শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (ইংরেজি: Shachindranath Bandyopadhyay)(জন্ম-৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ - মৃত্যু - ২৬ মে, ১৯৯৯) একজন কবি, কথা-সাহিত্যিক ও নাট্যকার । [১]
শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় | |
---|---|
জন্ম | ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ |
মৃত্যু | ২৬ মে ১৯৯৯ (বয়স ৭৯) কলকাতা |
মাতৃশিক্ষায়তন | আশুতোষ কলেজ |
পেশা | কবি, কথা-সাহিত্যিক ও নাট্যকার |
দাম্পত্য সঙ্গী | উমা বন্দ্যোপাধ্যায় |
পিতা-মাতা | সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (পিতা) সুরুচি দেবী (মাতা) |
পুরস্কার | বঙ্কিম পুরস্কার |
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনাশচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই সেপ্টেম্বর কলকাতার কালীঘাটের ১০/১০ নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিটের মামার বাডিতে। পিতা সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা সুরুচি দেবী। তার শৈশবের বছর সাতেক কাটে মামার বাড়িতেই। ছোট বেলায় দুরন্ত ছিলেন, লেখাপড়ায় মন ছিল না। তাই দাদামশাই তাঁকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বছর ঘুরতেই দাদু ফিরিয়ে আনলেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে চলে গেলেন পৈতৃক বাড়ি, অবিভক্ত বাংলার তথা অধুনা বাংলাদেশের নড়াইলে। ভর্তি হলেন সেখানকার ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে । প্রসঙ্গত এখানে তার জ্যাঠামশাই প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরাসরি প্রভাব লেখাপড়ার মধ্যে এসেছিল। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে। সেখানে পড়াকালীনই তার ‘জানি জানি আজ আমারে পড়ে না মনে’ লেখা তার লেখা গান, মুগ্ধ করেছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। [২]
আশুতোষ কলেজ থেকে আই.এ. ও পরে বি.এ.পাশ করেন। ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। আর্থিক অনটনের কারণে ইন্ডিয়ান কপার কর্পোরেশনে ইনস্পেক্টরের চাকরি নিয়ে চলে যান ঘাটশিলা। সেখানে তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসেন । তার উৎসাহে, প্রেরণায় সেখানকার পরিবেশ তার কলমে এসেছে। এখানে থাকতে বিভূতিভূষণের ভাগ্নি উমা দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়। ১৯৪৫-এ ‘এম এল ব্যানার্জি অ্যান্ড সন্স’ নামে এক জাহাজ কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে ওয়ালটেয়র চলে যান এবং তার এই যাত্রাও বাংলা সাহিত্যে তৈরি করল নতুন পথ। প্রথম সাগরের হাওয়া এসে লাগল তার সৃষ্ট বাংলা গল্পে। এরপর তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। উপ-অধিকর্তা হিসাবে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়া ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকরঞ্জন শাখার নাট্য পরিচালক হিসাবেও কাজ করেছেন।[১]
সাহিত্যকর্ম
সম্পাদনা১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে যখন শচীন্দ্রনাথ সতেরো বৎসরের কিশোর, তার প্রথম গল্প ‘বুভুক্ষা’ প্রকাশিত হয় 'মানসী' পত্রিকা আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় । কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন । গল্পটি পড়ে তিনি এমন মুগ্ধ হন যে, পকেট থেকে নিজের কলমটি বের করে তার হাতে তুলে দেওয়ার সময় বলেছিলেন -
