মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড
মারিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড বা মারিচঝাঁপির ঘটনা ১৯৭৯ সালে দেশভাগ-পরবর্তী বাংলা থেকে আসা শরণার্থীদের মারিচঝাঁপি দ্বীপের (সুন্দরবন, পশ্চিমবঙ্গ) সুরক্ষিত বনভূমিতে গড়া বসতি উচ্ছেদ করার ঘটনা। এই শরণার্থীরা ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে অবস্থিত দণ্ডকারণ্যের শিবির থেকে এখানে এসেছিল।[১][২] সতি উচ্ছেদ করার সময় পুলিশের সঙ্গে বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে, অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়া হয় এবং এতে অনেক প্রাণহানি ঘটে।[৩][৪]
মরিচঝাঁপি ঘটনা | |||
---|---|---|---|
তারিখ | ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৯ | – ১৮ মে ১৯৭৯||
অবস্থান | ২২°০৬′২৫″ উত্তর ৮৮°৫৭′০৪″ পূর্ব / ২২.১০৭০° উত্তর ৮৮.৯৫১০° পূর্ব | ||
পক্ষ | |||
| |||
ক্ষয়ক্ষতি | |||
নিহত | ২–৮ |
পটভূমি
সম্পাদনাবঙ্গ বিভাজনের সময় এবং এর পরে, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে বাঁচতে বহু মানুষ পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসে। প্রথম দফায় আসা শরণার্থীদের বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত হিন্দু ছিল এবং তারা পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসিত হতে পেরেছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গরিব বাঙালিদের স্রোত বাড়তে থাকে। এই স্রোত ১৯৭০-এর দশকে, বিশেষত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, তীব্র আকার ধারণ করে।
সেসময় রাম নিওয়াস মির্ধা লোকসভায় বলেন "পশ্চিমবঙ্গ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য তাদের অন্যত্র স্থানান্তর করা অনিবার্য।"[৫] তবে জলাভূমি ও উপকূলীয় অঞ্চলের শরণার্থীরা তাদেরকে অনুর্বর এবং শুষ্ক জমিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রাথমিক প্রতিরোধ সত্ত্বেও, তাদের জোরপূর্বক দণ্ডকারণ্য প্রকল্পের অধীনে ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ের রুক্ষ এবং অনুর্বর জমিতে, উত্তরপ্রদেশের (বর্তমান উত্তরাখণ্ড) তরাই অঞ্চলে এবং ক্ষুদ্র আন্দামানে পাঠানো হয়। সেখানে শরণার্থীরা শিবিরে দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হয়।[৬][৭]
বামফ্রন্ট নেতারা, যেমন, রাম চট্টোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের এই পুনর্বাসন নীতির বিরোধিতা করেন। তারা দণ্ডকারণ্যের শিবিরে গিয়ে শরণার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে বামফ্রন্ট যদি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে, তবে সকল শরণার্থীকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসন করা হবে।[১][৩]
ঘটনা
সম্পাদনা১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দণ্ডকারণ্য শিবির থেকে শরণার্থীরা স্বতন্ত্র বাংলাদেশে বড় সংখ্যায় ফিরতে শুরু করে।[৭] শরণার্থীদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১,৩৬,০০০ এবং বামফ্রন্ট সরকার সুন্দরবনের (গঙ্গা বদ্বীপ) প্রায় ২,৪৭,০০০ একর পুনর্দখলযোগ্য জমি চিহ্নিত করে। এই জমিগুলি মূলত কৃষিজীবী শরণার্থী যারা পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে এসেছিল জন্য পুনর্বাসনের জন্য এসেছিলো তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়।[১][৩] প্রথম দিকে সরকার এই চিহ্নিত জমিগুলিতে শরণার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী পুনর্বাসনকে অনুমোদন ও উৎসাহিত করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শরণার্থী অনুমোদনবিহীন জমিতেও বসতি স্থাপন করে।[২][৩] প্রায় ৪০,০০০ শরণার্থী হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ এবং গেঁওখালিতে বসবাস শুরু করে এবং প্রায় ১৫,০০০ শরণার্থী মারিচঝাঁপি দ্বীপে বসতি স্থাপন করে এবং তারা দ্বীপটিকে তারা "নেতাজি নগর" নামে পুনঃনামকরণ করে। এই দ্বীপটি সংরক্ষিত বন আইন অনুযায়ী রক্ষিত এলাকা ছিল।[১]
