মুহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী

বাঙালী সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী (১৮৯৪-১৯৫১) ছিলেন একজন সাহিত্যিক, গবেষক, সাংবাদিকরাজনীতিবিদ[১]

মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী।
জন্ম১৮৯৪
মৃত্যু২৬ মার্চ ১৯৫১
শাহ ওমরাবাদ, চকরিয়া
সমাধিশাহ ওমরাবাদ
নাগরিকত্বব্রিটিশ বাঙালি, পাকিস্তানি বাঙালি
পেশাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষকরাজনীতিবিদ
উল্লেখযোগ্য কর্ম
চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব, রোস্তম সোহরাব, যবনবধ কাব্য, মহাকোরান কাব্য, জরিনা, উপেন্দ্রনন্দিনী, নুরুন্নেহার, মেহেরুন্নেছা, প্রণয় প্রদীপ, চট্টগ্রামের ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রামী ও রোমাইতত্ত্ব প্রভৃতি সাহিত্যকর্ম এবং সাধনা, কক্সবাজার হিতৈষী, মোসলেম জগৎ, রক্তকেতু প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা ।
রাজনৈতিক দলমুসলিম লীগ, জেইউএল
আন্দোলনব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন
সন্তান
  1. মাশুক আহমদ সিদ্দিকী
  2. আবদুল ওহাব সিদ্দিকী
  3. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী
  4. শাহাবুদ্দিন সিদ্দিকী
  5. জসিম উদ্দিন সিদ্দিকী
  6. মহিউদ্দিন সিদ্দিকী
  7. মরহুম জহিরুল ইসলাম সিদ্দিকী
  8. মতিন উদ্দিন সিদ্দিকী ও চার কন্যা।

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী ১৮৯৪ সালে কক্সবাজারের চকরিয়ার কাকারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবদুর রশিদের পিতামহ প্রখ্যাত আলেম আহমদ আলী ধর্মপ্রচারে বেরিয়ে কক্সবাজার জেলার চকোরিয়া উপজেলার কাকরা গ্রামে হিজরত করেন। সেখানেই জন্ম হয় মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর। ছোটবেলা থেকেই তিনি বটতলার পুঁথি পাঠের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। বেশ কিছু ফারসি কেতাবও পাঠ করেন আবার ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে কিছুদিন কক্সবাজার মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে ( বর্তমানে কক্সবাজার সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়) পড়াশোনা করে আবার নিজ গ্রামের মধ্যবাংলা বিদ্যালয়ে ফিরে যান । কাজেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মধ্যবাংলা বিদ্যালয় পর্যন্ত বলা যায়।।[২]


সাংবাদিকতা সম্পাদনা

তিনি পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে আগমন করেন। ১৯১৯ সালে (বৈশাখ ১৩২৬ বঙ্গাব্দ) তিনি সাধনা নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কিছুকাল এই পত্রিকার যুগ্মসম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন লেখকের রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটি চার বছর টিকে ছিল।[২]

তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ও পরিচালনায় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে (১৩২৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ) প্রকাশিত হয় ভারতবর্ষের প্রথম মুসলিম নারী সম্পাদিত বাংলা পত্রিকা আন্নেসা (মাসিক)। পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে স্ত্রী সফিয়া খাতুনের নাম উল্লেখ থাকলেও, পত্রিকাটি কার্যত মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ সিদ্দিকীই সম্পাদনা ও পরিচালনা করতেন । পত্রিকাটি ১বছর টিকে ছিল।

১৩২৯ বঙ্গাব্দের ১৬ শ্রাবণ তার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে মোসলেম জগত প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত তার লেখা সময় থাকিতে সাবধান, বুঝে চল ব্রিটিশ শীরষক সম্পাদকীয়র জন্য তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯২৬ সালে তিনি রক্তকেতু নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।[২]

গবেষণা সম্পাদনা

তিনি ভাষার উপর গবেষণা করেছেন। চট্টগ্রামের ভাষার উপর ভাষাতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার লেখা চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব (১৯৩৫), চট্টগ্রামের ভাষাতত্ত্ব, চট্টগ্রামী ও রোমাইতত্ত্ব গ্রন্থ রয়েছে।অন্যান্য গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে উষাতারা (পৃথিবীর জীবনী), হিন্দু মোসলমান (ধর্ম সম্পর্কে তর্ক)।[৩]

সাহিত্য সম্পাদনা

সমাজ সচেতন কবি ও কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে সাতটি উপন্যাস, ১২টি কাব্য, ৩টি গবেষণা ও ২টি প্রবন্ধগ্রন্থ, একটি জীবনীগ্রন্থ, দুইটি অনুবাদগ্রন্থ ও একটি আত্মজীবনী রচনা করে বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আসে। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে:
কাব্য:
১. রুস্তম সোহরাব (১৯ শে ১৯১৬), প্রকাশক: কে.বি বসু, মিন্টু প্রেস, চট্টগ্রাম।
২. বাঙ্গালা মৌলুদ শরীফ (১৩২৪), প্রকাশক: মোহাম্মদী বুক এজেন্সী, কলকাতা।
৩. কলির বাঙ্গালা (১৯১৭)
৪. চিন্তুার ফুল (১৯১৮), প্রকাশক: মখদুমী লাইব্রেরি, কলকাতা।
৫. চিত্তদর্পণ (১৩৪৪)
৬. যবনবধ কাব্য (১৩৫১), প্রকাশক: গ্রন্থকার।
৭. মহাযুদ্ধ ও ভারতবাসী (পদ্য)
৮. পাকিস্তান বিজয়কাব্য (১৩৫৫), প্রকাশক: এম.আহমদ ছিদ্দিকী এ্যাণ্ড ব্রাদার্স, চকরিয়া।
৯. প্রেমপুঞ্জ (কবিতা)
১০. সমাজচিন্তা(পদ্য)
১১.মহাভুল সংশোধনী (পদ্য)
১২. মুক্তার ছড়া (গদ্য ও পদ্য)

