রণহাট

বাংলাদেশের রাজশাহী এলাকার একটি গ্রাম

রণহাট রাজশাহী জেলার পবা উপজেলায় অবস্থিত ৮ নং হরিয়ান ইউনিয়নের একটি গ্রাম।

রণহাট
গড়ের হাট (পূর্বে)
গ্রাম
ঘড়ির কাঁটা বরাবর উপর থেকে নিচেঃ হরিয়ান ইউনিয়নের মানচিত্র, রণহাট বড় বিলে সূর্যাস্তের দৃশ্য, রণহাটে বাইপাস সড়কে পরিবহন, গভীর পাম্পের সাহায্যে সেচ প্রকল্প, সবুজ ধানক্ষেত এবং রণহাট আশরাফের মোড়।
রণহাট বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
রণহাট
রণহাট
রাজশাহীতে রণহাটের অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৪°২৩′ উত্তর ৮৮°৪১′ পূর্ব / ২৪.৩৮৩° উত্তর ৮৮.৬৮৩° পূর্ব / 24.383; 88.683
দেশ বাংলাদেশ
বিভাগরাজশাহী
জেলারাজশাহী
উপজেলাপবা উপজেলা
থানামতিহার
ইউনিয়ন৮ নং হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদ
ওয়ার্ড নং.০১
প্রতিষ্ঠিত১৯৫৩ (প্রায়)
রণহাটের যুদ্ধ১৯৬০
সরকার
 • ধরনইউনিয়ন পরিষদ
 • ইউপি মেম্বারনূরুল ইসলাম
আয়তন
 • মোট১ বর্গকিমি (০.৪ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা
 • মোট৩,২১৫ (২,০১১ আদমশুমারি অনুযায়ী)
 • স্বাক্ষরতার হার৪৩.৬২%
 • অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিমৎস্য চাষ ও খামার প্রকল্প
সময় অঞ্চলBST (ইউটিসি+6)
পোস্ট কোড৬২১১
সড়কএন৬০৩
ভাষাবাংলা
ধর্মমুসলিম: ৯৭.৪৯% অন্যান্য: ২.৫১%

ইতিহাস সম্পাদনা

প্রায় ১৯৫৩ সালের দিকে রণহাট গ্রামটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে এটি “গড়ের হাট” নামে পরিচিত ছিল। বলা হয়ে থাকে রণহাট প্রথমে একটি আঞ্চলিক বাজার হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে জায়গাটা লোকবসতিতে ভরে উঠে। গ্রামটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পুকুর ও লেকের খনন কাজ বাড়তে থাকে। ১৯৬০ সালে এই গ্রামে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়, এতে ৩ থেকে‌ ৪ জন লোক মারা যায় এবং বহু লোক আহত হয়। এই সংঘর্ষের নামানুসারে রণহাট নামকরণ করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

গ্রামটি কয়েকটি পাড়া ও মহল্লায় বিভক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি যে পরিবর্তনগুলো এসেছে তা হলো একে অপরের প্রতি গ্রামবাসীর দৃঢ় বন্ধন, সামাজিক দায়িত্ব এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।

বর্তমানে ৮ নং হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদে রণহাট গ্রামটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, হরিয়ান ইউনিয়ন মোট ৯টি ওয়ার্ড ও ১২টি মৌজা নিয়ে গঠিত।

ভূখণ্ড সম্পাদনা

রণহাট ২৪°২৩′৪১″ উত্তর ৮৮°৪১′০৭″ পূর্ব / ২৪.৩৯৪৬৪১৩° উত্তর ৮৮.৬৮৫৩৮৪৪° পূর্ব / 24.3946413; 88.6853844[১] দ্রাঘিমা রেখাংশে মোট ১ কিমি (০.৩৯ মা) ভূখণ্ড জুড়ে বিস্তৃত এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বাইরে উত্তর-পূর্ব ও হরিয়ান ইউনিয়ন থেকে উত্তর দিকে এটি অবস্থিত। রণহাট মূলত দুইটি এলাকায় বিভক্ত- রণহাট পূর্ব পাড়া ও রণহাট পশ্চিম পাড়া এবং মোট এগারোটি লোকালয়ে বিস্তৃত। এছাড়াও আরো দুইটি জনপদ রয়েছে সেগুলো হলো রণহাট শেখ পাড়া ও রণহাট নামু পাড়া। সিংহ ভাগ অঞ্চল রণহাট পূর্ব পাড়ায় গঠিত। রণহাটের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ গ্রামবাসী পূর্ব পাড়ায় বসবাস করে। পূর্ব পাড়ায় পদ্মবিল, রণদিঘী, বড় দিঘী, হামুর দিঘি ইত্যাদি লেক ও জলাশয় রয়েছে; রণহাট পশ্চিম পাড়ায় একমাত্র খুলু বিল বিদ্যমান।

মোট এলাকার এক চতুর্থাংশ জায়গা জুড়ে রাজশাহী বাইপাস সড়ক এই ‌গ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছে। এক চতুর্থাংশ পাকা ও আধা পাকা রাস্তা রয়েছে। অধিকাংশ ভূখণ্ড‌ সারা মৌসুমে ধান, গম প্রভৃতি চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত। পশ্চিম পাড়ায় একটি সার কারখানা রয়েছে।

জনসংখ্যা সম্পাদনা

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ৩,২১৫ জন মানুষ এই গ্রামে বাস করেন যার মধ্যে পুরুষ ৪৮.১৫% এবং মহিলা ৫১.৮৫%।[২] গড় স্বাক্ষরতার হার ৪৩.৬২% (৭ বছর ও তদুর্ধে)। সবাই‌ বাংলা ভাষাভাষী। ইসলাম এখানে প্রধান ধর্ম। শতকরা ৯৭.৪৯ ভাগ গ্রামবাসী মুসলিম এবং বাকি ২.৫১ ভাগ মানুষ অন্যান্য ধর্ম অনুসরণ করে।[৩]

প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পাদনা

ছোট বড় অসংখ্য লেক, জলাভূমি, বিল নিয়ে সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি রণহাট। এদের মধ্যে রণদিঘী, বড় বিল, বড়দিঘী (ঘোড়াদিঘী নামেও পরিচিত), খুলু বিল, পদ্মবিল, হামুর দিঘী, মজা পুকুর প্রভৃতি অন্যতম।

বড় দিঘি সম্পাদনা

রণহাট বড় দিঘি জনপ্রিয় একটি জলাশয়। এটি বাইপাস সড়ক (এন৬০৩) ঘেঁষে অবস্থিত। জলাশয়টির মোট আয়তন ৬.২ একর। এটি উত্তর ও দক্ষিণ দিক বরাবর প্রশস্ত। সারা বছরই পানিপূর্ণ থাকে এটি। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রক্রিয়ায় মাছ চাষ করা হয়। বড় দিঘি সম্পর্কে একটা পুরাকথা শোনা যায়। প্রাচীনকালে বাংলার কোনো এক শাসক এখানে বড় দিঘি খননের জন্য ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করেছিলেন। তিনি ঘোষণা দেন যে ঘোড়া এক দৌড়ে যতদূর যাবে ততখানি পুকুর খনন করা হবে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর ঘোড়ার পা একটি গর্তে আটকে যায় এবং সেটুকুই খনন করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] গত কয়েক বছরে চারপাশের মাটি ধসে পুকুরের আয়তন কিছুটা বেড়েছে।

বড় বিল সম্পাদনা

বড় বিল সবচেয়ে বড় ও প্রধান লেক; আয়তন প্রায় ৩০০ একর।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তিনটি গ্রামকে স্পর্শ করেছে এটি। মূলত রণহাটের বেশিরভাগ অংশ বড় বিল জুড়ে বিস্তৃত। পূর্বে শুষ্ক মৌসুমে ফসল উৎপাদন, চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হত; বর্ষায় কানায় কানায় পানিতে ব্যাপক আকার ধারণ করত এটি। মৎস্য চাষে সফলতা পাওয়ার পর বর্তমানে অসংখ্য ছোট বড় পুকুর খনন করে বিলটির সৌন্দর্য নষ্ট করেছে।

রণ দিঘি সম্পাদনা

১৯৬০ সালে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের পর ঘটনাস্থলের নাম দেওয়া হয় রণ দিঘী। এটি বড় বিলের সাথে অন্তর্ভুক্ত। আয়তন প্রায় ৮.৩ একর।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] মাছ চাষ করা হয় এই দিঘীতে।

রণহাট আশরাফের মোড় সম্পাদনা

দৈনন্দিন বাণিজ্যের জন্য আশরাফের মোড় অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল। বাইপাস সড়ক সংলগ্ন এন৬০৩ পয়েন্টে এটি অবস্থিত। মুদি, কাঁচামাল, ফলমূল ইত্যাদি বিভিন্ন পণ্য কেনাবেচা হয়। অর্ধশতাধিক বিভিন্ন পণ্যের দোকান রয়েছে আশরাফের মোড়ে।

রণহাট পদ্মবিল সম্পাদনা

রণহাট পদ্মবিল হরিয়ান ইউনিয়ন জুড়ে বড় বড় বিলগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৩২.৩ একর জায়গা জুড়ে এটি অবস্থিত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পশ্চিম দিকে মল্লিকপুর, উত্তর-পূর্ব দিকে পারিলা, দক্ষিণে নলখোলা গ্রামাঞ্চল অবস্থিত। বিলের চারপাশে অগঠিত জনপদ গড়ে উঠেছে। বর্ষাকালে দুকূল ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে উঠে আসে। অন্যান্য মৌসুমে এটি শুষ্ক বিলে রূপ নেয় এবং পলি জমে ফসল ফলানোর জন্য উর্বর ভূমি তৈরি হয়। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মবিলে বিভিন্ন শস্য উৎপাদন করা হয়।

রণহাট খুলু বিল সম্পাদনা

রণহাট পশ্চিম পাড়ায় অবস্থিত আরেকটি উল্লেখযোগ্য বড় লেক হলো রণহাট খুলু বিল। বিলটি দুই অংশে বিভক্ত- এক অংশ একটি ১১.২ একর বিশিষ্ট খাল যেখানে প্রায় সারাবছরই মাছ চাষ করা হয় এবং অপর অংশ একটি বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল যেখানে মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করা হয়। খালটি মাছ চাষের জন্য উপযোগী; দুই বছর বা তদূর্ধ্ব মেয়াদ অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের মাছ চাষ করা হয়। খালের চারপাশ জুড়ে অনেক লোকবসতি রয়েছে। এই খালের প্রধান আকর্ষণ এর সূর্যাস্তের দৃশ্য।

খালের দক্ষিণে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল রণহাট খুলু বিলের প্রধান ভূখণ্ড। কৃষক ধান, গম, পাট, সরিষা, মরিচ, শসা, লাউ প্রভৃতি ফসল ফলায়। ডিপ পাম্পের সাহায্যে জমিতে সেচ দেওয়া হয়।

প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ সম্পাদনা

রণহাট পূর্ব পাড়ায় পদ্মবিলের দক্ষিণ দিকে পাড় ঘেঁষে একটি পোড়া মাটির গম্বুজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। গম্বুজটির চারপাশ ইট দিয়ে নির্মিত। এর দরজা মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে। ভূমি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৭ ফুট, চওড়া ১১ ফুট। লোকমুখে শোনা যায় এটি প্রাচীনকালে কেক ‌বেকারি হিসেবে ব্যবহৃত হত।

শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান সম্পাদনা

রণহাটে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৮০% এবং শিক্ষার হার ৪৩.৬২%।[৪] শিক্ষার দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। তবে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করায় গ্রামের প্রতিটি শিশু স্কুলে যায়। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য হরিয়ান ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত কুখন্ডি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অন্যতম প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রণহাটে এককভাবে কোনো স্কুল নেই তবে তিন গ্রামের (মল্লিকপুর, রণহাট ও কুখন্ডি) যৌথ উদ্যোগে গঠিত এমআরকে উচ্চ বিদ্যালয়, এমআরকে কলেজ অন্যতম।

গ্রামের একটি মসজিদে মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে। একজন দক্ষ শিক্ষক দ্বারা আরবি শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ও গণিতের প্রাথমিক জ্ঞান দান করা হয়।[৫]

উন্নয়ন সম্পাদনা

বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসংস্থান যেমন মৎস্য চাষ, মুরগি ও ডিম উৎপাদন, কৃষিকাজ, ব্যবসা, উদ্যোক্তা প্রভৃতি এই‌ গ্রামের মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গ্রামের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে মৎস্য ও বিদেশী মুরগি পালন। ডিম উৎপাদন ব্যবসাসফল, লাভজনক এবং তুলনামূলক কম বিনিয়োগ থাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একটি করে মুরগির খামার গড়ে উঠেছে।

বিখ্যাত ব্যক্তি সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Google Maps"। 
  2. 2011 Census of Bangladesh
  3. Sources of Data, Regional Collaboration। "A sample survey of Population Distribution of Ranhat, Rajshahi Sugar Mills-6211, Paba Upazila, Rajshahi."। 
  4. Demographic, Yearbook (২০১১)। "Demographic Yearbook" – 8 No. Harian Union Parishod Council, Paba, Rajshahi-এর মাধ্যমে। 
  5. "A government organisation for child education."। Ranhat, 8 No. Harian Union, Paba Upazila, Rajshahi. 

  উইকিমিডিয়া কমন্সে রণহাট সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।