তবে কিছু সময় পর বামফ্রন্ট সরকার শরণার্থীদের পুনর্বাসন বিষয়ে তাদের নীতি পরিবর্তন করে। তাদের অবস্থান ছিল যে শরণার্থীরা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক নয়, তারা ভারতের নাগরিক এবং তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সমগ্র দেশকেই নিতে হবে।[৬]
মারিচঝাঁপিতে শরণার্থীরা নিজেদের জন্য মাছ শিকার করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এবং নিজেরাই স্কুল ও ক্লিনিক তৈরি করে। তবে শস্য ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য তাদের পার্শ্ববর্তী দ্বীপে যেতে হতো। এক শরণার্থী পরে বলেন যে, তারা দ্বীপে আসার সময় সেখানে শুধু ঝোপঝাড় ছিল। সরকার এই বসতিগুলিকে সংরক্ষিত বনভূমির অবৈধ দখল হিসেবে গণ্য করে এবং একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যে, পরবর্তী শরণার্থী আগমন পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। সরকার শরণার্থীদের দ্বীপ খালি করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে।[৮]
১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ সরকার মারিচঝাঁপি দ্বীপের চারপাশে সিআরপিসির ১৪৪ ধারা জারি করে। শরণার্থীদের উচ্ছেদের জন্য ৩০টি পুলিশ নৌকা আনা হয় এবং তারা দ্বীপের চারপাশে টহল দিতে শুরু করে।[৮] ৩১ জানুয়ারি প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শরণার্থীরা ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র নিয়ে পুলিশের শিবিরে আক্রমণ করলে পুলিশ দ্বীপের হিন্দু শরণার্থীদের ওপর গুলি চালায়।[৯] এরপর পুলিশ ও জেলা প্রশাসন সম্পূর্ণ অবরোধ শুরু করে। এতে দ্বীপবাসীরা খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল পাওয়ার সুযোগ হারায়। অনেকেই দূষিত জল পান করে, যার ফলে কমপক্ষে কয়েক ডজন মৃত্যু হয়।[১০]
ধর্মীয় সংস্থা আনন্দ মার্গকেও এই সংঘর্ষের পেছনে দায়ী বলে সন্দেহ করা হয়।[১১] এই সংগঠনটি অঞ্চলটিতে সক্রিয় ছিল এবং স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রায়শই সংঘর্ষে লিপ্ত হতো।[১২] ১৫ দিন পর কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয় যে, "মারিচঝাঁপিতে পানীয় জল, প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ এবং চিকিৎসকদের প্রবেশাধিকার প্রদান করতে হবে।"[১২]
কিছু শরণার্থীকে জোরপূর্বক দণ্ডকারণ্যে স্থানান্তরিত করা হয়, অন্যদের পুলিশি নৌকায় করে হাসনাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কিছু অংশ বারাসাতের কাছে মারিচঝাঁপি কলোনিতে বসতি স্থাপন করে এবং বাকিরা শিয়ালদহ রেললাইনের পাশে বস্তিতে আশ্রয় নেয়।[১৩] কিছু শরণার্থী হিঙ্গলগঞ্জ, ক্যানিং এবং নিকটবর্তী এলাকায় পুনর্বাসিত হয়।[১৪]
সরকারি মৃত্যুর সংখ্যা প্রথমে ছিল মাত্র দুই।[১৫][১৫] এই ঘটনা গণমাধ্যম, বিরোধী দল এবং বামফ্রন্ট জোটের ভেতর থেকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে।[১] তবে উচ্ছেদের বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক তদন্তের দাবি সরকার প্রত্যাখ্যান করে এবং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিশ্বাস করেন যে ঘটনাটি গণমাধ্যম দ্বারা অতিরঞ্জিত হয়েছে।[১][৩] সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ থেকে ৮, যা অনেকের মতে প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। যথাযথ তদন্তের অভাবের কারণে পরবর্তীকালে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা অত্যুক্তি পূর্ণ বিবরণ প্রচারিত হতে থাকে।[১][৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ Mallick, Ross (১৯৯৯-০২-০১)। "Refugee Resettlement in Forest Reserves: West Bengal Policy Reversal and the Marichjhapi Massacre"। Journal of Asian Studies। 58 (1): 104–125। আইএসএসএন 0021-9118। ডিওআই:10.2307/2658391।
