মার্কণ্ডেয়
মার্কণ্ডেয় (সংস্কৃত: मार्कण्डेय) ছিলেন একজন প্রাচীন হিন্দু ঋষি। তিনি ঋষি ভৃগুর বংশে জাত। মার্কণ্ডেয় শিব ও বিষ্ণু উভয় দেবতারই এক বিশিষ্ট ভক্ত। একাধিক পুরাণে তার উল্লেখ রয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ ঋষি মার্কণ্ডেয় ও জৈমিনীর কথোপকথনের আকারে রচিত। ভাগবত পুরাণ-এরও কিয়দংশ মার্কণ্ডেয়র কথোপকথন ও প্রার্থনার সংকলন।[১] মহাভারত-এও মার্কণ্ডেয়ের উল্লেখ রয়েছে।[২] সকল মূল শাখার হিন্দু সম্প্রদায়গুলির কাছেই মার্কণ্ডেয় এক শ্রদ্ধেয় ঋষি।

বর্তমানে উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলায় যমুনোত্রী মন্দিরের ট্রেকিং রুটে মার্কণ্ডেয় তীর্থ নামে একটি স্থান অবস্থিত। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এখানেই মার্কণ্ডেয় তার মার্কণ্ডেয় পুরাণ গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন।[৩]
পৌরাণিক উপাখ্যান
সম্পাদনাঋষি মার্কণ্ডেয় সম্পর্কে প্রচলিত জনপ্রিয় উপাখ্যানটি নিম্নরূপ:
মৃকণ্ডু ঋষি ও তার পত্নী মরুদবতী পুত্রকামনায় শিবের আরাধনা করেন। তাদের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব তাদের সম্মুখে উপস্থিত হন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তারা কেমন পুত্র চান – দীর্ঘজীবী মূর্খ পুত্র না ক্ষণজীবী জ্ঞানী পুত্র। মৃকণ্ডু ঋষি ক্ষণজীবী জ্ঞানী পুত্রই চান। জন্ম হয় মার্কণ্ডেয়ের।
মার্কণ্ডেয়ের আয়ু ছিল মাত্র ষোলো বছরের। সে ছিল শিবের ভক্ত। ষোড়শ বছরে পদার্পণ করার পর যখন তার মৃত্যুকাল আসন্ন, তখন সে একটি শিবলিঙ্গ গড়ে পূজায় বসে। যম তাকে নিয়ে যেতে এলে সে সেই শিবলিঙ্গ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে। যম তার রজ্জু দিয়ে মার্কণ্ডেয়কে বন্ধন করলে, মার্কণ্ডেয় শিবলিঙ্গটিকে আঁকড়ে ধরে এবং শিবের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে। ভক্তবৎসল শিব ভক্তের দুর্দশা দেখে শিবলিঙ্গ থেকে আবির্ভূত হন। ক্রুদ্ধ শিব আক্রমণ করেন যমকে। যম পরাভূত হন এবং মার্কণ্ডেয়ের উপর তার দাবি ত্যাগ করে ফিরে যান। শিব যমকে পরাজিত করে মৃত্যুঞ্জয় নামে পরিচিত হন। শিবের বরে মার্কণ্ডেয় অমরত্ব লাভ করেন।
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র মার্কণ্ডেয়ের রচনা মনে করা হয়।[৪] তামিলনাড়ুর তিরুক্কদাভুর মন্দিরে শিবের যমবিজয়ের ধাতুচিত্র রয়েছে।[৫] নৃসিংহ পুরাণ গ্রন্থেও একই প্রকার একটি কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এই কাহিনি অনুযায়ী, মার্কণ্ডেয় কর্তৃক মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠের পর বিষ্ণু যমের হাত থেকে মার্কণ্ডেয়কে রক্ষা করেছিলেন।[৬]
ভাগবত পুরাণের উপাখ্যান
সম্পাদনাভাগবত পুরাণ গ্রন্থে উল্লিখিত কাহিনি অনুসারে, সমগ্র বিশ্ব জলময় হলে মার্কণ্ডেয় বিষ্ণুর স্তব করে তাকে উদ্ধার করার আবেদন জানান। বিষ্ণু পাতায় ভাসমান একটি বালকের বেশ ধরে এসে তাকে বলেন যে তিনিই সময় ও মৃত্যু। বালক ঋষিকে অনুরোধ করেন যে তিনি যেন নিজেকে ক্রমবর্ধমান জলরাশি থেকে উদ্ধার করতে বালকের মুখে প্রবেশ করেন। বালকের উদরে প্রবেশ করে সেখানে মার্কণ্ডেয় সেখানে বিশ্বচরাচর, সপ্তলোক ও সপ্ত মহাসমুদ্রের উপস্থিতি দেখতে পান। সকল পর্বত, রাজ্য ও জীব সেখানে বিদ্যমান ছিল। উদভ্রান্ত হয়ে মার্কণ্ডেয় বিষ্ণুর স্তব করতে থাকেন। সেই মুহুর্তেই বালকের মুখের বাইরে বেরিয়ে আসেন। বিষ্ণু তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে তাকে বর দেন। মার্কণ্ডেয় বালকরূপী বিষ্ণুর উদরে এক হাজার বছর কাটিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি বালমুকুন্দাষ্টকম্ স্তোত্র রচনা করেন।
