বিশ্ব ইজতেমা

তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বৈশ্বিক সমাবেশ

বিশ্ব ইজতেমা বা বিশ্ব ইজতিমা, প্রতিবছর সাধারণত বৈশ্বিক যেকোনো বড় সমাবেশ, কিন্তু বিশেষভাবে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বৈশ্বিক সমাবেশ, যা বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাবলিগ জামাতের এই সমাবেশটি বিশ্বে সর্ববৃহৎ, এবং এতে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। সাধারণত প্রতিবছর শীতকালে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়ে থাকে, এজন্য জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসকে বেছে নেয়া হয়।

ঢাকার নিকটবর্তী তুরাগ নদীর তীরে ইজতেমার তাঁবু।
আখেরি মোনাজাতের সময়
ঢাকা বিশ্ব ইজতেমার মুসুল্লীগণ-এর একাংশ
খিত্তার অভ্যন্তরীণ দৃশ্য

ব্যুৎপত্তি

সম্পাদনা

ইজতেমা' আরবি শব্দ যার অর্থ সম্মেলন, সভা বা সমাবেশ। 'বিশ্ব ইজতেমা' শব্দটি বাংলাআরবি শব্দের সম্মিলনে সৃষ্ট।

ইতিহাস

সম্পাদনা
 
ঢাকা বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে সমবেত মুসুল্লীগণ।

দিল্লীর নিজামুদ্দিন মসজিদের কাছে নূহ মাদ্রাসায় ১৯৪১ সালে সর্বপ্রথম তাবলিগ জামায়াতের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে প্রায় ২৫ হাজার মুসল্লি অংশ নেন। [] ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতি বছর এই সমাবেশ নিয়মিত আয়োজিত হয়ে আসছে।[] বাংলাদেশে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে ইজতেমা হয়, ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটা কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতিবছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে রমনা ‍উদ্যানের স্থলে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেওয়ায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান অবধি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলন বা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন।[] ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি [রহ.] ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামী দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মেলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে এই সমাবেশ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়।

প্রস্তুতি

সম্পাদনা

তারিখ নির্ধারণ

সম্পাদনা

পুরো সমাবেশস্থলটি একটি উন্মুক্ত মাঠ, যা বাঁশের খুঁটির উপর চট লাগিয়ে ছাউনি দিয়ে সমাবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়। শুধুমাত্র বিদেশী মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়ার ব্যবস্থা করা হয়। সমাবেশস্থলটি প্রথমে খিত্তা ও পরে খুঁটি নম্বর দিয়ে ভাগ করা হয়। অংশগ্রহণকারীগণ খিত্তা নম্বর ও খুঁটি নম্বর দিয়ে নিজেদের অবস্থান শনাক্ত করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাওয়ারি মাঠের বিভিন্ন অংশ ভাগ করা থাকে। বিদেশি মেহমানদের জন্য আলাদা নিরাপত্তাবেষ্টনীসমৃদ্ধ এলাকা থাকে, সেখানে স্বেচ্ছাসেবকরাই কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, কোনো সশস্ত্র বাহিনীর অনুপ্রবেশের অধিকার দেয়া হয় না।

সাধারণত তাবলিগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিন দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত বা মনোবাঞ্ছা পোষণ করেন। সে হিসাবেই প্রতিবছরই বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিনদিন জুড়ে। সাধারণত প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবার আমবয়ান ও বাদ জুমা থেকে বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতি বছরই এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বিশ্ব ইজতেমা প্রতিবছর দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেয় কাকরাইল মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় এবং তিনদিন করে আলাদা সময়ে মোট ছয়দিন এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।কিন্তু এতে করেও ব্যাপক মুসল্লিদের ঢল থাকায় ২০১৬ থেকে ৩২ টি জেলা নির্বাচন করে ইজতেমার কার্যক্রম অবিরত রাখা হয় । বাকি ৩২ জেলাদের ইজতেমা পরবর্তী বছর ধার্য করা হয় । সমাবেশ আ'ম বয়ান বা উন্মুক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হয় এবং আখেরি মোনাজাত বা সমাপণী প্রার্থণার মাধ্যমে শেষ হয়। অনেক সাধারণ মুসলমান তিনদিন ইজতেমায় ব্যয় করেন না, বরং শুধু জুমা'র নামাজে অংশগ্রহণ করেন কিংবা আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন; তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেন আখেরি মোনাজাতে। বাংলাদেশ সরকারের সরকার প্রধান (প্রধানমন্ত্রী), রাষ্ট্রপ্রধান (রাষ্ট্রপতি), বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্যান্য নেতা-নেত্রীরা আখেরি মোনাজাতে আলাদা-আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করেন।

 
২০১১ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা থেকে ঘরে-ফেরার জন্য রেলস্টেশেনে মানুষের ভিড়

আয়োজনের নিয়ম ও বিতর্ক

সম্পাদনা

স্থান সংকট এবং জনদুর্ভোগ বিবেচনা করে ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন করা হয়।[][][] ২০১৭ সালের নভেম্বরে মাওলানা জুবায়েরের অনুসারী ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদের দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্যে আসে।[][] এরপর ২০১৮ সালে দ্বন্দের ফলে মাওলানা সাদ কান্ধলভীকে একাংশের বিক্ষোভের মুখে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ না নিয়ে প্রথম পর্বের সময়ই দেশে ফিরে যেতে হয়। [][১০][১১][১২][১৩] পরবর্তীতে বিভক্ত তাবলীগ জামাতকে এক করা সম্ভব না হওয়ায় ২০১৯ সাল থেকে দ্বন্দের কারণে দুপক্ষের পৃথকভাবে ইজতেমা হয়ে আসছে।[১৪][১৫]

আখেরি মোনাজাত

সম্পাদনা

বিশ্ব ইজতেমার শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আখেরি মোনাজাত। প্রবল ধর্মচেতনায়র উদ্দীপনা নিয়ে মুসল্লিগণ আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন আর আমিন আমিন বলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আখেরি মোজাতের সময় টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীর যেন পরিণত হয় মুসল্লিদের জোয়ারে। আর আখেরি মোনাজাতের মধ্য বিশ্ব ইজতেমার মূল কার্যক্রম শেষ হয়।[১৬]

 
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণের জন্য ট্রেনে ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন লোকজন

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "বিশ্ব ইজতেমা শুরু – DW – 15.02.2019"dw.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  2. বাংলাপিডিয়া ওয়েব সংস্করণ। ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ মে ২০২০ তারিখে বিশ্ব ইজতেমা নিবন্ধ।
  3. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান (জানুয়ারি ২৪, ২০১৪)। "বিশ্ব ইজতিমার উৎপত্তি ও বিকাশ"। প্রথম আলো ডট কম। ২৯ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ 
  4. ডেস্ক, ধর্ম (২০২৩-০১-১৭)। "ইজতেমা যে কারণে দুই ভাগে হয়"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  5. "দু'দফায় শেষ হল বিশ্ব ইজতেমা – DW – 30.01.2011"dw.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  6. তাসলিম, নুরুদ্দীন (২০২৪-১২-১৮)। "তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব কী নিয়ে শুরু হয়েছিল?"dhakapost.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  7. "বিশ্ব ইজতেমা: তাবলীগ জামাতে দু'গ্রুপের দ্বন্দ্বের আসল কারণটা কী?"বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  8. প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০১৯-১১-০৫)। "এবারও সাদ ও জুবায়েরপন্থীদের আলাদা বিশ্ব ইজতেমা"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  9. "বাংলায় মোনাজাতে মুসল্লিদের তুষ্টি"। প্রথম আলো - ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ 
  10. "ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ কামনা" ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ কামনাপ্রথম আলো - ২২ জানুয়ারি ২০১৮ 
  11. "আখেরি মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য কামনা"www.kalerkantho.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  12. "মাওলানা সা'দকে দূরে রেখেই বিশ্ব ইজতেমা – DW – 11.01.2018"dw.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  13. বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম"হেলিকপ্টারে চড়ে বিশ্ব ইজতেমায় আহমদ শফী"হেলিকপ্টারে চড়ে বিশ্ব ইজতেমায় আহমদ শফী (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  14. রিপোর্টার, স্টাফ। "আমবয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমা শুরু"DailyInqilabOnline (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  15. "বিশ্ব ইজতেমা: বাংলাদেশে বিভক্ত তাবলীগ জামাতকে এক করা যাচ্ছে না কেন"বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-২৪ 
  16. আমিন, আল। "বিশ্বশান্তি কামনা করে ইজতেমার আখেরি মোনাজাত সম্পন্ন"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০১-১৮ 

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা

বিশ্ব ইজতেমার বয়ানসমূহের সরাসরি অডিও সম্প্রচার