শ্রীমন্ত শঙ্করদেব
শ্রীমন্ত শঙ্করদেব (ইংরেজি: Sankardev; অসমীয়া: শ্রীমন্ত শংকৰদেৱ) একাধারে ধর্মপ্রচারক, কবি, নর্তক, সমাজ সংগঠক, সুগায়ক, অভিনেতা ও চিত্রকর ছিলেন। শ্রীমন্ত শঙ্করদেব অসমীয়া জাতি-সাহিত্য ও সংস্কৃতির নির্মাতা। তিনি নববৈষ্ণব ধর্ম বা একশরন ধর্ম প্রচার করে।[১] সমগ্র অসমীয়া জাতিকে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছেন। অসমীয়া তথা ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিস্ময়কর অবদান রাখার জন্য শঙ্করদেবকে মহাপুরুষ ও অবতারী পুরুষ নামে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
শ্রীমন্ত শঙ্করদেব | |
---|---|
![]() বিষ্ণু প্রসাদ রাভা কর্তৃক অঙ্কিত শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের চিত্র | |
জন্ম | ১৪৪৯ বরদোয়া, নগাঁও, অসম, ভারত |
মৃত্যু | ১৫৬৮ মধুপুর সত্র, ভেলাদংগা, কোচবিহার, ভারত | (বয়স ১১৮–১১৯)
আখ্যা | মহাপুরুষ,জগতগুরু |
প্রতিষ্ঠাতা | এক শরণ নাম ধর্ম (মহাপুরুষীয়া ধর্ম) (নব বৈষ্ণব ধর্ম) |
দর্শন | বৈষ্ণব ধর্ম |
সাহিত্য কর্ম | কীর্তন ঘোষা, বরগীত, অঙ্কীয়া নাট, |
বিশিষ্ট শিষ্য(সমূহ) | মাধবদেব |
জন্মসম্পাদনা
খ্রিষ্টীয় ১৪দশ শতকে গৌড় রাজ্যের রাজা ধর্ম নারায়ণ মিত্র কমতা রাজ্যের রাজা দুর্লভ নারায়ণের দেশে সাতঘড় ব্রাহ্মণ ও সাতঘড় কায়স্থ পাঠান। রাজা দুর্লভ নারায়ণ তাদের অতি স্নেহে নিজের দেশে থাকার পর নগাঁও জেলার বরদোয়া নামক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা আরম্ভ করেন৷
বাল্যকাল ও শিক্ষাসম্পাদনা
বাল্যকালে শঙ্করদেবের মাতা ও পিতৃবিয়োগ হয়। তার ঠাকুরমা খেরসুতি শঙ্করদেবকে লালন পালন করেন। ১২ বৎসর বয়সে শঙ্করদেবকে মহেন্দ্র কন্দলি অধ্যাপকের টোলে নামভর্তি করা হয়।[২] সেই বয়সে স্বরবর্নের ব্যবহার না করে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তি বিষয়ক কবিতা করতল কমল কমল দল নয়ন রচনা করেন। তারপর অধ্যাপক মহেন্দ্র কন্দলি তাকে দেব উপাধি দেন ও শঙ্করদেবকে সেরা ছাত্রে পরিণত করায়। তিনি মহেন্দ্র কন্দলির টোলে ৬বৎসর অধ্যয়ন করে চাঁরটি বেদ, চৌদ্দটি শাস্ত্র, অঠেরটি পুরান, নানান কাব্যগ্রন্থ, সংহিতা, ব্যাকরন, দর্শন ও বিভিন্ন শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠেন। টোলে থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম অনুবাদ স্বরূপ হরিশচন্দ্র উপাখ্যান কবিতা রচনা করেন। ধীর-স্থির ও জ্ঞানী-গুনী ব্যক্তি হয়ে তিনি নিজের পান্ডিত্যের পরিচয় দেন। ১৭ বৎসর বয়সে শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি নিজগৃহে ফিরে আসেন।
কর্মজীবনসম্পাদনা
