লুডভিগ ফয়ারবাখ
লুডভিগ আনড্রেয়াস ফয়ারবাখ[টীকা ১] (জার্মান: Ludwig Andreas Feuerbach) (২৮শে জুলাই, ১৮০৪ - ১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৮৭২) একজন জার্মান বস্তুবাদী দার্শনিক ও নীতিশাস্ত্রজ্ঞ।[১] হেগেলের ভাববাদের সমালোচনা এবং ধর্মের মানববাদী ও বস্তবাদী ব্যাখ্যার জন্য ফয়ারবাখ ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কার্ল মার্কস এবং সমসাময়িক অন্যান্য বস্তুবাদী চিন্তাবিদের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন।[২] ফয়ারবাখ একজন নৃতত্ত্ববিদও বটে। তিনি খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতা ও স্বাধীন, সংবেদনক্ষম ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি গোঁড়া ধর্মের বিপরীতে ধর্মীয় মনোবিজ্ঞান প্রস্তাব করেন এবং প্রথম দিককার একটি জার্মান বস্তুবাদী দর্শনের শাখার বিকাশ ঘটান।
লুডভিগ ফয়ারবাখ Ludwig Feuerbach | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ১৩ সেপ্টেম্বর ১৮৭২ | (বয়স ৬৮)
যুগ | ১৯শ শতকের দর্শন |
অঞ্চল | পশ্চিমা দর্শন |
ধারা | বস্তুবাদ, মানবতাবাদ |
প্রধান আগ্রহ | ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম |
উল্লেখযোগ্য অবদান | ধর্ম মানুষের অন্তর্প্রকৃতির বহির্মুখী প্রক্ষেপ |
ভাবগুরু | |
ফয়ারবাখ জার্মানির (তৎকালীন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য) বায়ার্ন রাজ্যের লান্ড্সহুট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রসিদ্ধ জার্মান আইনবিদ পাউল ফন ফয়ারবাখের চতুর্থ পুত্রসন্তান ছিলেন। তিনি প্রথমে ধর্মশাস্ত্র বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও পরবর্তীতে দার্শনিক হেগেলের অধীনে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি ১৮২৮ সালে এরলাঙেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন এবং হেগেলীয় আদর্শবাদ পরিত্যাগ করে প্রাকৃতিক বস্তুবাদ অনুসরণ করা শুরু করেন। এরলাঙেনে পড়াশোনা করার দুই বছরের মাথায় তিনি বেনামে তার প্রথম বইটি প্রকাশ করেন যার শিরোনাম ছিল গেডাংকেন উ্যবার টোড উন্ড উনষ্টের্বলিখকাইট (Gedanken über Tod und Unsterblichkeit, "মৃত্যু ও অমরত্ব সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা")। এই গ্রন্থে তিনি ব্যক্তির অমরত্বের ধারণাটিকে আক্রমণ করেন এবং এমন এক ধরনের অমরত্ব প্রস্তাব করেন যাতে মনুষ্য ধর্মগুলি প্রকৃতিতে পুনরায় শোষিত হয়ে যায়। এরপর তিনি আবেলার্ড উন্ড হেলোইজে (Abälard und Heloise, ১৮৩৪) এবং পিয়েরে বাইলে (Pierre Bayle, ১৮৩৮) গ্রন্থ দুইটি প্রকাশ করেন। এরপরে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলি হল উ্যবার ফিলোজোফিয়ে উন্ড ক্রিস্টেনটুম (Über Philosophie und Christentum, "দর্শন ও খ্রিস্টধর্ম প্রসঙ্গে", ১৮৩৯) এবং ডাস ভেজেন ডেস ক্রিস্টেনটুম্স (Das Wesen des Christentums, "খ্রিস্টধর্মের মর্মকথা", ১৮৪১)। প্রথমোক্তটিতে তিনি লেখেন যে "খ্রিস্টধর্ম কেবল যৌক্তিক বিশ্বভঙ্গি থেকে নয়, মানবজাতির ইতিহাস থেকেই বিলীন হয়ে গিয়েছে; এটি এখন কেবলই একটি স্থির ধারণামাত্র"। শেষোক্ত গ্রন্থটিতে তিনি যুক্তি দেন যে একজন ব্যক্তি মূলত তার নিজসত্তাকে নিয়েই বেশি চিন্তিত। ঈশ্বরের উপাসনা বাস্তবিকপক্ষে ব্যক্তিসত্তার এক আদর্শ রূপের উপাসনা। ঈশ্বর হল মানবজাতির নিজস্ব অন্তর্মুখী প্রকৃতির আরোপিত বহির্মুখী প্রক্ষেপ মাত্র যাকে অসীমের মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে। তিনি বলেন যে ধর্ম কেবল একটিমাত্র কারণে গ্রহণযোগ্য, আর সেটি হল এটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা পূরণ করেন। এই গ্রন্থের প্রথম অংশে ফয়ারবাখ "ধর্মের প্রকৃত বা নৃতাত্ত্বিক মর্ম" বিশ্লেষণ করেন। ইশ্বরের "সংবেদনশীল সত্তা", "নৈতিক সত্তা", "প্রেমময় সত্তা" এবং অন্যান্য দিক বিশ্লেষণ করে তিনি যুক্তি দেন যে এগুলি আসলে মানব প্রকৃতির বিভিন্ন চাহিদার প্রত্যুত্তর। গ্রন্থটির দ্বিতীয় অংশে তিনি "ধর্মের মিথ্যা বা ধর্মতাত্ত্বিক মর্ম" বিশ্লেষণ করেন এবং দাবী করেন যে মানব অস্তিত্বের বাইরে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের ফলে গূঢ় আধ্যাত্মিক কিছুর উন্মোচন ও এর প্রতীকী প্রকাশে বিশ্বাস আনতে হয়, যা কিনা এক ধরনের অবাঞ্ছিত ধর্মীয় বস্তুবাদের বহিঃপ্রকাশ।
ফয়ারবাখের ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব অপেক্ষা তার সংবেদনশীল বস্তুবাদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে মানুষ ও তাদের বস্তুগত চাহিদাগুলির সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তিতে থাকা উচিত। তিনি এই মত দেন যে একজন ব্যক্তি ও তার মন-মানসিকতা হল তার পরিবেশের ফলাফল। একজন ব্যক্তির সমগ্র চেতনা হল তার ইন্দ্রিয়গুলির সাথে বহির্বিশ্বের আন্তঃক্রিয়ার ফলাফল। এক পর্যায়ে ফয়ারবাখ এই উক্তিটি দেন যে "ডের মেন্শ ইস্ট ভাস এর ইস্ট" (“Der Mensch ist was er isst”), অর্থাৎ "মানুষ যা খায়, সে তা-ই"। তিনি মানবজাতির উন্নয়নের জন্য উত্তম খাদ্যের পক্ষে প্রচারণা করেন।
যদিও ফয়ারবাখ নিজেকে নাস্তিক বা নিরীশ্বরবাদী বলতেন না, তিনি দাবী করেন যে খ্রিস্টধর্মের ঈশ্বর হল এক ধরনের বিভ্রম। তিনি হেগেলের মূলনীতিগুলিকে ধর্মের কাছাকাছি কিছু হিসেবে দেখতেন। ১৮৪৮-৪৯ সালের রাজনৈতিকভাবে উত্তাল বছরগুলিতে ফয়ারবাখ ধর্মীয় গোঁড়াবাদীদের আক্রমণ করেন এবং এর ফলে বহু বিপ্লবীর কাছে নায়কে পরিণত হন।
ফয়ারবাখের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে টেওগোনিয়ে (Theogonie, ১৮৫৭) এবং গটহাইট, ফ্রাইহাইট উন্ড উনষ্টের্বলিখকাইট (Gottheit, Freiheit, und Unsterblichkeit, "ঈশ্বরত্ব, মুক্তি ও অমরত্ব”, ১৮৬৬).