- ↑ ক খ Butalia, Urvashi (২০১৫-০২-২৪)। Partition। Penguin UK। আইএসবিএন 978-93-5118-949-7।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ Sengupta, Debjani (২০১১-০২-০১)। "From Dandakaranya to Marichjhapi: rehabilitation, representation and the partition of Bengal (1947)"। Social Semiotics। 21 (1): 101–123। আইএসএসএন 1035-0330। ডিওআই:10.1080/10350330.2011.535673।
- ↑ Halder, Deep (২০১৯-০৫-১১)। "The Left massacre of migrant Hindus in Bengal that was bigger than 2002 & 1984"। ThePrint (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ "The Statesman: 1979 Marichjhapi killings revisited"। web.archive.org। ২০১৪-১০-০৬। ২০১৪-১০-০৬ তারিখে আসল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ ক খ Chowdhury, Debdatta (২০১১-০৬-০১)। "Space, identity, territory: Marichjhapi Massacre, 1979"। The International Journal of Human Rights। 15 (5): 664–682। আইএসএসএন 1364-2987। ডিওআই:10.1080/13642987.2011.569333।
- ↑ ক খ Mallick, Ross (২০০৮)। Development policy of a communist government: West Bengal since 1977। Cambridge South Asian studies। Cambridge: Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-04785-2।
- ↑ ক খ Halder, Deep (২০১৯-০৫-১৭)। "'We were attacked thrice': A survivor's story of the Left Front government's siege of Marichjhapi"। Scroll.in (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ "The Telegraph - Calcutta (Kolkata) | Frontpage | Controversies that dogged the pragmatic chief minister"। web.archive.org। ২০১০-০১-২১। ২০১০-০১-২১ তারিখে আসল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ "Marichjhapi massacre: Forgotten story of Hindu refugees slaughtered in Bengal"। India Today (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-০৯-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ "Ananda Marga: Spiritual saviours or tantrik terrorists?"। India Today (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৩-০৯-২০। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ ক খ "Socialist and Peoples' History"। radicalsocialist.in (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৪-০৪-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ "গণহত্যার সুবিচার হবে! - সুকুমার মিত্র - The Sunday Indian"। web.archive.org। ২০১৩-০৬-২৩। ২০১৩-০৬-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ "আনন্দবাজার পত্রিকা - দক্ষিণবঙ্গ"। archive.ph। ২০১৩-০১-১৬। ২০১৩-০১-১৬ তারিখে আসল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
- ↑ ক খ "Bauddhayan Mukherji busy with his 'Marichjhapi' project"। The Times of India। ২০১৯-১১-২৭। আইএসএসএন 0971-8257। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০১-২৭।
আরও পড়ুন
সম্পাদনা- মণ্ডল, জগদীশ চন্দ্র (২০০২)। মারিচঝাঁপি: নৈশব্দের অন্তরালে। সুজন পাবলিকেশন্স।
- সেনগুপ্ত, সুখরঞ্জন (২০১০)। মারিচঝাঁপি: বিয়ন্ড অ্যান্ড উইদিন। ফ্রন্টপেজ পাবলিকেশন্স।
- হালদার, দীপ (২০১৯)। ব্লাড আইল্যান্ড: অ্যান ওরাল হিস্ট্রি অব দ্য মারিচঝাঁপি ম্যাসাকার। হার্পারকলিন্স পাবলিশার্স ইন্ডিয়া।