আব্দুল মুত্তালিব বা শায়বা ইবনে হাশিম ছিলেন নবী মুহাম্মদ সা. এর পিতামহ[১] এবং তিনি কুরাইশ বংশের একজন নেতা এবং পবিত্র কাবা ঘরের রক্ষক ছিলেন। পিতা মাতার মৃত্যুর পর তিনিই শিশু মুহাম্মদ (সা.)–কে লালন পালন করেন। মুহাম্মদ (সা.) দশ বছর বয়সী থাকাকালীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আব্দুল মুত্তালিব
عَبْد ٱلْمُطَّلِب
কুরাইশ বংশের ৪র্থ নেতৃস্থানীয়
গোত্রীয় প্রধান৪৯৭-৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বসূরিহাশিম ইবনে আবদ মানাফ
উত্তরসূরিআবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিব
জন্মশায়বা ইবনে হাশিম
৪৯৭ খ্রিস্টাব্দ
ইয়াসরিব, হিজাজ
(present-day মদীনা, সৌদি আরব)
মৃত্যু৫৭৯ (বয়স ৮১–৮২)
মক্কা, হিজাজ
(present-day সৌদি আরব)
সমাধি
দাম্পত্য সঙ্গী
বংশধর
Arabicعَبْد ٱلْمُطَّلِب شَيْبَة ٱبْن هَاشِم
TribeBanu Hashim
পিতাHashim (Son of Abd Munaf)

বনু আবদে মান্নাফ এবং বনু আবদুদ দায়ের মধ্যে পদমর্যাদা বণ্টনের ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছিল। এই সমঝোতার প্রেক্ষিতে আবদে মান্নাফের বংশধররা হাজীদের পানি পান করানো এবং মেহমানদের আতিথেয়তার মেজবানি লাভ করেন। হাশেম বিশিষ্ট সম্মানিত এবং সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মক্কার হাজীদের সুরুয়া রুটি খাওয়ানের প্রথা চালু করেন। তার প্রকৃত নাম ছিল আমর কিন্তু রুটি ছিড়ে সুরুয়ায় ভেজানোর কারণে তাকে বলা হতো হাশেম। হাশেম অর্থ হচ্ছে যিনি ভাঙ্গেন। হাশেমই প্রথম মানুষ যিনি কোরাইশদের গ্রীষ্ম এবং শীতে দুবার বাণিজ্যিক সফরের ব্যবস্থা করেন। তার প্রশংসা করে কবি লিখেছেন, তিনি সেই আমর যিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত দুর্বল স্বজাতিকে মক্কায় রুটি ভেঙ্গে ছিঁড়ে সুরুয়ায় ভিজিয়ে খাইয়েছিলেন এবং শীত ও গ্রীষ্মে সফরের ব্যবস্থা করেছেন।

হাশেম বা আমরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই যে, তিনি ব্যবসার জন্য সিরিয়া সফরে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পথে মদিনায় পৌছে বনি নাজ্জার গোত্রের সালমা বিনতে আমরের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। গর্ভবতী হওয়ার পর স্ত্রীকে পিত্রালয়ে রেখে তিনি সিরিয়ায় রওয়ানা হন। ফিলিস্তিনের গাযা শহরে গিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে সালমার গর্ভ থেকে একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। এটা ৪৯৭ ঈসায়ী সালের ঘটনা। শিশুর মাথার চুলে ছিল শুভ্রতার ছাপ, এ কারণে সালমা তার নাম রাখেন শায়বা (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড. পৃ-১৩৭, রহমাতুললিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ.২৬, ২য় খন্ড পৃ-২৪)। ইয়াসরিব বা মদিনায় সালমা তার পিত্রালয়েই সন্তানের প্রতিপালন করেন। পরবর্তীকালে এই শিশুই আব্দুল মোত্তালিব নামে পরিচিত হন। দীর্ঘকাল যাবত হাশেমী বংশের লোকেরা এ শিশুর সন্তান পায়নি। হাশেমের মোট চার পুত্র পাঁচ কন্যা ছিল। এদের নাম নিম্নরূপ: আসাদ, আবু সায়ফি, নাযলা, আবদুল মোত্তালেব। কন্যাদের নাম, শাফা, খালেদা, যঈফা, রোকাইয়া এবং যিন্নাত। (ঐ ১ম খন্ড, পৃ-১০৭)।