কিংবদন্তি
সম্পাদনামার্কণ্ডেয় ছিলেন পরম ভক্ত। এদিকে পরাশর তাঁর ভক্তির জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। এ বিষয়ে একটি প্রচলিত কাহিনি আছে - যেখানে বলা হয়েছে পরাশরের ভক্তির কারণে সপ্তম বর্ষীয় বালক পরাশরকে প্রণাম করেছিলেন মার্কণ্ডেয় মুনি। এই কাহিনির বিবরণ দিয়েছেন ভাদুড়ী মহাশয় - মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ:
"কোন এক সময়ে বশিষ্ঠ মুনি তাহার তপোবনে ঋষিগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া উপবিষ্ট ছিলেন। বশিষ্ঠের ক্রোড়ে তাঁহার সপ্তম বর্ষীয় পৌত্র পরাশর সমাসীন। এমন সময়ে সপ্তযুগবর্ষীয় দীর্ঘায়ু মার্কণ্ডেয় মুনি তথায় উপস্থিত হইলেন। বশিষ্ঠের ক্রোড়ে পরাশরকে আসীন দেখিয়া মার্কণ্ডেয় সসম্ভ্রমে তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। অতিবৃদ্ধ মার্কণ্ডেয়কে সপ্তমবর্ষীয় বালক পরাশরকে প্রণাম করিতে দেখিয়া সভাস্থ সকলেই অবাক্ হইয়া গেলেন। তখন বালক পরাশর বলিলেন প্রভু! আপনার ন্যায় বৃদ্ধ মহামুনি আমার ন্যায় সপ্তমবর্ষীয় বালককে প্রণাম করিয়া কেন নিরয়গামী (নরকগামী) করিলেন ? তদুত্তরে মার্কণ্ডেয় বলিলেন— ‘সভাস্থ মুনিগণ’! আপনারা শ্রবণ করুন, যতটুকু সময় ভগবানের নামে ব্যয়িত হয়, সেইটুকুই আমাদের জীবনকাল— আর সময় আমাদের মৃত্যুকাল বুঝিতে হইবে। এই সপ্তমবর্ষীয় বালক পরাশরের সমস্ত সময় ভগবচ্চিন্তায় ব্যয়িত হইয়াছে, কিন্তু আমার পক্ষে ঐ সকল সুসময়ের সমষ্টি করিলে ৫ বৎসর হয় কিনা সন্দেহ। এই কারণে আমি পরাশরকে আমার অপেক্ষা অধিক বৃদ্ধ জ্ঞানে প্রণাম করিলাম।"
এই কাহিনিটি মার্কণ্ডেয়র ভক্তি, বিনয় এবং মহানুভবতার প্রমাণ বহন করে।
দেবীমাহাত্ম্যম্
সম্পাদনাশাক্তধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম্ মার্কণ্ডেয় পুরাণ গ্রন্থের অংশবিশেষ।[৮]
চলচ্চিত্র
সম্পাদনা- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে মার্কণ্ডেয় (ইংরেজি) (১৯২২)
- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে মার্কণ্ডেয় (ইংরেজি) (১৯৩৮)
- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে ভক্ত মার্কণ্ডেয় (ইংরেজি) (১৯৫৬)
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Srimad Bhagavatam, Canto 12, Chapter 8: Markandeya's Prayers to Nara-Narayana Rishi"। ১৪ মার্চ ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ মার্চ ২০১০।
- ↑ "The Wisdom of the Mahabharata"। ১৫ মার্চ ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ মার্চ ২০১০।
- ↑ Yamunotri Temple ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩১ জুলাই ২০০৯ তারিখে Uttarkashi district website.
- ↑ "Maha Mrityunjaya Stotram"। ১৪ জুন ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ মার্চ ২০১০।
- ↑ Kaala Samhaaram - The Story of Markandeya
- ↑ Narsimha Purana ch 7, 8.
- ↑ ব্রহ্মচারী, শ্রীমদ্ ভক্তিপ্রকাশ (জুলাই ২০১১)। শ্রীশ্রীনগেন্দ্র-উপদেশামৃত [ প্রথম খণ্ড ]। শ্রীশ্রী নগেন্দ্র মঠ, ২বি, রামমোহন রায় রোড, কলকাতা- ৯। পৃষ্ঠা ২০৯।
- ↑ Biographies,Sages, Rushis And Saints at FreeIndia[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- Dictionary of Hindu Lore and Legend (আইএসবিএন ০-৫০০-৫১০৮৮-১) by Anna Dallapiccola
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা