লোকসেবক সংঘ

(লোকসেবক সঙ্ঘ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

লোকসেবক সঙ্ঘ বা লোকসেবক সংঘ মানভূমে বাংলা ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার দাবিতে সোচ্চার হওয়া মানুষের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক দল।[১] মানভূমে বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯১২ সালে শুরু হয় এবং ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ভাষা আন্দোলন তীব্র ভাবে মানভূমের বাঙালিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় বাংলা ভাষার দাবিতে কংগ্রেস সদর্থক ইচ্ছা প্রকাশ না করায় মানভূমবাসীরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে অতুলচন্দ্র ঘোষ , অরুণ চন্দ্র ঘোষ[২], লাবন্যপ্রভা, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন এবং গুণেন্দ্রনাথ রায় সহ আরও অনেক কংগ্রেস কর্মীদের হাত ধরে এই দল গঠন হয়।[৩][৪]

প্রেক্ষাপট সম্পাদনা

ভারতের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বিহারে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয় এবং বিহার সরকার উগ্র হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী কর্মধারা গ্রহণ করে।[৫][৬] অন্যদিকে বাংলাভাষাকে দমন করার জন্য নিত্য নুতন কৌশল অবলম্বন করে। মানভূমের কংগ্রেস কমিটি উগ্র ভাষানীতির প্রতিবাদ করলেও বিহার সরকার কর্নপাত করেনি। তখন থেকেই মানভূমের বাংলাভাষীদের ভাষা রক্ষার জন্য বিহার বিদ্বেষী মনোভাব তৈরী হয়। কংগ্রেসের দুটি গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায়। ধানবাদের হিন্দিভাষীরা বিহার সরকারের প্রবল সমর্থক হওয়ায় আন্দোলন অনিবার্য হয়ে পরে। মতৈক্য সাধনের জন্য বান্দোয়ানের জিতমু গ্রামে এক সভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেই সভায় তর্ক বিতর্ক মতবিরোধ প্রকট হয়ে উঠে। পুরুলিয়া শহরের কিছু সদস্য ধানবাদের হিন্দিভাষী সদস্যদের সমর্থন করেন। তাই হিন্দি ভাষার অনুকুলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যায়। এই সিদ্ধান্ত বদল বা পুনর্বিবেচনা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারেরর কাছে আবেদন জানানো হয়। কেন্দ্রীয় সরকার সদর্থক ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন এবং গুণেন্দ্রনাথ রায় সহ আরও অনেক কংগ্রেস কর্মী। এরপর লোকসেবক সঙ্ঘ গঠন হয়।

কর্মসূচি সম্পাদনা

১৯১২ থেকে মানুষের মনে থাকা ক্ষোভ রাজনৈতিক স্পর্শে তীব্রতা পায়। টুসুগানের মাধ্যমে মানভূমে বাংলা ভাষী প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘরেঘরে অরন্ধন পালিত হয়। এই আন্দোলনের তীব্রতায় বিহার সরকার ঘাবড়ে যায়। বিধানসভায় ভাষা আন্দোলন থামাতে Biher Maintenance of Public Order 1950 পাশ করা হয়। এই আইনবলে যত্রতত্র ধরপাকড়, জরিমানা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরবর্তীতে আন্দোলন টুসু সত্যাগ্রহে রূপান্তরিত হয়। বিহার সরকার আরও মরিয়া হয়ে ওঠে । হাটে বাজারে সমস্ত প্রকাশ্য যায়গায় হাল জোয়াল মই ইত্যাদি কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি বন্ধ করে দেয়। লোকসেবক সংঘ এর প্রতিবাদে চাষীদের স্বার্থে প্রকাশ্য স্থানে কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে শুরু করার কর্মসূচি নেয় এবং টুসু সত্যাগ্রহ হাল জোয়াল সত্যাগ্রহে রূপান্তরিত হয়।বিহার সরকার এরপর আরো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নেয়। পাশাপাশি জেলার মধ্যে খাদ্য সামগ্রী আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মানভূমবাসী এরপর খাদ্য সত্যাগ্রহ শুরু করে। লোকসেবক সংঘ মানুষের কথা ভেবে জোড় করে বাঁকুড়া থেকে ট্রাকে ট্রাকে চাল এনে সরবরাহ অব্যাহত রাখে।

পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তির সম্পাদনা

১৯৫২ সালের জনগণনায় ধানবাদ থেকে টাটা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের মাতৃভাষা বাংলা ছিল। কিন্তু চক্রান্ত করে মাতৃভাষা হিন্দি দেখানো হয়েছিল। বিহারের বঙ্গভাষী অঞ্চলের বঙ্গভুক্তির ন্যায্য দাবি নস্যাৎ করার জন্য ১৯৫৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ উপস্থাপিত বাংলা-বিহার অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। প্রতিবাদে মানভূমের লোকসেবক সঙ্ঘ বঙ্গ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়। পুণ্ডরা থানার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে ১০২৫জন আন্দোলনকারী পদব্রজে কলকাতা রওনা দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তিন শতাধিক মহিলা ছিলেন। ২০শে এপিল, ১৯৫৬ সালে পদযাত্রা শুরু হওয়ার পর বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলী, হাওড়া প্রভৃতি জেলার মধ্য দিয়ে ১৮দিন পর ১৯৫৬ সালের ৭ মে তারা কলকাতা পৌঁছয়। তবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের ১২দিনের জেল হয়। পানিক্কর কমিশনকে লোকসেবক সঙ্ঘ অসংখ্য প্রামাণ্য তথ্য ও নথি দিয়েছিল। সেই তথ্যকে পানিক্কর কমিশন স্বীকৃতি দিয়েছিল। আন্দোলনের চাপে বঙ্গ-বিহার সংযুক্তি বিল প্রত্যাহৃত হয়েছিল। ধানবাদ, বোকারো প্রভৃতি এলাকাকে বাদ দিয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠন করা হয়েছিল। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি হয়েছিল।

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "১০বছরেও শেষ হলো না স্মারকস্তম্ভের কাজ পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তির দিন কাটলো উপেক্ষা, অবহেলায়"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২৪  line feed character in |শিরোনাম= at position 38 (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. "The Official Website of Purulia District"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২৬ 
  3. ডেস্ক, কলকাতা 24x7 অনলাইন (১ নভেম্বর ২০১৭)। "শুভ জন্মদিন পুরুলিয়া"কলকাতা 24x7 অনলাইন। কলকাতা 24x7 অনলাইন। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২৪ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. "আজ পুরুলিয়ার জন্মদিন, বঙ্গভুক্তির দাবি ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দাদের"সংবাদ প্রতিদিন। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২৪ 
  5. নন্দদুলাল আচার্য (২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। "ভাষা আন্দোলনে মানভূম"আনন্দবাজার পত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২৩ 
  6. Circular of District Inspector of Schools, Manbhum under No. 700. IIG-5-48, Purulia, 8 March, 1948 to all the Sub-Inspectors of Schools of the District