সন্ত চরণদাস অষ্টাদশ শতাব্দীতে দিল্লির একজন প্রধান হিন্দু ধর্মীয় গুরু ছিলেন।[১] ইনি সমন্বয়াত্বক দৃষ্টিতে যোগসাধনার সাথে ভক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

সন্ত চরণদাসের মূর্তি, চরণদাস মন্দির, পুরাতন দিল্লি।

জীবনী সম্পাদনা

চরণদাস (১৭০৩-১৭৮২) রাজস্থানের আলবর-এর কাছে, দেহরায় চ্যবনগোত্রীয় ভৃগুবংশীয় এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শ্রী মুরলীধর দাস এবং মাতার নাম কুঞ্জো দেবীথা। তার পূর্বপুরুষ শ্রী শোভনদাসের ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে শ্রীযুগলদেবতা চরণদাস নামে জন্মগ্রহণের বর প্রদান করেন। তাই তার অনুসারীরা তাকে বিষ্ণুর অংশ বলেন। সাত বছর বয়সে তাকে তার পিতার মৃত্যুর পর দেহলীতে আনা হয়। কথিত আছে যে তার গুরু ছিলেন জীবন্মুক্ত শুকদেব যিনি ভাগবত পুরাণ বর্ণনা করেছিলেন। তিনি ১৭৫৩ সালে চরণদাসী বৈষ্ণব সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন।[২] তার অনুগামীরা তাকে মধ্যজীবনে ব্রজে তীর্থযাত্রা করার সময় কৃষ্ণের দর্শনের সাথে সাথে শুকদেবের সাথে একই সময়ে পুনরায় সাক্ষাতের কৃতিত্ব দেন।< ref name=Gold />

সন্ত চরণদাসের শৈশব নাম ছিল রণজিৎ । শিশু রণজিৎকে তার পাঁচ বছরের অল্প বয়সে গ্রামের বাইরে নদীর তীরে শ্রীশুকদেব মুনি দর্শন দিয়েছিলেন। অল্প বয়সে তিনি তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। যেস্থানে শ্রীশুকদেব গোস্বামী পরীক্ষিৎকে ভাগবত পুরাণ বর্ণনা করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয় সেই শুকতাল নামক তীর্থে শ্রীগঙ্গার তীরে শুকদেব মুনি তাকে পুনরায় দর্শন দান করে গুরুদীক্ষা প্রদান করেন এবং তার নাম রাখেন শ্রীশ্যামচরণ দাস। তারপরে তিনি পুরাতন দিল্লীতে এসে বাস করতে থাকেন এবং ১৪ বছর পর্যন্ত ভক্তি ও তপস্যা করেন। পুনঃ তিনি শ্রীবৃন্দাবনে যান যেখানে শ্রীরাধা কৃষ্ণ যুগল তাকে দর্শন দেন এবং দেশে ভক্তি প্রচার করতে বলেন।

সন্ত চরণদাস আবার দিল্লী এসে বাস করতে থাকেন এবং তার ভক্তিতপ দ্বারা মানুষের কষ্ট দূর করতে থাকেন। তার খ্যাতি শুনে দিল্লীর তৎকালীন বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ তার কাছে আসতে থাকেন ও শিক্ষা গ্রহণ করেন। সন্ত চরণ দাস ছয় মাস পূর্বেই ইরান থেকে নাদিরশাহের দিল্লী আক্রমণের ভবিষ্যৎবাণী মুহাম্মদশাহকে লিখিত রূপে দিয়েছিলেন। নাদিরশাহও দিল্লি লুণ্ঠনের সময় চরণদাসের মুখোমুখি হন । সন্তের তেজের সম্মুখে নাদিরশাহ নতমস্তক হয়ে যান ও তার নির্দেশে নিজদেশ ইরানে প্রত্যাবর্তন করেন। সন্ত চরণদাস কৃষ্ণ-ভক্তির সাথে জীবনের লক্ষ্য সাধনের উদ্দেশ্য অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনার প্রচার শুরু করেন। ৭৯ বছর বয়সে ১৭৮২ সালে চরণদাসজী সমাধিস্থ হন। তার সমাধি দিল্লিতে অবস্থিত। দিল্লির জামে মসজিদের নিকটে তার আখড়া তার কথিত অনুশাসন অনুসারে সক্রিয় আছে। হাজারো যোগ অনুসারী আজও তার কথিত মার্গ অনুযায়ী সাধনরত। তাদের বৈষ্ণব মত শুকসম্প্রদায়ের শতাধিক শাখা সমগ্র ভারতবর্ষে স্থাপিত।

কৃতিত্ব সম্পাদনা

চরণদাস প্রায় বিশটি গ্রন্থের রচয়িতা।[৩] এর মধ্যে ভক্তি সম্পর্কিত অনেক গ্রন্থ বা শ্লোক আছে এবং তা বিশেষ করে কৃষ্ণের উপাসনার সাথে সম্পর্কিত৷ [৪]

তিনি বিভিন্ন উপনিষদ বিশেষ করে কঠ উপনিষদ এবং প্রাণায়ামাদি যোগচর্চার উপর মন্তব্য করেছেন [৪] এবং [৫]

রহস্যময় সন্ত ঐতিহ্যের সদস্য [৬] চরণদাসের শিক্ষাসমূহ বিস্তৃত সূত্রসমন্বিত এবং প্রতিটি ব্যক্তির কাছে ঈশ্বরের নৈকট্য, গুরু অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।

চরণতদাসের রচিত গ্রন্থ হতে ১৭টি লঘু গ্রন্থ পাওয়া যায়। এসব গ্রন্থে হঠযোগ, রাজযোগ, মন্ত্রযোগ এবং লয়যোগ অর্থাৎ যোগ চতুষ্টয়ের সকল সাধনার সমীক্ষাত্বক সারভাব বর্ণনা করা হয়েছে। এই ১৭টি গ্রন্থের মধ্যে আছে-

  • ভক্তিসাগর
  • অষ্টাঙ্গযোগ
  • ষট্‌কর্ম হঠযোগবর্ণন

অষ্টাঙ্গযোগ এবং ষট্‌কর্ম হঠযোগবর্ণন গ্রন্থ প্রশ্নোত্তর শৈলীতে রচিত। অষ্টাঙ্গযোগে ১৫৩টি দোহা ও অষ্টপদী ছন্দে গুরু-শিষ্য সংবাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকার ষট্‌কর্ম হঠযোগ গ্রন্থও সাকুল্যে ৪১টি দোহা ও অষ্টপদী ছন্দ রূপে গুরু-শিষ্য সংলাপ শৈলিতে পরিবেশন করা হয়েছে। গ্রন্থে চরণদাসের সাধনানুভূতি সাধকের নিকট গ্রন্থের গুরুত্ব স্বতঃই বৃদ্ধি করে।

অষ্টাঙ্গযোগ গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পাদনা

অষ্টাঙ্গযোগ গ্রন্থে শিষ্যের জিজ্ঞাসার সমাধান গুরুবচন দ্বারা প্রদত্ত সংলাপ শৈলিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। শিষ্যের প্রশ্ন এভাবে শুরু হয়, আমি যোগসাধনায় সম্পূর্ণ অজ্ঞানী, কৃপা করে আমায় যোগের আটটি অঙ্গ সম্পর্কে অবগত করুন ও তার সাধন (অভ্যাসের বিধি) বলুন। এও স্পষ্ট করুন 'অষ্টাঙ্গযোগ' কেন বলা হয়। গুরু বন্দনার পর শিষ্যের এই প্রশ্নের উত্তরে চরণদাস গুরুবচন রূপে অষ্টাঙ্গযোগ ও তৎসম্পর্কিত পৃথক-পৃথক অঙ্গের সাধন বিধি বর্ণনার আশ্বাস এই ভিত্তিতে দেন যে, প্রথমে সাধককে যোগসাধনা সম্বন্ধে অনুধাবন করতে হলে সংযম পালন করতে হয় যার দ্বারা বাধাহীনভাবে যোগ অভ্যাস করা যায়।

এস্থলে 'গুরুবচন' থেকে এও ধ্বনিত হয় যে, যোগ 'বোঝার বিষয়' নয়। এটি অভ্যাসের সোপান এবং 'হওয়ার বিষয়'। অর্থাৎ যোগ অনুধাবন করে যোগী হওয়া যায় না, যোগাভ্যাস করে (সাধনা দ্বারাই) যোগী হওয়া যায়। যোগ হচ্ছে ক্রিয়াপরক ধাতু।

