বাহমানি-বিজয়নগর যুদ্ধ (১৩৬২-৬৭)

লুয়া ত্রুটি মডিউল:অবস্থান_মানচিত্ এর 480 নং লাইনে: নির্দিষ্ট অবস্থান মানচিত্রের সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায়নি। "মডিউল:অবস্থান মানচিত্র/উপাত্ত/Karnataka" বা "টেমপ্লেট:অবস্থান মানচিত্র Karnataka" দুটির একটিও বিদ্যমান নয়।

১৩৬২ থেকে ১৩৬৭ সাল পর্যন্ত চলমান বাহমানি-বিজয়নগর যুদ্ধ,[৪] চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্য ভারতে বাহমানি সালতানাত এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংঘাত। বাহমানি শাসক প্রথম মুহম্মদ শাহ তার রাজ্যে বিজয়নগরের মুদ্রা নিষিদ্ধ করলে উভয় রাজ্যেই মুদ্রা গ্রহণ বিষয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এই পদক্ষেপটি বিজয়নগরের প্রথম বুক্কা রায়কে কানহাইয়ার ওয়ারঙ্গলের তৎকালীন শাসক মুসুনুরি নায়ক এবং স্থানীয় পোদ্দারদের সাথে একটি জোট গঠন করতে প্ররোচিত করে, যার ফলে বাহমানি মুদ্রা ধ্বংস হয় এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় যা সরাসরি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। এটি ছিল ভারতে প্রথম যুদ্ধ যেখানে ইউরোপীয়রা দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করেছিল এবং পদাতিক বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছিল।

সংঘাতটি আরও তীব্রতর হয় যখন বাহমানিরা ঘোড়া ব্যবসা নিয়ে বিরোধের ফলস্বরূপ ওয়ারাঙ্গলের রাজপুত্রকে মৃত্যুদন্ড দেয়। এই ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত ওয়ারঙ্গলকে প্রজারাষ্ট্রে পরিণত করে যার ফলে দুই শক্তির মধ্যে শত্রুতা আরও উসকে যায়। যুদ্ধ অগ্রগতির সাথে সাথে, মুদগাল এবং কাউথালে বিজয়নগর বাহিনীর উপর বাহমানিদের জয়লাভের ফলে বেসামরিক জনগণের মধ্যে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ১৩৬৭ সালে, মুহাম্মদ শাহ বিজয়নগর অবরোধ করেন যেখানে পরপর দুটি পরাজয়ের পর বুক্কা রায় আত্মগোপন করে এবং বিজয়নগরের জনসংখ্যাকে গণহত্যা করেন। শেষে বুক্কা রায় শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হন। তবে, সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। পরবর্তী যুদ্ধগুলি বিজয়নগরের সম্পদ এবং জনসংখ্যাকে আরও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। ওয়ারঙ্গলের শাসক কানহাইয়া এই অভিযানের সময় বাহমানি সুলতানকে বিখ্যাত তখত-এ-ফিরোজা সিংহাসন হাদিয়া পেশ করেন।

শেষ পর্যন্ত, উভয় পক্ষই একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতের সংঘাতে বেসামরিক গণহত্যা প্রতিরোধ করা, যা চতুর্দশ শতাব্দীর দাক্ষিণাত্য ভারতের সামরিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে চিহ্নিত করে। এ যুদ্ধটি তৎকালীন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে জটিল গতিশীলতা এবং এই অঞ্চলের বেসামরিক জনগণের উপর সংঘাতের বিধ্বংসী প্রভাবকে ফুটিয়ে তুলে।

পটভূমি সম্পাদনা

কান্নানুরের যুদ্ধে মাদুরাই সালতানাতের কাছে পরাজিত তৃতীয় বীর বল্লালের মৃত্যুর পর দক্ষিণ ভারতে হৈসল রাজবংশের পতনের পর, কতিপয় রাজকর্মকর্তা রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট ছিলেন তিনজন। তন্মধ্যে একজন ছিলেন প্রথম হরিহর যিনি মারাঠা অঞ্চল শাসন করতেন অপরজন প্রথম বুক্কা রায় যিনি হাম্পি এবং দ্বারসমুদ্র শাসন করতেন। তাদের ছোট দুই ভাই অন্য ছোটখাটো পদে অধিষ্ঠিত ছিল। আর বুক্কার পুত্র কম্পন ছিলেন হৈসল রাজার কামরা প্রধান। এই চার ভাতৃ এবং তাদের ভাতিজাই ছিলেন চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এদিকে, বাহমানিরা দাক্ষিণাত্যে তাদের ক্ষমতা সুসংহত করছিল এবং দিল্লির পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। প্রথম হরিহর ছিলেন বিজয়নগরের প্রথম রাজা। তিনি বাহমানি সালতানাতের আলাউদ্দিন বাহমান শাহের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। হরিহরের মৃত্যুর সময়, পাঁচ ভাতৃসংঘের মধ্যে একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি ছিলেন বুক্কা রায়। এদিকে দিল্লি সালতানাতের ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন ঘোষণা করেন যে তিনি দক্ষিণকে দিল্লির শাসনাধীনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন না, তখন বিজয়নগর এবং বাহমানীর শাসকরা এই উদ্বেগ থেকে স্বস্তি লাভ করে। এবং উভয়ের মাঝে স্বাধীনভাবে বৈরিতা তৈরী হয়।[৩] একই সময়ে, কনহাই নামে একজন শাসক, যিনি কনহাইয়া নায়ক[৫] বা কন্যা নায়ক নামেও পরিচিত ছিলেন,[১] যিনি কাকতীয় রাজবংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তিনি নিজেকে বিজয়নগর রাজ্যের মধ্যে মুসুনুরি নায়ক প্রধান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। [৬]

আলাউদ্দিন বাহমান শাহের ওফাতের পর তার পুত্র মুহাম্মদ শাহ প্রথম বাহমানি সালতানাতের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।[৭] প্রথম মুহাম্মদ শাহের শাসনামলে বাহমানী ও বিজয়নগরের মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হয়।[৮] সাধারণত, দুই রাজ্যের মধ্যে ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে তাদের দ্বন্দ্বকে ধর্মীয় যুদ্ধ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। যার ফলে ধারণা করা হয় যে বিজয়নগর সাম্রাজ্য বাহমানীদের ভ্যাসাল রাজ্য ছিল। আদতে এই ধারণাগুলি মধ্যযুগীয় যুগের অতিরঞ্জন ছিল। বাস্তবে, বাহমনি এবং বিজয়নগরের মধ্যে যুদ্ধগুলি ধর্মীয় প্রকৃতির কারণে হয় নাই, বরং সম্পদ এবং অঞ্চল অধিগ্রহণের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ একটি বৈরিতা ছিল। এই বৈরিতায় বাহমানিদের বিজয় সত্ত্বেও, বিজয়নগর কখনই কোনো সময়েই অঙ্গরাজ্যতার নতি স্বীকার করেনি।[৯]

প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর মধ্যে ভূমি প্রসারণ পশ্চিম চালুক্য, চোল, সেইসাথে যাদব এবং হৈসলসহ বিভিন্ন রাজবংশের মধ্যে বিবাদের একটি বিন্দু হয়ে উঠেছিল। হৈসল ও যাদব সাম্রাজ্য ইতোপূর্বে বাহমানী এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্যের দাবি করা অঞ্চলগুলির উপর শাসন করত। যখন এসব সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশ থেকে বাহমানী এবং বিজয়নগরের উদ্ভব ঘটে, তখন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তদুপরি, এই দুটি রাষ্ট্র গঠনের চারপাশের অনন্য পরিস্থিতি তাদের মধ্যে ঘন ঘন যুদ্ধকে একটি সাধারণ ঘটনা করে তুলে। সূচনাকালে, প্রতিটি রাজ্যই রায়চুর দোয়াব দূর্গের শুধুমাত্র কিছু অংশ অধিগ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে, তবুও পূর্বসূরিদের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসাবে উভয় রাজ্যই সমগ্র অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা করত।[৯]

ভূমিকা সম্পাদনা

সুলতান বাহমান শাহ তার শাসনামলে বিজয়নগরের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন নিষিদ্ধ করেন। জবাবে, বুক্কা রায়া বিদ্রোহ করেন এবং দাক্ষিণাত্যের পোদ্দারদের সমর্থনে বাহমানি মুদ্রা গলিয়ে দেন।[১০] বাহমানিরা এর বিরুদ্ধে পোদ্দারদের সতর্ক করে। ১৩৪০ সালের মধ্যেই বাহমানি অঞ্চলের সমস্ত পোদ্দার এবং টাকশালাদের বন্দী করে হত্যা করা হয়। তাদের বংশধরদের পরবর্তী চল্লিশ বছর ব্যবসা পরিচালনা করতে নিষিদ্ধ করা হয়। [১১]

 
আলাউদ্দিন বাহমান শাহের মুদ্রা

বিজয়নগরের রাজা বুক্কা রায়, সার্বভৌমত্বের চিহ্ন হিসাবে স্বর্ণমুদ্রা জারি করার বাহমানী দাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং রায়চুর দোয়াব দূর্গ বিজয়নগরের কাছে হস্তান্তর করার তলব করেন। এদিকে ওয়ারাঙ্গলের শাসক কানহাইয়া কৌলাসের দুর্গের দাবি করে বসেন, যা পূর্বে বাহমান শাহকে দেওয়া হয়েছিল। আবার তার পুত্র মুহাম্মদ শাহও পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এই দূর্গের দাবি করে বসে।[১] এদিকে বুক্কা রায় বাহমানিদেরকে দাক্ষিণাত্য আক্রমণ করার জন্য দিল্লি সালতানাতের জোটে যোগদানের হুমকিও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাহমানি সুলতান মুহাম্মদ শাহ প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত তার প্রত্যুত্তর দিতে বিলম্বিত করেন। অবশেষে যখন তিনি প্রতিক্রিয়া জানালেন, তখন তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে কেন তার অঙ্গরাজ্য বিজয়নগর তার অভিষেকের সময় তাকে উপহার পাঠাননি। এটি অন্তত একবার করা উচিত ছিল।[১১] মুহম্মদ শাহের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বিজয়নগর ও ওয়ারাঙ্গলের শাসকদেরকে বাহমানীদের বিরুদ্ধে জোট গঠনে উদ্বুদ্ধ করে।[৩]

পরবর্তীকালে, মুহাম্মদ শাহ সাফদার খান সিস্তানি এবং আজম-ই হুমায়ুনকে তার রাজধানীতে ডেকে পাঠান। তার মন্ত্রী মালিক সাইফুদ্দিন ঘোরীর কাছে প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পণ করে তিনি কৌলাসে যাত্রা করেন এবং আজম-ই হুমায়ুনকে বিদার ও মহুরের সৈন্যবাহিনী নিয়ে গোলকুন্ডায় প্রেরণ করেন। তিনি সাফদার খান সিস্তানিকে কানহাইয়ার রাজধানী ওয়ারাঙ্গলের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। যাইহোক, যখন কানহাইয়া বিজয়নগরের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে চলমান বিরোধের কারণে তিনি কিছুই পাননি।[১] আসন্ন হুমকি বুঝতে পেরে কানহাইয়া ভয় পেয়ে পাশের জঙ্গলে পালিয়ে যায়। শাহ দুই বছর তেলেঙ্গানায় অবস্থান করেন এবং ওয়ারাঙ্গল অবরোধ করেন।[১২] অবশেষে ১৩৬৪ সালে, কানহাইয়া শাহের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং তেরো কোটি সোনার হুন প্রদান করেন, এছাড়াও গোলকুন্ডাকে বাহমানীদের হাতে তুলে দেন। ফলশ্রুতিতে, তেলেঙ্গানার শাসক কানহাইয়া বাহমনিদের দাসে পরিণত হন।[৩][৯] কানহাইয়া বাহমানি সুলতানকে বিখ্যাত তখত-এ-ফিরোজা সিংহাসনও উপহার দেন। মুহম্মদ শাহ আজম-ই-হুমায়ুনকে গোলকুণ্ডার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Sherwani, Haroon Khan (১৯৮৫)। The Bahmanis of the Deccan (ইংরেজি ভাষায়)। Munshiram Manoharlal। পৃষ্ঠা 88–97। 
  2. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :3 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  3. Allan, John (১৯৬৪)। The Cambridge Shorter History of India (ইংরেজি ভাষায়)। S. Chand। পৃষ্ঠা 172। 
  4. Jaques, Tony (২০০৬-১১-৩০)। Dictionary of Battles and Sieges [3 volumes]: A Guide to 8,500 Battles from Antiquity through the Twenty-first Century [3 volumes] (ইংরেজি ভাষায়)। Bloomsbury Publishing USA। পৃষ্ঠা 516। আইএসবিএন 978-0-313-02799-4 
  5. Gibb, Hamilton Alexander Rosskeen (১৯৯৩)। The Encyclopaedia of Islam (ইংরেজি ভাষায়)। Brill। পৃষ্ঠা 458। আইএসবিএন 978-90-04-09419-2 
  6. Allan 1964, পৃ. 277।
  7. Sen, Sailendra (২০১৩-০৩-১৫)। A Textbook of Medieval Indian History (ইংরেজি ভাষায়)। Ratna Sagar P. Limited। পৃষ্ঠা 106–108। আইএসবিএন 978-93-80607-34-4 
  8. Sinha, Narendra Krishna; Banerjee, Anil Chandra (১৯৬৩)। History of India (ইংরেজি ভাষায়)। A. Mukherjee। পৃষ্ঠা 293। 
  9. Nizāmī, Khāliq Aḥmad; Habib, Muhammad (১৯৮২)। A Comprehensive History of India: The Delhi Sultanate, A.D. 1206-1526 (ইংরেজি ভাষায়)। People's Publishing House। পৃষ্ঠা 1046–1049। 
  10. Powell-Price, John Cadwgan (১৯৫৮)। A History of India from the Earliest Times to 1939 (ইংরেজি ভাষায়)। T. Nelson। পৃষ্ঠা 204। আইএসবিএন 978-90-70088-81-1 
  11. Allan 1964, পৃ. 172-173।
  12. Verma, Amrit (১৯৮৫)। Forts of India (ইংরেজি ভাষায়)। Ministry of Information and Broadcasting। পৃষ্ঠা 51।