শিক্ষা সমাপ্ত করে ঘরে আসার পর শঙ্করদেবকে সংসারের দায়িত্ব বহন করিতে হয়েছিল। পিতামহ জয়ন্ত দলৈ শিরোমনি ভূঞার দায়িত্ব শঙ্করদেবকে অর্পণ করেন। তিনি ছোট বয়সে শিরোমনি ভূঞার দায়িত্ব পাওয়ার জন্য তাকে ডেকাগিরি ডাকা হত। শঙ্করদেব এই পদ গ্রহণ করার কিছুদিন পর কছাড়িরা আলি পুকুর অঞ্চলে বসবাসকারী ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের উপর অত্যাচার করা আরম্ভ করেন ফলে শঙ্করদেব তার পরিবার সহ স্থানান্তর হয়ে বরদোয়াতে বসবাস করা আরম্ভ করেন। বরদোয়াতে ঘড় তৈরি করার সময় শঙ্করদেবে রামরাম গুরুর সঙ্গে উক্ত স্থানে মন্দির নির্মাণ করার জন্য আলোচনা করেন। মন্দির নির্মাণের সময় মাটি খোঁড়ে চতুর্ভূজ বিষ্ণুমূর্তি পা্য়। সাতখলপীয়া সিংহাসনের উপর তিনি মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন।
বৈবাহিক জীবনসম্পাদনা
শঙ্করদেব বংশগত হিসেবে পাওয়া শিরোমনি ভূঞার দায়িত্ব ছেড়ে একান্তমনে শাস্ত্রচর্চায় নিয়োজিত হওয়ার মনস্থ করেন। সংসারের প্রতি বিরাগ জন্মানের কথা উপলব্ধি করে শংকদেবের পিতামহ সূর্যবতী ভূঞার সহিত বিবাহ করান। বিবাহের তিন বছর পর সূর্যবতীর গর্ভে শঙ্করদেবের একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। কন্যাটির নাম রাখা হয় মনু। কন্যা সন্তান জন্মের ৯মাস পর সূর্যবতীর অকাল মৃত্যু হয়। পত্নিবিয়োগের পর তিনি কালিকা ভূঞার কন্যা কালিন্দিকে বিবাহ করেন।
তীর্থ ভ্রমণসম্পাদনা
১৪০৩ সক ৩২ বৎসর বয়সে শঙ্করদেব প্রথমবার তীর্থ ভ্রমণ করেন। তার সাথে আরো ১৭জন তীর্থযাত্রী সঙ্গী হন। এদের মধ্যে অধ্যক্ষ মহেন্দ্র কন্দলি, রামরাম, সর্বজয়, পরমানদ, বলোভদ্র, বলোরাম, গোবিন্দ, নারায়ণ, বরশ্রীরাম, গোপাল, চোট বলোরাম, মুকুণ্ড, মুরারি, হরিদাস, দামোদর, ও অন্য দুইজন এই দলের সদস্য ছিলেন। শঙ্করদেব অনুগামীদের সংঙ্গে গঙ্গার স্নান দর্শন থেকে আরম্ভ করে ত্রি জগন্নাথ-পুরী, সীতাকুণ্ড, উত্তর বাহিনী গঙ্গা, বরাহক্ষেত্র, পুষ্করিণী তীর্থ, মথুরা, বৃন্দাবন, দ্বারকা, কাশী, বারানসী, প্রয়াগ, নেপাল, নিষধ, কৈকেয়, কোশল, অযোধ্যা, হস্তিনাপুর, পাঞ্চাল, শ্বেতদ্বীপ, কর্মনাশা কেশরী, কাবেরী, মার্গকাশী, বিন্দুকাশী, কৈশিক তীর্থ, মুকুন্দ আশ্রম, পুষ্পভদ্রা, সোণারু, কপিল, গণ্ডকী নদী, উপদ্বারকা, অঙ্গদ নগর, রামেশ্বর সেতুখণ্ড, সুবাহু নগর, বিদিশা নগর, দণ্ডকা বন, চিত্রকুট পর্বত, গোদাবরী, গোমতী, পঞ্চবটী আশ্রম, দা ঋষ্যমূক পর্বত, কিষ্কিন্ধ্যা, পুষ্করাবতী, ভরদ্বার, হরিদ্বার, জয়দ্বার, নর্মদা, মহানন্দা, কটক নগর, বদরিকাশ্রম ইত্যাদি তীর্থক্ষেত্র ও ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করেন। ১৫৫০ শকের অগ্রহায়ণ মাসে শঙ্করদেব ৯৭ বছর বয়সে সঙ্গী ভক্তদের সঙ্গে পুনরায় তীর্থ ভ্রমণ করেন।