সংযম সাধনার চরণদাস দ্বারা প্রদত্ত এটি নতুন প্রস্তুতিকরণ যা তার ব্যাবহারিক মৌলিকতার অকৃত্রিম উদাহরণ। এখানে এও জানা আবশ্যক যে, পূর্বের যোগ গ্রন্থে যোগ সাধনার আরম্ভ যম দিয়ে শুরু হয় যা চরণদাসের সময়ে সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের হেতু যোগ সাধনার ক্রমে সংযম হতে ব্যাবহারিক স্বীকার করা হয়। কেননা তার সময় পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবন চর্যা ইত্যাদিতে বহু পরিবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়, মানুষ সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের হেতু দৈনিক জীবনচর্যার মূল্য বিস্মৃত হয়েছিল। যাই হোক, চরণদাস দ্বারা প্রতি পদে সংযমের আবশ্যকতা যোগ সাধকদের নিকট বর্তমানে অপরিহার্য বিষয় রূপে স্থান পেয়েছে।

শিষ্য প্রশ্ন ও গুরুর বচন (উত্তর) রূপে চরণদাস অষ্টাঙ্গযোগের এই ক্রম নিম্নাঙ্কিত করেছে -

অষ্টাঙ্গযোগ :- (১) যম (২) নিয়ম (৩) আসন (৪) প্রাণায়াম (৫) প্রত্যাহার (৬) ধারণা (৭) ধ্যান (৮) সমাধি।
ষট্‌কর্ম :- ১) নেতি (সূত্রনেতি) ২) ধৌতি ৩) বস্তি ৪) কুঞ্জল (গজকরণী) ৫) নোলি ৬) ত্রাটক।

অষ্টাঙ্গযোগ গ্রন্থের আরম্ভের ভাগ নিচে দেওয়া হয়েছে-

শিষ্যবচন

ব্যাসপুত্র ধনি ধনি তুম্‌হি, ধনি ধনি যহ অস্থান। মম আশা পূরী করী, ধনি ধনি বহ ভগবান ॥ ১
তুম দর্শন দূর্‌লভ মহা, ভয়ে জু মোকো আজ। চরণ লগো আপা দিয়ো, ভয়ে জু পূরণ কাজ॥ ২
চরণদাস অপনো কিয়ো, চরণন লিয়ো লগায়। শিরকরধরিসবকছুদিয়ো, ভক্তি দইই সমুঝায়॥ ৩
বালপনে দরশন দিয়ে, তবহী সব কুছ দীন। বীজ জু বোয়া ভক্তিকা, অব ভয়া বৃক্ষ নবীন॥ ৪
দিন দির বড়তা জায়েগা, তুম কিরণা কে নীর। জব লগমালী না মিলা, তবলগ হুতা অধীর॥ ৫
অরু সমুঝায়ে যোগহী, বহু ভাঁতি বহু অঙ্গ। উর্ধরেতা হী কহী, জীতর বিদ অনঙ্গ॥ ৬
অরু আসর সিখলাইয়া, তিনকী সারী বিদ্ধি॥ তুম্‌হরি কৃপা সো হোহিঙ্গে, সবহীসাধন সিদ্ধি॥ ৭
এক অভিলাষা ঔর হ্যায়, কহি ন সঙ্কু সকুচায়। হিয়ে উঠ্যায় মুখ আয়করি, ফিরি উলটি হী জায়॥ ৮

গুরুবচন

সৎগুরু সে নহি সকুচিয়ে, এহো চরণহি দাস। জো অভিলাষা মন বিষে, খোলি কহৌ অব তাস॥ ৯

শিষ্যবচন

সৎগুরু তুম আজ্ঞা দই, কহুঁ আপনী বাত। যোগঅষ্টাঙ্গ বুঝাইয়ে, জাতে হিয়ো সিরাত॥ ১০
মোহি যোগ বতলাইয়ে, জোহ্যায় ওয়হ অঙ্গাঙ্গ। রহনীগহনী বিধিসহিত, জাকে আঠো আঙ্গ॥ ১১
মত মারগ দেখে ঘনে,হুা সিয়রে ভয়ে প্রাণ। জো কুছ চাহৌ তুম করৌ, ম্যায় হৌ নিপট অয়ান॥ ১২

গুরুবচন

যোগ অষ্টাঙ্গ বুঝাইহ্যায়, ভিন্ন সব অঙ্গ। পহিলে সংযম সীখিয়ে, জাতে হোয় ন ভঙ্গ॥ ১৩

শিষ্যবচন

সংযম কাকো কহন হ হ্যায়, কহৌ গুরু শুকদেব। সো সবহী সমুঝাইয়ে, তাকী পাবৈ ভেব॥ ১৪

গুরুবচন

প্রথম সূক্ষ্ম ভোজন খাবৈ। ক্ষুধা মিটৈ নহি আলস আবৈ॥
থোড়াসা জল পীবন লীজৈ। সূক্ষ্ম বোলৈ বাদ ন কীজৈ॥
বহুত নীন্দ ভর সোবৈ নহী। দূজা পুরুষ ন রাখৈ পাহী॥
খট্টা চরপরা খার ন খাবৈ। বীরজ ক্ষীণ হোন নহী পাবৈ॥ ১৫
করৈ ন কাহু বৈরী মীতা। জগবস্তু কী রখে ন চীতা॥
নিশ্চল হবে মনকো ঠহরাবৈ। ইন্দ্রিন কে রস সব বিসরাবৈ॥
তিরয়া তেল নাহি দেজ ছুবায়ৈ। অষ্ট সুগন্ধ অঙ্গ নহি লাবৈ॥
পুরুষন কী রাখৈ নহি আসা। গুরুকা রহে চরণহী দাসা॥ ১৬
কাম ক্রোধ মদ লোভ অরূ রাখৈ না অভিমান।
রহৈ দীনতাই লিয়ে, লগৈ ন মায়া বান॥ ১৭

সন্ত চরণদাসের বাণী নিম্নলিখিত ১৭ গ্রন্থে বিস্তৃত যা শ্রীখেম্রাজ শ্রীকৃষ্ণদাস প্রকাশন, মুম্বাই থেকে ভক্তিসাগরাদি ১৭ গ্রন্থের নামে প্রকাশিত হয়েছে।

১. ব্রজচরিত্র ২. অমরলোক অখণ্ডধাম বর্ণন ৩. অষ্টাঙ্গযোগ ৪. ষট্‌কর্ম হঠযোগ বর্ণন ৫. যোগসন্দেশ সাগর ৬. জ্ঞানস্বরোদয় ৭. ধর্মজহাজ ৮. ভক্তি পদার্থ ৯. মনবিকৃত করণ গুটকাসার ১০. শ্রীব্রহ্মজ্ঞানসার ১১. শব্দ বর্ণনা ১২. ভক্তিসাগর বর্ণনা এবং আরো কিছু গ্রন্থ।

তাঁর দুই প্রধান নারী শিষ্যা সহজো বাই এবং দয়া বাইও তাদের কাব্যের জন্য বিখ্যাত৷ [৭][৮][৯]

উৎস সম্পাদনা

  1. Gold, D. (১৯৮৭)। The Lord as Guru: Hini Sants in the Northern Indian Tradition। New York: Oxford University Press। 
  2. Maheswari, Hiralal (১৯৮০)। History of Rajasthani Literature। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 131–132। 
  3. Sukla, S (১৯৯৫)। Charandasia Sampraday aur uska Sahitya। Varanasi: Kali Prakasan। পৃষ্ঠা 132–161। 
  4. Charandas (২০০১), Bhaktisagar, Mumbai: Khemraj Srikrishnadas Prakashan 
  5. Charandas, Astangayogavarnan [Astanga Yoga of Saint Charandas], Translated Om Prakash Tiwari (1983), Lonavla: Kaivalyadham Press 
  6. Schomer, K; McLeod, W (১৯৮৭)। The Sants। Delhi: Motilal Banarsidass। 
  7. Bai, Sahjo (২০০১) [1903]। Sahaj Prakash। Harry Aveling; Sudha Joshi কর্তৃক অনূদিত। Delhi: Motilal Banarsidass। Allahabad: Belvedere Press। 
  8. Bai, Daya (২০০৫) [1908], Daya Bai ki Bani [The Songs of Daya Bai], Harry Aveling; Peter Friedlander কর্তৃক অনূদিত, Delhi: Prestige Books, Allahabada, Delhi: Belvedere Press 
  9. McGregor, R.S. (১৯৮৪)। Hindi Literature of the nineteenth and early twentieth centuries (Vol. 8 Part 1)। Verlag: Otto Harrassowitz। 

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  • Charandas (২০১৪), Bhaktipadarth [The Treasury of Devotion], Peter Friedlander; Harry Aveling কর্তৃক অনূদিত, Delhi: Prestige Books 
  • Osho Rajneesh (১৯৭৮), Nahin Sanjh Nahin Bhor, Pune: Rajneesh Foundation 
  • Sahjo Bai (২০০১), Sahaj Prakash [The Brightness of Simplicity], Harry Aveling; Sudha Joshi কর্তৃক অনূদিত, Delhi: Motilal Banarsidass, Allahabad: Belvedere Press