সাফিয়াহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব
সাফিয়াহ বিনতে আবদুল মুত্তালিব (আরবি: صفية بنت عبدالمطلب)[১] ছিলেন মহিলা সাহাবা ।মোহাম্মদ সা. ও আলি ইবনে আবি তালিব. এর ফুপু ছিলেন।[২][৩] এবং যুবাইর ইবনুল আওয়ামের মা ছিলেন। তিনি তৎকালীন আরবের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তার বহু ভূয়সী কবিতা ইতিহাসে পাওয়া যায়।[৪]
নাম ও বংশ পরিচয়
সম্পাদনাসাফিয়াহর পিতার নাম আবদুল মুত্তালিব এবং মাতার নাম হালাহ বিনতে উহাইব বিন আবদে মনাফের[৫][৬] এই সূত্রে তিনি হযরত হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব রা. এর সহোদর বোন এবং নবি হযরত মোহাম্মদ সা. ও আলী ইবন আবি তালিব রা. এর ফুপু ছিলেন।[২][৭]
ইসলাম গ্রহণ
সম্পাদনাইবনুল আসির বলেছেন, মুহাম্মাদ এর ফুফুদের মধ্যে একমাত্র সাফিয়াহ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।[৮][৯][১০] ইবনে সাদ বলেছেন, তিনি ৬২২ খ্রিঃ তার স্বামী আওয়ামের সাথে মদীনায় হিজরাত করেন।[১১][১২]
যুদ্ধে অংশগ্রহণ
সম্পাদনাসাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। খন্দক যুদ্ধে মহিলাদেরকে কবি হাসসান ইবনে সাবিতের দুর্গে নিরাপত্তার জন্যে রেখে যান। এই দুর্গকে উতুম দুর্গ বলা হতো। এই মহিলাদের মধ্যে সাফিয়াও ছিলেন। সাফিয়া একজন সাহসী মহিলা ছিলেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় এক ইহুদীকে তিনি দুর্গের আশে-পাশে ঘুর ঘুর করতে দেখলেন। পরে সাফিয়া নিজেই নিরাপত্তার[১৩] জন্য এই ইহুদিকে আক্রমণ করে হত্যা করলেন।[১৪][১৫][১৬][১৭]
উরওয়া বলেছেন,সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব প্রথম নারী যে একজন পুরুষ শত্রুকে হত্যা করেছে।
উহুদের যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন,যখন মুসলিম সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পালাচ্ছিলো তখন তিনি তাদেরকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। এই যুদ্ধে তার ভাই হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন।[১৮][১৯]
জীবনী
সম্পাদনাতিনি প্রথমে হারিস ইবনে হারবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, সাফি ইবনে হারিস ছিলেন তাদের সন্তান [২০] । তার দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন আওয়াম ইবনে খুয়াইলিদ, সাফিয়াহ এবং আওয়ামের সন্তানরা হলেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম, সাইয়িব এবং আবদুল কা'বা। [১১][১৯] তার স্বামী আওয়াম তার সন্তানদের শৈশবে মারা যান।[২১] আওয়াম ইবনে খুয়াইলিদ ছিলেন উম্মুল মুমীনিন খাদিজার ভাই।
সাফিয়াহ প্রায়ই তার ছেলে যুবাইরকে প্রহার করতেন। যখন মানুষ তাকে বলত, "তুমি তাকে মেরে ফেলছ তো! তুমি তার হৃদয় ভেঙ্গে দিচ্ছ। তুমি কি ছেলেটিকে ধ্বংস করতে চাও?" তিনি জবাব দিতেন, "আমি তাকে প্রহার করি, যাতে সে মেধাবী এবং যুদ্ধের ময়দানে সাহসী হয়।"[২২]
সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিবের জীবিকার জন্যে রাসূল খায়বার বিজয়ের পর সেখানে উৎপাদিত ফসল থেকে বাৎসরিক চল্লিশ ওয়াসক শস্য নির্ধারণ করে দেন।[১৭]
কাব্য প্রতিভা
সম্পাদনাসাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ গোত্রে হাশিমী শাখার একজন মহিলা কবি ও সুভাষিণী ছিলেন। আরবী ভাষাকে বেশ ভালো মতই আয়ত্তে আনেন। তিনি অবাধ গতিতে কবিতার শ্লোক বলতেন। সেই সব শ্লোক হতো চমৎকার ভাব বিশিষ্ট, প্রঞ্জল ও সাবলীল, সত্য ও সঠিক আবেগ-অনুভূতি সম্পন্ন এবং চমৎকার বীরত্ব ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ। বর্ণিত হয়েছে, তিনি যখন তার ছোট্ট শিশু সন্তান যুবাইর ইবনুল আওয়াম কোলে নিয়ে শ্লোক শোনাতেন।[২৩]
শ্লোকগাধার নমুনা
সম্পাদনাতিনি তৎকালীন আরব সমাজের বড় কবি ছিলেন। অনেকে তাকে কুরাইশ বংশের খানসা উপাধি দিয়েছেন।[২৪]
- আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর সাফিয়া তার বোনদের ও বনু হাশিমের মেয়েদের সমবেত করে একটি শোক অনুষ্ঠানের মত করেন। সেই অনুষ্ঠানে অনেক মহিলা স্বরচিত শোক পাঠ করেন। বিভিন্ন গ্রন্থে সেই শোককথন সংকলিত হয়েছে।[২৫] সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিবের দুইটি শোককথনঃ
উঁচু ভূমির এক ব্যক্তির জন্যে রাত্রিকালীন
বিলাপকারিণীর আওয়াজে আমি জেগে উঠি
অতঃপর আমার দু‘গণ্ড বেয়ে এমনভাবে অশ্রু গড়িয়ে
পড়লো যেমন ঢালু স্থান থেকে মতি গড়িয়ে পড়ে।
‘হে আমার চক্ষু! অশ্রু বর্ষণ ও রাত্রি জাগরণের
ব্যাপারে বদান্যতা দেখাও। একজন সর্বোত্তম মৃত,
হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির জন্যে বিলাপ কর
প্রচণ্ড দুঃখ- বেদনা সহকারে মুহাম্মাদ আল-মুসতাফার
স্মেরণে বিলাপ কর। যে দুঃখ-বেদনা অন্তরে মিলে
মিশে একাকার হয়ে তাকে ঠেস দিয়ে বসানো
রোগগ্র্ত ব্যক্তির মত করে দিয়েছে।
আমার জীবন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল-
যখন তাঁর সেই নির্ধারিত মৃত্যু এসে যায়,
যা একটি মহা সম্মানিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।
তিনি ছিলেন মানু্যের প্রতি কোমল,
দয়ালু ও সর্বোত্তম পথ প্রদর্শক।
জীবন ও মৃত্যু- সর্বাসস্থায় আল্লাহ তাঁর প্রতি সদয় থাকুন
এবং সেই চিরন্তন দিনে আল্লাহ তাঁকে দান করুন জান্নাত।’
- মুহাম্মাদের স্মরণে রচিত আরেকটি শোকগাঁথারঃ [৪]
‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ছিলেন আমাদের আশা-ভরসা।
আপনি ছিলেন আমাদের সাথ সদাচরণকারী এবং ছিলেন না কঠোর।
আপনি ছিলেন দয়ালু, পথের দিশারী ও শিক্ষক।
যে কোন বিলাপকারীর আজ আপনার জন্যে আমার মা, খালা, চাচা, মামা এবং আমার জীবন ও ধন-সম্পদ সবই উৎসর্গ হোক।
মানব জাতির প্রতিপালক যদি আমাদের নবীকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতেন,
আমরা সৌভাগ্যবান হতাম। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্ত তো পূর্বেই হয়ে আছে।
আপনার সম্মানে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি সালাম বর্ষিত হোক!
আর সন্তুষ্টচিত্তে আপনি চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করুন।’
- উহুদের যুদ্ধের সময় হামযার স্মরণে একটি কবিতাও রচনা করেনঃ[২৮]
‘আর আপনার উপর এমন একটি দিন এসেছে
যে দিনের সূর্য অন্ধকার হয়ে গেছে, অথচ তা ছিল আলোকোজ্জ্বল।’
মৃত্যু
সম্পাদনাসাফিয়াহ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব শাসনামলে ২০ হিজরিতে ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে জান্নাতুল বাকিতে মুগীরা ইবন শুবার আঙ্গিনায় অজুখানার পাশে তাকে দাফন করা হয়।[২৯][৩০][৩১]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৭ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ অক্টোবর ২০০৯।
- ↑ ক খ Imamate: The Vicegerency of the Prophet Al-islam.org [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ জুন ২০১৩ তারিখে
- ↑ [হাতজীবুল আসমা‘ ওয়াল লুগাত-১/৩৪৯]।
- ↑ ক খ [শা’ইরাতুল ‘আরাব-২০২-২০৫]।
- ↑ Ibn Hisham note 97.
- ↑ Muhammad ibn Saad, Tabaqat vol. 8.
- ↑ [উসুদুল গাবা-৫/৮৯২]।
- ↑ [উসুদুল গাবা ৫/৪৯২]।
- ↑ [তাহজীবুল আসমা‘ ওয়ললুগাত-১/৩৪৯]।
- ↑ Al-Tabari, Tarikh al-Rusul wa'l-Muluk vol. 39.
- ↑ ক খ Bewley/Saad vol. 8 p. 29.
- ↑ [তাবাকাত-৮]।
- ↑ [সীরাতু ইবন হিশাম-২/২২৮]।
- ↑ [আল-বিদায়া-৪/১০৮]।
- ↑ [আল-আগানী-৪/১৬৪]।
- ↑ [কানযুল ‘উম্মাল-৭/৯৯]।
- ↑ ক খ [তাবাকাত-৮/৪১]।
- ↑ [উসুদুল গাবা-৫/৪৯২]।
- ↑ ক খ [তাবাকাত-৮/৪২]।
- ↑ "Becons of light on al-shia.org"। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৫।
- ↑ Muhammad ibn Saad, Tabaqat vol. 3.
- ↑ Bewley/Saad vol. 3 p. 76.
- ↑ [সিয়ারু আলাম আনা-নুবালা-১/৪৫]।
- ↑ [নিসা’ মিন ‘আসরিন নুবুওয়াহ্-৪১৯]।
- ↑ [দ্রষ্টব্য :সীরাত ইবন হিশাম- ১/১৬৯-১৭৪]।
- ↑ [সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/২৭১]।
- ↑ [দ্রষ্টব্য : হায়াতুস সাহাবা-৩/৩৪৭-৩৪৮]।
- ↑ :[আল-ইসাবা-৪/৩৪৯]।
- ↑ Bewley/Saad vol. 8 p. 30.
- ↑ [প্রাগুক্ত-৮/৪২]।
- ↑ [তাহজীবুল আসমা’ ওয়াললুগাত-১/৩৪৯]।
বহি:সংযোগ
সম্পাদনা- Yazehra.com ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে