মোগাদিশুর যুদ্ধ (১৯৯৩)

মোগাদিশুর যুদ্ধ (ইংরেজি: Battle of Mogadishu) (সোমালি: Maalintii Rangers অর্থাৎ, রেঞ্জারদের দিন), যা কৃষ্ণ সাগরের যুদ্ধ বা (Battle of the Black Sea), এবং ব্ল্যাক হক ডাউন বা (Black Hawk Down) নামেও পরিচিত হচ্ছে অপারেশন গোথিক সার্পেন্টের আওতাধীন একটি যুদ্ধ। ১৯৯৩ সালের ৩ ও ৪ অক্টোবর সোমালিয়ার রাজধানী শহর মোগাদিশুতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। যুদ্ধের এক পক্ষে ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের সমর্থিত ইউএনওএসওএম ২ (UNOSOM II), এবং অপরপক্ষে ছিলো তৎকালীন সোমালিয়ার রাষ্ট্রপতি ও মিলিশিয়াদের নেতা যুদ্ধবাজ মোহাম্মদ ফারাহ এইদিদ। যুদ্ধে এইদিদের পক্ষে অনেক বেসামরিক ব্যক্তিকেও যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিলো। এই যুদ্ধটি মোগাদিশুর প্রথম যুদ্ধ নামেও পরিচিত, কারণ পরবর্তীকালে ২০০৬ সালে মোগাদিশুতে আরও একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা মোগাদিশুর দ্বিতীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত।

১৯৯৩ সালে সংঘটিত মোগাদিশুর যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: সোমালি গৃহযুদ্ধ

১৯৯৩ সালের ৩ অক্টোবর, মাইক ডুরান্টের হেলিকপ্টার সুপার সিক্স-ফোর মোগাদিশুর দিকে রওনা হয়েছে।
তারিখ৩–৪ অক্টোবর, ১৯৯৩
অবস্থান
ফলাফল

ইউএনওএসওএম ২ কৌশলগত বিজয় এসএনএ কুশলী বিজয়

  • যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার: ২৫ মার্চ, ১৯৯৫
  • জাতিসংঘের সেনা প্রত্যাহার: ৩ মার্চ, ১৯৯৫
বিবাদমান পক্ষ

জাতিসংঘ ইউএনওএসওএম ২

সোমালিয়া এসএনএ
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উইলিয়াম এফ. গ্যারিসন সোমালিয়া মোহাম্মদ ফারাহ এইদিদ
শক্তি
১৮০ ২,০০০-৪,০০০ (মিলিশিয়া ও বেসামরিক যোদ্ধা)
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
যুক্তরাষ্ট্র
১৯ জন নিহত
৮৪ জন আহত[১]
১ জন বন্দী
মালয়েশিয়া
১ জন নিহত
৭ জন আহত
পাকিস্তান
২ জন আহত
এসএনএ মিলিশিয়া ও বেসামরিক
সঠিক ভাবে জানা যায় না, তবে ধারণা করা হয় প্রায় ১,০০০[২] থেকে ৩,০০০[৩] নিহত হয়েছে[৪] সেই সাথে আরও ৭০০-এরও বেশি নিহত হয়েছে,
আহতের সংখ্যা ১,৫০০-এরও বেশি,
ও ২১ জন বন্দী
উল্লেখ্য যে, মূল যুদ্ধে নিহত মার্কিন সৈন্যের সংখ্যা ১৮। দুই দিন পর সোমালিদের মর্টার আক্রমণের কবলে পড়ে ডেলটা ফোর্সের আরও একজন সৈন্য নিহত হন, যা নিহতের সংখ্যা ১৯-এ উন্নীত করে। এছাড়া মাইক ডুরান্ট-ই এসএনএ-এর হাতে ধরা পড়া একমাত্র মার্কিন সৈনিক। পরবর্তীতে ১১ দিন আটক থাকার পর তিনি মুক্তি পান।

পটভূমি সম্পাদনা

১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে ঐক্যজোটের দল ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস সোমালিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সিয়াদ বারেকে উৎখাত করে। এই বিপ্লবের পর ঐক্যজোটের সরকার দুই ভাগে বিভক্ত হয়। একটি অংশের নেতৃত্ব দেন আলি মাহদি মুহাম্মদ, যিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, ও অপর অংশের নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ ফারাহ এইদিদ। সবমিলিয়ে সোমালিয়ায় তখন মোট চারটি বিরোধী দলের সৃষ্টি হয়। এগুলো হচ্ছে ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস (USC), সোমালি স্যালভেশন ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (SSDF), সোমালি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্ট (SPM), এবং সোমালি ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (SDM)। সবগুলো দলই সোমালিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৯১ সালের জুনে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পরে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে জুন মাসেই পঞ্চম একটি দল, সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট (SNM) সোমালিয়ার উত্তরপশ্চিম অঞ্চল দখল করে। এসএনএম এই অংশের নতুন নাম দেয় সোমালিল্যান্ড প্রজাতন্ত্র। এটির রাষ্ট্রপতি হন আবদেল-রহমান মোহাম্মদ আলি।

বিবরণ সম্পাদনা

মোহাম্মদ ফারাহ এইদিদের অনুগত হাবার গিদির গোত্রীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আটক করতে মোগাদিশু শহরে তাদের অবস্থানকে লক্ষ্য করে টাস্ক ফোর্স রেঞ্জারের এই অপারশেন পরিচালিত হয়। এই টাস্ক ফোর্স রেঞ্জারদের মধ্যে ছিলো মার্কিন সেনাবাহিনীর ডেল্টা ফোর্স৭৫তম রেঞ্জার রেজিমেন্ট, যাদের আকাশ থেকে সহায়তা প্রদান করছিরো মার্কিন সেনাবাহিনীর-ই ১৬০তম স্পেশাল অপারেশন্স এভিয়েশন রেজিমেন্ট ও পাঁচজন নেভি এসইএএল অপারেটর। এছাড়াও সহায়তা করেছিলো মার্কিন বিমান বাহিনীর এয়ার ফোর্স প্যারাসিকিউরকমব্যাট কন্ট্রোলার দল। এই ত্বরিত অপারেশনে ব্যবহৃত হয়েছিলো ১৯টি যুদ্ধবিমান (বেশিরভাগই হেলিকপ্টার), ১২টি যানবাহন (বেশ কয়েকটি হামভিসহ), এবং ১৬০জন সৈন্য।

অপারেশনের সময় দুইটি মার্কিন ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার রকেট চালিত গ্রেনেডের কপলে পড়ে ভূপাতিত হয়। এছাড়া আরও তিনটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু সৈন্য আহতদের উদ্ধার করে মূল কম্পাউন্ডে ফিরে আসতে সমর্থ হলেও বাকিরা হেলিকপ্টার ধ্বংসের স্থানে আটকা পড়ে। পরবর্তীতে তাদের উদ্ধারের প্রচেষ্টার্থে রাতব্যাপী যুদ্ধ চলে।

পরের দিন ভোরে, জাতিসংঘের মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন দেশের সৈনিকদের একটি দল আটকে পড়া সৈনিকদের রক্ষার্থে রওনা হয়। বিভিন্ন দেশের সৈন্যদের মধ্যে ছিলো পাকিস্তান, ও মালয়েশিয়া। এছাড়াও মার্কিন ১০তম মাউন্টেন ডিভিশনের সৈন্যরাও তাদের সাথে উদ্ধার অভিযানে রওনা হয়। তাদের যুদ্ধযানের সংখ্যা ছিলো প্রায় ১০০। এর মধ্যে ছিলো পাকিস্তানি ট্যাংক (এম৪৮ প্যাটন) ও মালয়েশীয় ট্যাংক কন্ডর আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (APC)। এদেরকে সহায়তা করার জন্য আকাশে ছিলো মার্কিন এ/এমএইচ-৬ লিটল বার্ড, এবং ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার। এই টাস্ক ফোর্স প্রথম হেলিকপ্টার ধ্বংসের স্থানে যায়, এবং সেখানে আটকে পড়া সৈন্যদের উদ্ধার করে। দ্বিতীয় হেলিকপ্টার ধ্বংসের স্থানের একমাত্র জীবিত সৈন্য আহত পাইলট মাইক ডুরান্ট সোমালি মিলিশিয়াদের হাতে বন্দী হয়, যদিও পরবর্তীকালে কিছু দিন পর তিনি মুক্তি পান।

এই যুদ্ধে নিহত সোমালির প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। মার্কিন হিসাবে এই নিহতের সংখ্যা ১,০০০ থেকে ১,৫০০-এর মধ্যে। এই সংখ্যা সোমালি মিলিশিয়া ও বেসামরিক নাগরিকসহ। এছাড়াও আহতের সংখ্যা প্রায় ৩,০০০ থেকে ৪,০০০। যদিও আন্তর্জাতিক সংগঠন রেডক্রসের হিসাবে প্রায় ২০০ বেসামরিক সোমালি এই যুদ্ধে নিহত হয়, এবং আরও কয়েকশত বেসামরিক নাগরিক আহত হন।[৫] এই যুদ্ধের ওপর লেখা বই ব্ল্যাক হক ডাউন: আ স্টোরি অফ মডার্ন ওয়ার-এ আনুমানিক নিহতের সংখ্যা বলা হয় ৭০০ সোমালি মিলিশিয়ার। এছাড়াও আরও ১,০০০ আহত হয়েছিলো বলে জানানো হয়। পরবর্তীতে মার্কিন টেলিভিশনে সোমালি ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের এক তথ্যচিত্রে দাবি করা হয় সম্পূর্ণ যুদ্ধে মাত্র ১৩৩ জন সোমালি প্রাণ হারিয়েছিলো।[৬] দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার প্রতিবেদনে সোমালি নিহতের সংখ্যা ৩১২জন ও আহতের সংখ্যা ৮১৪জন উল্লেখ করা হয়।[১] এই যুদ্ধে নিহত মার্কিন সৈন্যের সংখ্যা ছিলো ১৮ ও আহত হয়েছিলো ৭৩ জন। দুই দিন পর মোগাদিশুর অপর এক মর্টার হামলায় আরও একজন মার্কিন সৈন্য নিহত ও একজন আহত হয়। জাতিসংঘের সৈন্যের মধ্যে শুধু মালয়েশিয়ার একজন সৈন্য নিহত হয়, ও অপর ৭ মালয়েশীয় সৈন্য ও ২ পাকিস্তানি সৈন্য আহত হয়।

আরও দেখুন সম্পাদনা

টীকা সম্পাদনা

  1. Rick Atkinson (জানুয়ারি ৩১, ১৯৯৪)। The Washington Post  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  2. red cross, red cross (অক্টোবর ১৮, ১৯৯৩)। "Anatomy of a Disaster"। Time Magazine। জানুয়ারি ১৮, ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১৯, ২০০৮  অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
  3. Bowden, Mark (নভেম্বর ১৬, ১৯৯৭)। "Black Hawk Down: A defining battle"। The Philadelphia Inquirer। জুলাই ১, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৫, ২০০৭ 
  4. frontline: ambush in mogadishu: interviews: captain haad.
  5. Anatomy of a Disaster - TIME ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ জানুয়ারি ২০০৮ তারিখে.
  6. PBS - frontline: ambush in mogadishu.

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  • Bowden, Mark, Black Hawk Down: A Story of Modern War, Atlantic Monthly Press (1999)
  • SGT James Patrick O'Connell, Survivor Gun Battle Mogadishu, US Army Special Forces. (New York City) (1993)
  • Clarke, Walter, and Herbst, Jeffrey, editors, Learning from Somalia: The Lessons of Armed Humanitarian Intervention, Westview Press (1997)
  • Gardner, Judith and el Bushra, Judy, editors, Somalia - The Untold Story: The War Through the Eyes of Somali Women, Pluto Press (2004)
  • Prestowitz, Clyde, Rogue Nation: American Unilateralism and the Failure of Good Intentions, Basic Books (2003)
  • Sangvic, Roger, Battle of Mogadishu: Anatomy of a Failure, School of Advanced Military Studies, U.S. Army Command and General Staff College (1998)
  • Stevenson, Jonathan, Losing Mogadishu: Testing U.S. Policy in Somalia, Naval Institute Press (1995)
  • Stewart, Richard W., The United States Army in Somalia, 1992-1994, US Army Center for Military History (2003)
  • Somalia: Good Intentions, Deadly Results, VHS, produced by KR Video and The Philadelphia Inquirer (1998)