সাম্যবাদী দার্শনিক কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙেল্স এবংখ্রিস্টধর্ম-বিরোধী লেখক ডাভিড ফ্রিডরিখ ষ্ট্রাউসের উপরে ফয়ারবাখ প্রভাব ফেলেন। ফয়ারবাখ ব্যক্তি ও ব্যক্তির চাহিদার উপরে যে জোর দেন, তাতে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙেলস সমাজের একটি বস্তুবাদী ব্যাখ্যার দেখা পান, এবং ফয়ারবাখের তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে তারা পরবর্তীতে তাদের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি প্রদান করেন। ষ্ট্রাউসের সংশয়বাদী গ্রন্থ ডাস লেবেন ইয়েজু ক্রিটিশ বেআর্বাইটেট (Das Leben Jesu kritisch bearbeitet, "সমালোচনামূলকভাবে অধীত যিশুর জীবন" , ১৮৩৫–৩৬) এবং ব্রুনো বাউয়ারের রচনায় ফয়ারবাখের প্রভাব দেখা যায়। বাউয়ার-ও হেগেলবাদ পরিত্যাগ করে প্রকৃতিবাদ গ্রহণ করেছিলেন। কিছু চরমপন্থী জার্মানিতে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী লড়াইয়ে ফয়ারবাখার চিন্তাকে সমর্থন দেন। অন্যদিকে মার্ক্স ও তার সমমনস্করা ফয়ারবাখের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমশক্তির বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
ফয়ারবাখ জার্মানির রেখেনবের্গ শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস
সম্পাদনাকার্ল মার্কস থিসিস অন ফয়ারবাখ (Thesis on Feuerbach) শিরোনামে যেসব প্রবন্ধ রচনা করেন (১৮৪৫) সেগুলি ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের লুডভিগ ফয়ারবাখ নামক পুস্তকে প্রকাশিত হয়। ফয়ারবাখ ধর্মের যে মনস্তাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন সেটিই ছিল মার্কস ও এঙ্গেলসের নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাখ্যায় ফয়ারবাখের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এই যে, অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি যদিও জ্ঞানের মূল উৎস তথাপি জ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের ভূমিকা একেবারে নগণ্য নয়।[১]
রচনার বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনাফয়ারবাখ ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ বিশ্লেষণ করে ভাববাদের সাথে ধর্মের সম্পর্ক দেখান। হেগেলের দ্বান্দিকতার মূল চরিত্র যে ভাববাদ তাও ফয়ারবাখ বিশ্লেষণ করে দেখান। জ্ঞানতত্ত্বে তিনি অজ্ঞেয়বাদ এর বিরোধিতা করেন। তার মতে, জ্ঞানের উৎস হচ্ছে অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি। কিন্তু অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়ানুভুতির উপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে তিনি জ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের ভূমিকা অস্বীকার করেননি। মানুষের জ্ঞান ও চেতনা কেবল আত্মগত নয়। ফয়ারবাখ মনে করতেন জ্ঞান এবং জ্ঞাতা, বিষয় ও বিষয়ীর পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতেই জ্ঞানের উদ্ভব। কাজেই জ্ঞান হচ্ছে সামাজিক প্রক্রিয়া[২]
টীকা
সম্পাদনা- ↑ এই জার্মান ব্যক্তি বা স্থাননামটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে উইকিপিডিয়া:বাংলা ভাষায় জার্মান শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ শীর্ষক রচনাশৈলী নিদের্শিকাতে ব্যাখ্যাকৃত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ মো. আবদুল ওদুদ (দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৪)। রাষ্ট্রদর্শন। ঢাকা: মনন পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ৪৮৯। আইএসবিএন 978-98-43300-90-4। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য); - ↑ ক খ সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৩ পৃ:১৭৩]
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনাএই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |