রামগিরি বা 'রামগিরি পর্বত' ভারতের উত্তরপ্রদেশমধ্যপ্রদেশের সীমান্তে চিত্রকূট অঞ্চলে অবস্থিত। ভারতের প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণে বর্ণিত চিত্রকূট পর্বতে যে অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায় সেটি উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তরাংশের বাহান্ন ফুট উচ্চতার পাহাড় ও বনভূমির মধ্যে পড়ে। বর্তমানে উক্ত অঞ্চলটি উত্তরপ্রদেশের চিত্রকূট জেলা এবং মধ্যপ্রদেশের সাতানা জেলার অন্তর্ভূক্ত। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে অঞ্চলটি একদিকে সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ এবং অন্যদিকে এটি প্রাচীনকালের বহু মুনি-ঋষির তপস্যায় সিদ্ধিলাভের স্থল। আবার বাল্মিকী রামায়ণ অনুসারে এই অঞ্চলে রাম-সীতা-লক্ষ্মণ, বনবাসের সাড়ে এগারো বৎসর অতিবাহিত করেন এই স্থানে। শ্রীরামের প্রতি ভক্তির কারণে সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ - মেঘদূতম্ এর রচয়িতা মহাকবি কালিদাস এই অঞ্চলের নামকরণ করেন 'রামগিরি পর্বত'। জনশ্রুতি আছে, রামচরিতমানস-এর বিখ্যাত হিন্দি সাহিত্যের কবি তুলসীদাস এখানেই শ্রীরামের সাক্ষাৎ লাভ করেন। তার এবং মোগল সম্রাট আকবর-এর সভাসদ আবদুল রহিম খানের লেখনীতে চিত্রকূট তথা রামগিরি পর্বতের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।

পটভূমি সম্পাদনা

পৌরাণিক-

  পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী পিতার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে পিত্রালয়েই দেহত্যাগ করেন। সতীর দেহত্যাগের সংবাদ মহাদেবের কাছে পৌছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। তার এই নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর পবিত্র দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সতীর খন্ডিত দেহাংশের দক্ষিণ স্তন পড়ে চিত্রকূট পর্বতে। গড়ে ওঠে একান্নটি শক্তিপীঠের অন্যতম- 'সতীপীঠ রামগিরি'। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী শিবানী এবং ভৈরব হলেন চাঁদ বা চান্দা।[১] রামগিরির এই মন্দিরের অবস্থান উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি-মানিকপুর রেলপথে চিত্রকূট স্টেশন এবং সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রামগিরিতে চিত্রকূটতীর্থ। [২]

মহাকাব্যিক-

  শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবী ও অনুজ লক্ষ্মণকে নিয়ে সাড়ে এগারো বছর চিত্রকূটের বনে কুটির বেঁধে বাস করেন। তাদের পাদস্পর্শে পবিত্র, মন্দাকিনীর পূণ্যস্রোতে বিধৌত, জনকতনয়া সীতার স্নানে পবিত্র জলাশয় তথা জানকীকুণ্ড, শ্রীরামচন্দ্র সৃষ্ট প্রস্রবণ- হনুমানধারা ইত্যাদির মধ্যে ছায়াতরুতে পরিপূর্ণ স্থানে নির্বাসিত হন মহাকবি কালিদাসের মেঘদূতম্‌- এক যক্ষ। কাব্যটির প্রথম শ্লোকেই তিনি উল্লেখ করেন-

"কশ্চিৎকান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্ত শাপেনাস্তংগমিতমহিমা বর্ষভোগেণ ভর্তুঃ।

যক্ষশ্চক্রে জনকতনয়াস্নানপুণ্যোদকেষু

স্নিগ্ধছায়াতরুষু বসতিং রামগির্যাশ্রমেষু।"

অর্থাৎ- আপন কর্তব্যে ভ্রষ্ট কোনো এক যক্ষকে তার প্রভু এক বছরের জন্য গুরুতর প্রিয়াবিরহের অভিশাপ দিলেন। অভিশাপের ফলে তার সকল মহিমা নষ্ট হয়ে গেল। অলকাপুরী হতে যক্ষ রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত হল। সে জনকতনয়া সীতার স্নানে পবিত্র জলাশয়যুক্ত এবং ছায়াতরুতে পরিপূর্ণ রামগিরি (পর্বত) আশ্রমগুলিতে বাস করিতে লাগিল।

এই রামগিরিতেই আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে সেই যক্ষের দৃষ্ট 'প্রমত্ত হস্তীর ন্যায় রমণীয় মেঘখণ্ড' স্মরণ করায় বাংলার নববর্ষাকে আর বিরহ-প্রেমের নানা বিশ্বসাহিত্যকে।

উল্লেখ্য, অন্ধ্রপ্রদেশ তথা অধুনা তেলেঙ্গানা রাজ্যের পেদ্দাপল্লী জেলার রামাগিরি মণ্ডলের বেগমপেট গ্রামের কাছে রামগিরি পর্বতের বিস্তৃত অংশে দ্বাদশ শতকে ওয়ারাঙ্গলের কাকতীয়েরা নির্মাণ করেছিলেন রামগিরি দুর্গ  ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দ হতে এটি কুতুব শাহিদের দখলে ছিল। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দেআবদুল্লাহ কুতুব শাহ তার এক জামাতাকে (যিনি আওরঙ্গজেবের এক পুত্র) দুর্গটি দিয়ে দেন। কিন্তু ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে এর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ব্রিটিশদের হাতে।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "রামগিরি শক্তিপীঠ: যে স্থানে সতীর ডান বক্ষ (স্তন) পতিত হয়েছিল"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-২৬ 
  2. বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা, গণিতজ্ঞ মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবর্তিত, দেবীর ৫১ পীঠস্থান, পৃষ্ঠা সংখ্যা -খ ৯৯
  3. Roy, Kaushik (২২ মে ২০১৪)। Military Transition in Early Modern Asia, 1400–1750: Cavalry, Guns, Government and Ships। A&C Black। আইএসবিএন 978-1-78093-813-4