শান্তরক্ষিত
আচার্য শান্তরক্ষিত (সংস্কৃত: शान्तरक्षित) (৭২৫-৭৮৮)[১] অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি স্থাপনের প্রধান রূপকার ছিলেন। তিনি যোগাচার-স্বতন্ত্রিকা-মধ্যমক নামক বৌদ্ধ দর্শনের জনক। এই দর্শন নাগার্জুনের মধ্যমক, অসঙ্গের যোগাচার ও ধর্মকীর্তির প্রমাণের মিলিত রূপ।
জন্ম
সম্পাদনাশান্তরক্ষিতের জন্মস্থান নিয়ে ২০১১ সাল পর্যন্ত পন্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক ছিল।
দেব-থের-স্ন্গোন-পো গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে,[২] আচার্য শান্তরক্ষিত সহোর নামক স্থানের রাজধানী বিক্রমপুরীতে এক সামন্ত রাজ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, সহোর মগধের পূর্ব সীমান্তবর্তী প্রদেশ অঙ্গদেশের পূর্ব প্রান্তের সামন্তরাজ্য ছিল, যা অধুনা ভাগলপুর নামে পরিচিত। [৩]
অন্যদিকে, অধ্যাপক রায়হান রাইন টিবেটোলজিস্ট শরৎচন্দ্র দাসের সূত্র ধরে জানান, যে অতীশ দীপঙ্কর ও শান্তরক্ষিত একই রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতীশ দীপঙ্করের জন্মভূমি বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রাম। যা প্রমাণ করে শান্তরক্ষিতের জন্মস্থান বিক্রমপুর।[৪] এ মতটি বৌদ্ধশাস্ত্র বিশারদ ছুলঠিম জলবা ও অলকা চট্টোপাধ্যায় দ্বারা স্বীকৃত।[৫]
ক্যালগিরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক জেমস বি. অ্যাপলও তার বইতে শান্তরক্ষিতের জন্মস্থান বিক্রমপুর নির্দেশ করেছেন।[৬] ২০১১ সালে খননের মাধ্যমে বিক্রমপুরে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারসমূহ আবিষ্কৃত হলে চীনা ও বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদরা শান্তরক্ষিতের জন্মস্থান বিষয়ে নিশ্চিত হন।[৭]
শিক্ষা
সম্পাদনাতিনি গৃহত্যাগ করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জ্ঞানগর্ভের নিকট মূল সর্বাস্তিবাদী বিনয় অনুসারে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা গ্রহণ করে শান্তরক্ষিত নাম গ্রহণ করেন এবং ত্রিপিটক পাঠ শেষ করেন। এরপর তিনি বোধিসত্ত্ব মার্গীয় মহাযানিক গ্রন্থ অভিসময়ালঙ্কার ইত্যাদি অধ্যয়নের জন্য আচার্য বিনয়সেনের নিকট উপস্থিত হয়ে মহাযান মার্গের বিস্তৃত ও গম্ভীর এই দুই পর্যায়ের অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। এর পর তিনি নাগার্জুনের মাধ্যমিক সিদ্ধান্ত আয়ত্ত করে ঐ বিষয়ের ওপর মধ্যমালঙ্কার নামে গ্রন্থ রচনা করেন।[৩]
তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার
সম্পাদনাতিব্বত সম্রাট স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পোর শাসনকালে তিব্বতে প্রথম বৌদ্ধ ধর্ম প্রবেশ করলেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার শুরু হয় তিব্বত সম্রাট খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সানের রাজত্বকালে।[৮]
প্রথম তিব্বত যাত্রা
সম্পাদনা৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে সম্রাট খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সান বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কোনো ভারতীয় আচার্যকে আনাবার ইচ্ছায় ভারতে দূত পাঠান। দূত প্রথমে বুদ্ধগয়ায় গিয়ে সম্রাটের পক্ষ থেকে মহাবোধির বেদীমূলে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করে নালন্দায় উপস্থিত হন কিন্তু সেখানে জানতে পারেন যে শান্তরক্ষিত বিশেষ কাজে নেপালে গিয়েছেন। তাই দূতও নেপাল গিয়ে আচার্যের কাছে সম্রাটের প্রার্থনা নিবেদন করলে শান্তরক্ষিত রাজি হন ও তাকে মহাসমারোহে লাসা নিয়ে যাওয়া হয়। তার দ্বারা তরুণ সম্রাট প্রভাবিত হলেও কিছু পদস্থ পোন ধর্মাবলম্বী রাজকর্মচারী তার এই জনপ্রিয়তায় অসন্তুষ্ট হয়ে অপপ্রচার শুরু করলে শান্তরক্ষিত বিরক্ত হয়ে নেপাল ফিরে আসেন। [৩]
দ্বিতীয় তিব্বত যাত্রা
সম্পাদনাএর কিছুকাল পরে সম্রাট আবার শান্তরক্ষিতকে তিব্বতে আসার অনুরোধ জানালে তিনি পুনরায় লাসায় পদার্পণ করেন। তার অনুরোধে সম্রাট উড়িষ্যার রাজবংশোদ্ভূত আচার্য পদ্মসম্ভবকে তিব্বতে আসার আমন্ত্রণ জানালে পদ্মসম্ভব তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে সহায়ক হন। এরপর শান্তরক্ষিত লাসা থাকে দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে তিব্বতের প্রাচীণতম বিহার সম-য়ে বৌদ্ধবিহার নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং ৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে এর কাজ সম্পূর্ণ হয় । এর পর তিনি ১২ জন সর্বাস্তিবাদী পন্ডিতকে ভারত থেকে আনান ও তাদের সহায়তায় বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা দান শুরু করেন। তিনি তার শিষ্যদের সাহায্যে বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থকে তিব্বতী ভাষায় ভাষান্তরিত করেন। [৩]
মৃত্যু
সম্পাদনা৭৮৮ সালে সম-য়ে বৌদ্ধ বিহারে ঘোড়সোয়ারী করার সময় ঘোড়ার খুড়ের আঘাতে দুর্ঘটনায় শান্তরক্ষিতের মৃত্যু হয়।[৯] তার দেহাবশেষ সম-য়ে বৌদ্ধ বিহারের অভ্যন্তরে এক চৈত্যের মধ্যে রক্ষিত আছে। [৩]
দর্শন ও রচনা
সম্পাদনাতিনি নাগার্জুনের মধ্যমক, অসঙ্গের যোগাচার ও ধর্মকীর্তির প্রমাণকে একত্র করে মধ্যমাকালঙ্কার নামক গ্রন্থে তার দর্শনের জন্ম দেন। এই গ্রন্থে যোগাচার বিভাগ আলোচনা করতে গিয়ে তিনি সৌত্রান্তিক দর্শনকেও যোগ করেন। এই কারণে পরবর্তী কালের তিব্বতীদের নিকট তার দর্শন যোগাচার-স্বতন্ত্রিকা-মধ্যমক হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি নিজে কোনদিন এই নাম ব্যবহার করেননি। মধ্যমাকালঙ্কার নামক গ্রন্থ ছাড়াও তিনি তত্ত্বসংগ্রহ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থটিতে তৎকালীন সময়কালে প্রচলিত সমস্ত ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে বলা রয়েছে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ stanford.edu: Śāntarakṣita (Stanford Encyclopedia of Philosophy)
- ↑ Shantarakshita (author); Jamgon Ju Mipham Gyatso (commentator); Padmakara Translation Group (translators)(2005). The Adornment of the Middle Way: Shantarakshita's Madhyamakalankara with commentary by Jamgön Mipham. Boston, Massachusetts, USA: Shambhala Publications, Inc. আইএসবিএন ১-৫৯০৩০-২৪১-৯ (alk. paper)
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ তিব্বতে সওয়া বছর - রাহুল সাংকৃত্যায়ন, অনুবাদ - মলয় চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক - চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩, আইএসবিএন ৮১-৮৫৬৯৬-২৭-৬
- ↑ রাইন, রায়হান। আচার্য শান্তরক্ষিতের মধ্যমকালঙ্কার। ঢাকা: বাতিঘর। আইএসবিএন 9789849647720।
- ↑ চট্টোপাধ্যায়, অলকা। অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান। ভারত: অনুষ্টুপ। পৃষ্ঠা ৩৭। আইএসবিএন 9789382425847।
- ↑ Apple, James B. (২০১৯)। Atisha Dipankara। Canada: Shambhala। পৃষ্ঠা 11। আইএসবিএন 1569572127।
- ↑ Unb, Munshiganj (২০১৮-০১-০৬)। "Nateshwar can be world heritage site"। The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৭-০৬।
- ↑ চায়না রেডিও ইন্টারনেশনাল
- ↑ Banerjee, Anukul Chandra। "Acarya Santaraksita" (পিডিএফ)। ৪ মার্চ ২০২৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।
আরো পড়ুন
সম্পাদনা- Banerjee, Anukul Chandra. Acaraya Santaraksita in Bulletin of Tibetology, New Series No. 3, p. 1-5. (1982). Gangtok, Sikkim Research Institute of Tibetology and Other Buddhist Studies. [১]
- Blumenthal, James. The Ornament of the Middle Way: A Study of the Madhyamaka Thought of Shantarakshita. Snow Lion, (2004). আইএসবিএন ১-৫৫৯৩৯-২০৫-৩ - a study and translation of the primary Gelukpa commentary on Shantarakshita's treatise: Gyal-tsab Je's Remembering The Ornament of the Middle Way.
- Doctor, Thomas H. (trans.) Mipham, Jamgon Ju. Speech of Delight: Mipham's Commentary of Shantarakshita's Ornament of the Middle Way. Ithaca: Snow Lion Publications (2004). আইএসবিএন ১-৫৫৯৩৯-২১৭-৭
- Ichigō, Masamichi(ed. & tr.). Madhyamakālaṁkāra of śāntarakṣita with his own commentary of Vṛtti and with the subcommentary or Pañjikā of Kamalaśīla". Kyoto: Buneido (1985).
- Jha, Ganganath (trans.) The Tattvasangraha of Shantaraksita with the Commentary of Kamalashila. 2 volumes. First Edition : Baroda, (G.O.S. No. Lxxxiii) (1939). Reprint ; Motilal Banarsidass, Delhi, (1986).
- Murthy, K. Krishna. Buddhism in Tibet. Sundeep Prakashan (1989) আইএসবিএন ৮১-৮৫০৬৭-১৬-৩.
- Prasad, Hari Shankar (ed.). Santaraksita, His Life and Work. (Collected Articles from "All India Seminar on Acarya Santaraksita" held on August 3–5, 2001 at Namdroling Monastery, Mysore, Karnataka). New Delhi, Tibet House, (2003).
- Phuntsho, Karma. Mipham's Dialectics and Debates on Emptiness: To Be, Not to Be or Neither. London: RoutledgeCurzon (2005) আইএসবিএন ০-৪১৫-৩৫২৫২-৫
- 索达吉堪布. 中观庄严论释 (চীনা)(A Chinese translation of the Mipham's Commentary of Ornament of the Middle Way). online version