভেদ নেই।[৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Library of Congress Office, New Delhi (১৯৮১)। Accessions List, South Asia। E.G. Smith। পৃষ্ঠা 90। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০১২ 
  2. Hindu Regeneration Bharat Sevashram Sangha, Hyderabad Branch - 1978 - Volume 8 - Page 67 "This child of Vishnu Charan Das and Sarada Devi was popularly called Vinod. But who could then assume that this Vinod would one day become Swami Pranavananda and materialize dreams of Swami Vivekananda? Yet it is strange that ..."
  3. Subodh Kapoor (১ জুলাই ২০০২)। The Indian Encyclopaedia: Biographical, Historical, Religious, Administrative, Ethnological, Commercial and Scientific. Indo-Pak War-Kamla Karri। Cosmo Publication। পৃষ্ঠা 6887–। আইএসবিএন 978-81-7755-257-7। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০১২ 
  4. যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দ, লেখক- রণজিৎ ঘোষ, প্রকাশক- স্বামী সারস্বতানন্দ, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, ২১১, রাসবিহারী এভিনিউ, কলকাতা-১৯

আরও দেখুন সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা