বিশ্বরঞ্জন সেন (১৭ ডিসেম্বর ১৯০৭ – ২৩ অক্টোবর ১৯৯৬) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিরলস কর্মী ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের খ্যাতনামা নৈষ্টিক গান্ধীবাদী সমাজসেবক। [১]

বিশ্বরঞ্জন সেন
জন্ম(১৯০৭-১২-১৭)১৭ ডিসেম্বর ১৯০৭
খান্দারপাড়া, ফরিদপুর ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে বাংলাদেশ )
মৃত্যু২৩ অক্টোবর ১৯৯৬(1996-10-23) (বয়স ৮৮)
পরিচিতির কারণভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিরলস কর্মী ও সমাজসেবক
পিতা-মাতাসত্যেন্দ্রনাথ সেন (পিতা)
ছায়াময়ী দেবী (মাতা)

জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

বিশ্বরঞ্জন সেনের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খান্দারপাড়া গ্রামে। পিতা সত্যেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন কলকাতার সিটি কলেজের অধ্যাপক ও পরবর্তীতে (১৯৩০-৩৪) কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য। তার মাতা ছায়াময়ী দেবী ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক গিরিজাপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর কন্যা। বিশ্বরঞ্জনের বিদ্যালয়ের পাঠ শুরু হয় খুলনায়—প্রসিদ্ধ আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা তার জ্যেঠামশায় নগেন্দ্রনাথের কাছে। পড়াশোনায় তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর কলকাতায় আসেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। দর্শনশাস্ত্রে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনা

বিশ্বরঞ্জন ছাত্রাবস্থা থেকেই গান্ধীজির ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন এবং এই পত্রিকার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এম.এ ও আইন পড়া ছেড়ে দিয়ে অনেকের সঙ্গে আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চার বছরের কারাদণ্ড হয় এবং কারাবাসে বহু দৈহিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়। কিন্তু ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হলে ডায়মন্ড হারবারের গিয়ে প্রবীণ গান্ধীবাদী নেতা চারুচন্দ্র ভাণ্ডারীর খাদি মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজে অন্যতম সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন। আন্দোলন চলাকালে তিনি পুনরায় ছয় মাস কারারুদ্ধ হন এবং আড়াই বছর নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে আটক থাকেন। মুক্তি লাভের পর তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সংগঠিত দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালির অবস্থা মহাত্মা গান্ধীর 'শান্তি মিশন'র এক অগ্রদূত হিসাবে ঘুরে দেখে আসেন। এক সপ্তাহ আগে থেকেই তিনি সেখানকার মানুষদের মনে সাহস জোগান এবং দূর্গতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মানুষের এই সেবাকার্য করতে গিয়ে নানা বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় তাকে। এমনকি তার উপর ব্যক্তিগত আক্রমণ, অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল। এক সময় তাকে খুনের মামলায় আসামি করে ছয় মাস কারারুদ্ধ রাখা হয়েছিল। অবশ্য অবশ্য জামিনের আবেদন ছাড়াই তিনি নিজের দেওয়া বয়ানে বেকসুর মুক্তি পান। পরে নোয়াখালির পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক হলে 'শান্তি মিশন'-এর উদ্যোক্তা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত সহ অন্যান্যরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেলেও, বিশ্বরঞ্জন একাই নির্বান্ধব আত্মীয়-স্বজন বিহীন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দুস্থ মানুষের সেবার কাজে নোয়াখালিতেই থেকে যান।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের কার্যকলাপ সম্পাদনা

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পর তিনি প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে থেকে যান, নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। গৃহশিক্ষকতাই ছিল তার একমাত্র উপার্জনের উপায়। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে মানুষদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে বহু কেন্দ্র স্থাপন করেন চরকার প্রবর্তন ও কুটির শিল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানে আচার্য বিনোবা ভাবের পদযাত্রায় যুক্ত থেকে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। তার সমাজসেবামূলক কাজে পূর্ব পাকিস্তান আমলে বারবার কারালাচ্ছিত হতে হয়েছে। তার সমসাময়িকদের অনেকেই নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হন। তারা হলেন- অন্ধ্রপ্রদেশের প্রেম সমাজের সদস্য সত্যনারায়ণজি, খাদি প্রতিষ্ঠানের দেবেন্দ্রনাথ সরকার, হুগলির মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানীয় মানুষের কিছু দান এবং প্রধানত পশ্চিম জার্মানির 'বাংলাদেশ সাহায্য সমিতি'র দেওয়া লক্ষাধিক টাকার সাহায্যে 'চরকা ও কুটির শিল্প' প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিভাগ তার এই কাজের স্বীকৃতিতে ১৯৭৭ এবং ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণপদক প্রদান করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠান হতে সরে আসেন এবং বাংলাদেশের বৃহত্তম বেসরকারি গ্রামোন্নয়ন সংস্থা- বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি সংক্ষেপে ব্র্যাকের মাণিকগঞ্জ শাখায় যোগ দেন। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ব্র্যাক তাকে ভারতের কলকাতায় তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

জীবনাবসান সম্পাদনা

প্রচারবিমুখ অকৃতদার স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবক বিশ্বরঞ্জন ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ২৩ অক্টোবর প্রয়াত হন। তার ইচ্ছানুসারে তার মরদেহ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে শিক্ষা ও গবেষণার কাজে দান করা হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ২৬৭, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