আষাঢ়স্য প্রথম দিবস

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস (বঙ্গাব্দের ১ আষাঢ়) হল মহাকবি কালিদাসের স্মৃতি দিবস। প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কালিদাস রচিত সাতটি কাব্যগ্রন্থের (তিনটি নাটক তথা দৃশ্যকাব্য, দুটি মহাকাব্য এবং দুটি খণ্ডকাব্য) মধ্যে মেঘদূত খণ্ডকাব্যটি সেসময়ে অসামান্য কাব্যগুণে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মন্দাক্রান্তা ছন্দ-এ রচিত কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি শ্লোক ও পদের টীকা ও টিপ্পনীতে সাহিত্য সমালোচকেরা কবির যথার্থ অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।[] কৈলাশনিবাসী কুবেরের অভিশাপে রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত তার অনুচর, উদ্যান পরিচালক যক্ষ-এর প্রিয়াবিরহ ছিল কাব্যের মূল উপজীব্য বিষয়। বর্ষার শুরুতে এই "শুদ্ধ বিরহ অবলম্বনে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ কাব্য হিসাবে মেঘদূতের কাব্যমূল্য অপরিসীম।"[] ইংরাজীসহ ইউরোপের বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে কাব্যটি। স্বামী বিবেকানন্দ যেমন কণ্ঠস্থ করেছিলেন, তেমনই আত্মস্থ করে বাংলায় কবিতা, প্রবন্ধ রচনা করেছেন বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখেরা। [] এযাবৎ বাংলা ভাষাতেই কাব্যগ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে শতাধিক অনুবাদকের কলমে। এহেন মহান কবির আবির্ভাব দিবস অজানা থাকায় বাংলায় বর্ষাঋতু (আষাঢ-শ্রাবণ) প্রারম্ভের প্রথম দিন (১ আষাঢ়) মহাকবিকে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনে উদযাপিত হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে আষাঢ়স্য প্রথম দিবস মহাকবির জন্মদিনরূপে উদযাপন করা হয়।[]

কালিদাস ও বঙ্গসংস্কৃতি

সম্পাদনা
 
১৯৬০ সালে ভারতীয় ডাক টিকিটে প্রকাশিত যক্ষ ও মেঘদূতের একটি দৃশ্য এবং মেঘদূতম্ কাব্যের দ্বিতীয় শ্লোকের বিখ্যাত পঙক্তিটি- 'আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে'

‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং বপ্রক্রীড়াপরিণত গজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।

যার অর্থ- আষাঢ় মাসের প্রথম দিবসে (অভিশপ্ত যক্ষ প্রিয়তমা বিরহে) রামগিরি পর্বতের গাত্রে ক্রীড়ারত প্রমত্ত হস্তীর ন্যায় রমণীয় মেঘখণ্ডকে অবলোকন করিতেছিলেন।

মেঘদূতম্‌ বর্ষাকাব্যের উপরোক্ত শ্লোক হতে ১ আষাঢ় তারিখে কালিদাস জয়ন্তী, বর্ষামঙ্গল বা মেঘদূত উৎসবের দিন হিসাবে নির্ধারিত হয়।[]

বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় কালিদাস নবরত্নের অন্যতম ছিলেন, সেকারণে অনুমিত হয় যে আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দের জুনের মাঝামাঝি অর্থাৎ আষাঢ় মাসের প্রথম দিনে শুরু করেন মেঘদূতম্ বর্ষাকাব্যের রচনা।[]

আপন কর্তব্যে ভ্রষ্ট হয়ে যক্ষ তার প্রভুর অভিশাপে একবছরের জন্য প্রিয়াবিরহে জনকতনয়া সীতার স্নানে পবিত্র জলাশয়, ছায়াতরুতে পরিপূর্ণ রামগিরি পর্বতে যখন অবস্থান করছেন, আষাঢ় মাসের প্রথম দিনে পর্বতের মধ্যদেশ সংলগ্ন স্থানে মেঘালোকে বপ্রক্রীডায় মত্ত সুন্দর হস্তীকে প্রত্যক্ষ করেন। এই মেঘ দর্শনে প্রিয়ার কণ্ঠ-আলিঙ্গনের অভিলাষী বিরহী যক্ষের চিত্তে ভাবান্তর উপস্থিত হয়। তিনি মেঘকে দূত করে নানান দেশ, নদী পেরিয়ে কৈলাশে পাঠান তার প্রিয়ার কাছে। বর্ষাঋতু তাই বিরহ-প্রেমের এবং সেই বার্তাটিই যেন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই রচনা করেন-

কবিবর, কবে কোন্‌ বিস্মৃত বরষে

কোন্‌ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক

বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক

রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে

সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে।

বাংলায় বর্ষা মেঘ-মেদুর দিবসের ছায়ালোকে, সজল মেঘের শ্যামলকান্তি অতুল রূপের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত। বর্ষণসিক্ত গ্রামবাংলার সবুজ প্রকৃতি নয়নাভিরাম। বর্ষা কৃষকের কাছে আবাদী ঋতু, মাটির উর্বরা শক্তির সঙ্গে আগামী সৃষ্টির প্রতীক্ষা উপেক্ষা করা যায় না, তাই নতুনের জন্য উদ্‌যাপন করতে হয় বর্ষামঙ্গল। বর্ষায় মানুষের মন ক্রমাগত বাইরের পথে বেরিয়ে পড়তে চায়, মহাকবি কালিদাসের মেঘদূতম্‌ সেই আকাঙ্ক্ষাকেই যেন জাগিয়ে তোলে। বর্ষার আগমন জানাতে আষাঢ়ের প্রথম দিনে কালিদাসের বিকল্প নেই। []

আরো দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "আষাঢ়স্য প্রথম দিবস"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-১৬ 
  2. সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ২০০৯ মুদ্রণ, পৃ. ১৫০-৫২
  3. "আষাঢ়স্য....(কলকাতার কড়চা)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-১৭ 
  4. বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা, গণিতজ্ঞ মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবর্তিত, আষাঢ় মাসের দিনপঞ্জী-১ আষাঢ়
  5. "'আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং', আজও ১লা আষাঢ়ে অপরিহার্য কালিদাস"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-১৬