‘তোমার জীবনে সুখ আসবে, দুঃখ আসবে, কিন্তু এই কলমটি তুমি ছেড়ো না। মনে রেখো, এই কলমের জন্যই তুমি জন্মেছ।’
শরৎচন্দ্রের সেকথা রেখেছেন বলা চলে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় গল্প প্রবন্ধ ও নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন। উমানন্দ ভৈরব, উমা দেবী, শিবানী দেবী, শান্তি ভট্টাচার্য প্রভৃতি ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় রচনা লিখেছেন । পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে যেখানেই গেছেন সেই পরিবেশের সেখানের মানুষের কথা তুলে ধরেছেন তার বিভিন্ন সময়ে লেখার মধ্য দিয়ে । বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে সেগুলি অমূল্য রত্ন সম্পদ। জাহাজে চাকরির দৌলতে মানুষের যে বিচিত্র জীবনকথার উপাদান তিনি পেয়েছিলেন তাই নিয়ে লিখেছিলেন 'সিন্দুর টিপ', 'ডোডো পাখির নিজের দেশ' প্রভৃতি বহু উপন্যাস ও গল্প। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি লেখেন প্রথম নাটক ‘উত্তরাধিকার’। সে বছরই কলকাতার বালিগঞ্জ শিল্পী সঙ্ঘের উদ্যোগে তা মঞ্চস্থও হয়।১৯৪৪-৪৫ খ্রিস্টাব্দে লেখেন প্রথম উপন্যাস ‘এ জন্মের ইতিহাস’। সরোজকুমার রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘বর্তমান’ পত্রিকায় ১৯৪৯ সালে তা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। দেবদাসীদের কাহিনী অবলম্বনে রচিত উপন্যাস 'জনপদবধূ' এবং এটি দীর্ঘ কাল মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতার বিশ্বরূপা, স্টার বা রঙমহলে। ‘এই তীর্থ’ উপন্যাস থেকে হয়েছে ‘জীবন সংগীত’ চলচ্চিত্র। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘মার্কো’, ‘মেমোরিয়ালের পরী’, ‘বিভূতিভূষণের মৃত্যু’, ‘চন্দ্রলোক থেকে আসছি’ -র মতো গল্প, ‘ক্রৌঞ্চদ্বীপের ফকির’ উপন্যাস। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল -
রচনাসম্ভার
সম্পাদনা- অপরিচিতের নাম
- অভিমানী আন্দামান
- আনন্দ ভৈরবী
- উত্তরাধিকার
- এ জন্মের ইতিহাস
- এই তীর্থ
- এক আশ্চর্য মেয়ে
- একটি রঙ করা মুখ
- কত আলোর সঙ্গ
- কর্নাটরাগ
- কৃষ্ণপক্ষের আলো
- ছায়াসঙ্গিনী
- জনপদবধূ
- জলকন্যা
- ঢেউ ওঠে পড়ে
- তারুণ্যের কাল
- তীরভূমি
- তোমার পতাকা
- দুই নদী
- দেবকন্যা
- দ্বিতীয় অন্তর
- নগরনন্দিনীর রূপকথা
- নগ্নদ্বীপ
- নতুন নাম নতুন ঘর
- নয়ানজুলি
- নিধুবাবুর টপ্পা
- নীলসিন্ধু
- নীলাঞ্জনছায়া
- পথ
- পত্রলেখার উপাখ্যান
- প্রজন্মের ইতিহাস
- বন্দরে বন্দরে
- বিদিশার নিশা
- মধ্যদিনের গান
- শান্তির স্বাক্ষর
- শ্বেত কপোত
- সাক্ষী বালুচর
- সিন্দুর টিপ
- সীমান্তশিবির
- সূর্যের সন্তান
- স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
- স্বপ্ন সঞ্চার
- স্বাতীনক্ষত্রের জল
- মাস্তুল
সম্মাননা
সম্পাদনা১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে'বন্দরে বন্দরে’ উপন্যাসের জন্য বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত করে ।
শেষ জীবন ও মৃত্যু
সম্পাদনারাজ্য সরকারের চাকরি হতে অবসরের পর তার শেষ জীবন কাটে কলকাতার চেতলার মহেশচন্দ্র দত্ত লেনের বাড়ি "তীরভূমি" তে। সেখানেই তিনি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে মে প্রয়াত হন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯, পৃষ্ঠা ৩৭১, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
- ↑ ক খ "শরৎচন্দ্র নিজের কলম উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে"। anandabazar.com। ৩ জুন ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০২০।