উপন্যাস:
১. জরিনা (১৩২২), প্রকাশক: তাজমুল বুক ডিপো, কলকতা। ২. নুরুন্নেহার, প্রকাশক: মুখদুমী লাইব্রেরী, কলিকতা। ৩. মেরেুন্নেছা (১৯১৮) প্রকাশক: মুখদুমী লাইব্রেরি, কলকাতা। ৪. উপেন্দ্রনন্দিনী (১৩২৬), প্রকাশক: আবদুল আজিজ খান, কলিকাতা। ৫. প্রণয় প্রদীপ (১৩২২), সাধনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ৬. আমীর হামজা, অমুদ্রিত, বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষিত ৭. গন্ধর্ব দুহিতা ৮. পদ্মিনী
ভাষাতত্ত্ব/গদ্য/আলোচনা:
১. চট্টগ্রামী ও রোমাইতত্ত্ব (১৯২৯), প্রকাশক: ওছমানিয়া লাইব্রেরি, কলকতা।
২. চট্টগ্রামের ভাষাতত্ত্ব ((১৯৩৫), প্রকাশক: ওছমানিয়া লাইব্রেরি, কলকতা।
৩. চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব (ব্যাকরণ সংবলিত), ১৩৫৩ বঙ্গাব্দ, প্রকাশক: এম. আবদুর রশিদ সিদ্দিকী।
৪. উষাতারা (পৃথিবীর জীবনী)
৫. হিন্দু মোসলমান
জীবনী:
১. হযরত আমীর হামজার জীবনী
আত্মজীবনী:
১. সংক্ষিপ্ত জীবনী, ১৩৩০, অপ্রকাশিত। বাংলা একাডেমি ও অধ্যাপক শফিউল আলমের কাছে জমা আছে।

অনুবাদ:
১. মহাকোরআন কাব্য (আমপারা খণ্ড), ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৭, প্রকাশক: মোহাম্মদ মাশুক আহমদ ছিদ্দিকী, চকরিয়া।
২. সত্য সন্ধান।[৪]

রাজনীতি সম্পাদনা

তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত মোসলেম জগত পত্রিকায় বুঝে চল ব্রিটিশ সাবধান শীর্ষক সম্পাদকীয় লিখার কারণে ব্রিটিশের রোষানলে পড়েন এবং কলকাতাস্থ বাসা থেকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করে। ১৯৩৮ সালে তিনি চকরিয়া থানা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি এবং কক্সবাজার মহকুমা মুসলিম লীগের সহসভাপতি হন। তিনি দীর্ঘদিন কাকারা ইউনিয়ন বোর্ডের সভাপতি ছিলেন।[২] ম্যাকডোনাল্ড রোয়েদাদ অনুযায়ী শাসন সংস্কারের ব্যবস্থা করে বৃটিশ সরকার। তারই ফল ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন (Govt. of India Act of 1935)’র অধীনে ভোটাধিকার ও আইন সভার সদস্য সংখ্যার যথেষ্ট বৃদ্ধি এবং স্বায়ত্বশাসন প্রবর্তন প্রাদেশিক পর্যায়ে সরকার গঠনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৭ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রাদেশিক ও বঙ্গীয় বিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলায় মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ১১৭টি আসনে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ নির্বাচনে কক্সবাজার আসনে খান বাহাদুর জালাল উদ্দিন আহমদ চৌধুরী ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ (কেপিপি) থেকে এবং সাংবাদিক-সাহিত্যিক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী মুসলিম লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কক্সবাজার মহকুমার ২৮ হাজার ৩৮৭ ভোটের এ আসনে মুসলিম লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকীকে ৩০৫ ভোটে হারিয়ে খান বাহাদুর জালাল আহমদ চৌধুরী জয়লাভ করেন। খান বাহাদুর জালাল উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোট ৩৭৫৮ আর আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর প্রাপ্ত ভোট ৩৪৫৩। পাকিস্তান আন্দোলনকে ইস্যু করে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কক্সবাজার আসনে জিইউএল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী পেকুয়ার জমিদার কবির আহমদ চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দুর রহমান ওয়ারেসিকে ১৫৩৮৮ ভোটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী কবির আহমদ চৌধুরী ১৮৮৮৫ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দুর রহমান ৩৪৯৭ এবং আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী ১৫৭ ভোট পান। ঊর্ধ্বলিপির লেখা [১]

অন্যান্য কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

বেগম খোশ নামক একটি পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধ বের করার ফলে তিনি প্রচুর সম্পদ অর্জন করেন। নিজ গ্রামে তিনি মাদ্রাসা, গ্রামরক্ষক সমিতি, পল্লীমঙ্গল সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন।[২]

মৃত্যু সম্পাদনা

মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী ১৯৫১ সালের ২৬ মার্চ নিজ গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন।[২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. আজাদ, কালাম (২০১৪)। মুক্তিসংগ্রামে কক্সবাজার : প্রসঙ্গ রাজনীতি। কক্সবাজার: কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। পৃষ্ঠা ১২৭–১২৮। আইএসবিএন 978-984-91612-0-2 
  2. মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী, বাংলাপিডিয়া
  3. আলম, শফিউল (ফেব্রুয়ারি ১৯৯০)। মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী। ঢাকা: বাংলা একাডেমী। 
  4. আলম, শফিউল (ফেব্রুয়ারি ১৯৯০)। মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী (প্রথম সংস্করণ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলা একাডেমী। পৃষ্ঠা ৮১-৮৭।