পানি পান করানো এবং মেহমানদারী করার দায়িত্ব হাশেমের পর তার ভাই মোত্তালেব পেয়েছিলেন। তিনিও ছিলেন তার পরিবার ও কওমের অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন। তিনি কোন কথা বললে সে কথা কেউ উপেক্ষা করতো না। দানশীলতার কারণে কোরাইশরা তাকে ফাইয়ায উপাধি দিয়েছিলেন। শায়বা অর্থাৎ আব্দুল মুত্তালিব এর বয়স যখন দশ-বারো বছর হয়েছিল তখন মোত্তালেব তার খবর পেয়েছিলেন। তিনি শায়বাকে নিয়ে আসার জন্য মদিনায় গিয়েছিলেন। মদিনায় অর্থাৎ ইয়াসরেবের কাছাকাছি পৌছার পর শায়বার প্রতি তাকালে তার দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এরপর নিজের উটের পেছনে বসিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। কিন্তু শায়বা তার মায়ের  অনুমতি না নিয়ে মক্কায় যেতে অস্বীকার করলেন। মোত্তালেব যখন শায়বার মায়ের কাছে অনুমতি চাইলেন তখন শায়বার মা সালমা অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন। মোত্তালেব বললেন  ওতো তার পিতার হুকুমত এবং আল্লাহর ঘরের দিকে যাচ্ছে। একথা বলার পর সালমা অনুমতি দিলেন। মোত্তালেব তাকে নিজের উটের পেছনে বসিয়ে মক্কায় নিয়ে এলেন। মক্কায় নিয়ে আসার পর প্রথমে যারা দেখলো তারা নিজেদের মধ্যে বলতে লাগলো, এ বালকতো 'আব্দুল মুত্তালিব ' মুত্তালিব এর দাস। মুত্তালিব বললেন, না,না,এটা আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, হাশেমের ছেলে। এরপর থেকে শায়বাহ মোত্তালেবের কাছে বড় হতে থাকেন এবং এক সময় যুবক হন। পরবর্তীকালে মোত্তালেব ইয়েমেনে মারা যায়। তার পরিত্যক্ত পদমর্যাদা শায়বাহ লাভ করেন। আব্দুল মোত্তালেব তার স্বজাতীয়দের মধ্যে এতো বেশি সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছিলেন যে, ইতিপূর্বে অন্য কেউ এতোটা সম্মান লাভে সক্ষম হয়নি। স্বজাতির লোকেরা তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো এবং তাকে অভূতপূর্ব সম্মান দিতো। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৩৭-১৩৮)

মোত্তালেবের মৃত্যুর পর নওফেল আবদুল মোত্তালেবের কিছু জমি জোর করে দখল করে নেই। আব্দুল মোত্তালেব কোরাইশ বংশের কয়েকজন লোকের সাহায্য জান। কিন্তু তারা এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করেন যে, আপন চাচার বিরুদ্ধে আমরা আপনার পাশে দাঁড়াতে পারব না। অবশেষ আব্দুল মোত্তালেব বনি নাজ্জার গোত্রে তার মামার কাছে কয়েকটি কবিতা লেখে পাঠান। সেই কবিতায় সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছিল। জবাবে তার মামা আবু সা'দ বিন আদী আশি জন অশ্বারোহী সঙ্গে নিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং মক্কার নিকটবর্তী আবতাহ নামক জায়গায় অবতরণ করেন। আবদুল মুত্তালিব তাঁকে ঘরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আবু সা'দ বললেন, না, আমি আগে নওফেলের সাথে দেখা করতে চাই। এরপর আবু সা'দ নওফেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নওফেল সে সময় মক্কার কয়েকজন বিশিষ্ট কোরাইশ এর সাথে বসে কথা বলছিলেন। আবু সা'দ তলোয়ার কোষমুক্ত করে বললেন, এই ঘরের প্রভুর শপথ, যদি তুমি আমার ভাগ্নের জমি ফিরিয়ে না দাও তবে এই তলোয়ার তোমার দেহে ঢুকিয়ে দেব। নওফেল বললেন, আচ্ছা নাও, আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি। আবু সা'দ কোরাইশ নেতৃবৃন্দকে সাক্ষী রেখে আব্দুল মুত্তালিবকে তার জমি ফিরিয়ে দিলেন। এরপর আবু সা'দ আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে গেলেন এবং সেখানে তিনদিন অবস্থানের পর ওমরাহ পালন করে মদিনায় ফিরে গেলেন।

এর পর নওফেল বনি হাশেমের বিরুদ্ধে বানি আবদে শাসমের সাথে সহায়তার অঙ্গীকার করলো।

এদিকে বনু খোজায়া গোত্র লক্ষ করলো যে, বানু নাজ্জার আবদুল মুত্তালিবকে এভাবে সাহায্য করলো, তখন তারা বলল, আবদুল মোত্তালিব তোমাদের যেমন তেমনি আমাদেরও সন্তান। কাজেই আমাদের ওপর তার সাহায্য করার অধিক অধিকার রয়েছে। এর কারণ ছিল এই যে, আবদে মান্নাফের মা বনু  খোজায়া গোত্রের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এ কারণে বানু খোজায়া দারুন নাদওয়ায় গিয়ে বানু আবদে শামস এবং বানু নওফেলের বিরুদ্ধে বানু হাশেমের নিকট সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলো। এই প্রতিশ্রুতিই পরবর্তী সময়ে ইসলামী যুগে মক্কা বিজয়ের কারণ হয়েছিল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পরে উল্লেখ করো হবে। (মুখতাছার সীরাতে রাসূল, শায়খুল ইসলাম মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ-৪১-৪২)

কাবাঘরের সাথে সম্পর্কিত থাকার কারণে আবদুল মোত্তালিবের সাথে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। একটি যমযম কুপ খনন অন্যটি হাতী যুদ্ধের ঘটনা।

স্ত্রী ও সন্তান সম্পাদনা

আবদুল মুত্তালিবের দশজন ছেলে এবং ছয়জন কন্যা সন্তান ছিল।[২] আবদুল মোত্তালেবের পুত্র দশজনের নাম ছিল হারেস, যোবায়ের, আবু তালেব, আবদুল্লাহ, হামযা, আবু লাহাব, গাইদাক, মাকহুম, সাফার এবং আব্বাস। কেউ কেউ বলেছেন, এগারোজন। একজনের নাম ছিল কাছাম। কেউ বলেছেন, তেরোজন। একজনের নাম ছিল আবদুল কাবা অন্যজনের নাম ছিল হোজাল। যারা দশজন পুত্র বলে উল্লেখ করেছেন তারা বলেন, মুকাওআমের আরেক নাম ছিল আবদুল কাবা আর গাইদাকের আরেক নাম ছিল হোজাল। কাছাম নামে আবদুর মোত্তালেবের কোন পুত্র ছিল না। আবদুল মোত্তালেবের কন্যা ছিল ছয়জন।  তাদের নাম উম্মুল হাকিম, এর অন্য নাম ছিল বায়যা, বাররা , আতিকা, সাফিয়া, আরোয়া, উমাইমা।[৩]

নবীজীর পিতামহ আব্দুল মুত্তালিব মোট ছয়টি বিবাহ করেছিলেন। ছয় স্ত্রীর ঘরে সন্তানের সংখ্যা ছিল-২১ জন। যথাক্রমে-

  • ১ম স্ত্রী: সাফিয়্যা বিনতে জুয়াইনদর। ১ম স্ত্রীর ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন একমাত্র পুত্র হারেস। 
  • ২য় স্ত্রী: ফাতেমা বিনতে আমর ইবনুল আয়েয। ২য় স্ত্রীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ৪ পুত্র-যুবায়র, আবু তালেব, আবদুল কা’বা, আবদুল্লাহ এবং ৬ কন্যা-উম্মে হাকীম, বাইযা, উমাইমা, আরওয়া, বাররা ও আতিকা। 
  • ৩য় স্ত্রী: ৩য় স্ত্রী ছিলেন লুবনা বিনতে হাজের। এ ঘরে জন্মগহণ করেছিলেন একমাত্র পুত্র আবদুল উজ্জা। পবিত্র কোরানে যাকে লাহাব নামে অভিহিত করা হয়।
  • ৪র্থ স্ত্রী: হালা বিনতে ওয়ামীর ইবনে আবদে মানাফ। তিনি ছিলেন চার পুত্র সন্তানের জননী। পুত্রগণের নাম ছিল-মুকাওয়াম, হাজাল, মুগীরা ও হামযা।
  • ৫ম স্ত্রী: তামীলা বিনতে খাইয়াব বিন কুলাইব ছিলেন ৫ম স্ত্রী। ৫ম স্ত্রীর গর্ভে যেরার, কাসাম ও আব্বাস নামে তিন পুত্র জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।
  • ৬ষ্ঠ স্ত্রী: ৬ষ্ঠ স্ত্রীর নাম ছিল মুনিমা বিনতে আমর ইবনে মালেক। তিনি ছিলেন গাইদাক্ব ও মাস্আব নামে দুই পুত্রের জননী।[৪]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. The correct form of the name is with two T's (Ta's) and one l (Lam). Thus for instance in Ibn Mākūlā's work: Al-Ikmāl fī Raf' al-Irtiyāb 'an al-Mu'talif wa al-Mukhtalif fi al-Asmā' wa al-Kunā Wa al-Ansāb. vol. 7. pg. 200. Quote: And as for Muṭallib it is with Ḑammah (u) of the Mīm, and Tashdīd (doubling) of the Ṭā' ; and there is a group of them (i.e people called by this name)".
  2. Abdulmalak ibn Hisham, Notes to Ibn Ishaq's Biography of Allah's Messenger, note 97.
  3. তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৮, ৯, রহমাতুল লিল আলামিন ২য় খন্ড, পৃ-৫৬, ৬৬
  4. তাবাকাতে ইবনে সা`দ : ১/৩১, সীরাতে মুস্তফা ১ম খন্ড

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা