বারদোলের মেলা
বারদোলের মেলা (ইংরেজি:Barodoler Mela) কৃষ্ণনগর তথা বাংলার অন্যতম বিখ্যাত মেলা এবং দীর্ঘকালের প্রাচীন ও বিশাল মেলা হিসাবে এর প্রসিদ্ধি আছে। প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার পর চৈত্রের শুক্লা একাদশী তিথিতে নদিয়ারাজের পোষকতায় কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর প্রাঙ্গণে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়।[১]
ইতিহাস
সম্পাদনাকৃষ্ণনগরে লোকশ্রুতি প্রচলিত যে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র (১৭১০-৮২) এই মেলার প্রবর্তক। কিন্তু এই সম্পর্কে কোনো পাথুরে প্ৰমাণ পাওয়া যায় না। যাঁরা এই বক্তব্য মানতে নারাজ তাদের বক্তব্য ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর লিখিত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে অনেক তথ্য থাকলেও বারদোল সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। অর্থাৎ মনে করা হয় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে এই মেলার প্রবর্তন হয়নি। প্রাসঙ্গিক উল্লেখ্য যে ১৭৪২-৫০ খ্রিষ্টাব্দে দেশে বর্গীদের দৌরাত্ম্য দেয়। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই সময় বর্গীদের ভয়েই শিবনিবাসে নদিয়ার রাজধানী নিয়ে যান। শিবনিবাসে ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বুড়োশিবের মন্দির এবং ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দে আরও চারটি মন্দির নির্মাণ করেন। ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শিবনিবাসে অবস্থানের পর ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে ফিরে আসেন। আবার কৃষ্ণচন্দ্র ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে গঙ্গাবাসে রাজপ্রাসাদাদি নির্মাণ করে সেখানেই আমৃত্যু সেখানে বসবাস করেন। বাংলা ১১৭৬ সনে অর্থাৎ ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে দেখা যায় মন্বন্তর। তাই অনুমান করা হয় যে, ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র রাজবাড়িতে ফেলার পর ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বারদোলের মেলার প্রবর্তন করেন।[১]
প্রেক্ষাপট
সম্পাদনাবারদোলের মেলা প্রবর্তনের পশ্চাতে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দু’জন মহিষী ছিলেন। দ্বিতীয়া মহিষী ছিলেন অশেষ রূপলাবণ্যময়ী ও গুনবতী (শিবনিবাসে রাজ্ঞীশ্বর শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক অনুযায়ী দ্বিতীয়া মহিষী হলেন ‘মুর্ত্তেব লক্ষ্মীঃ স্বয়ং’ অর্থাৎ মুর্তিমতী লক্ষ্মীর মতো)। কথা ছিল যে মহারাজ দ্বিতীয়া মহিষীকে নিয়ে উলায় (বীরনগরে) নদিয়ারাজ রাঘব রায় নির্মিত জলবাটিকায় কয়েকদিন থাকবেন। কিন্তু রাজকার্যে ব্যস্ত থাকায় কৃষ্ণচন্দ্র দেওয়া কথা রাখতে পারেন না। রাজমহিষী উলার যাতের মেলায় দেখতে চান, কিন্তু কোনোটিই সফল হয় না। তারই ফলপ্রসূ কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগরে এই মেলার প্রবর্তন করেন যাতে রাজমহিষী ও অন্যান্য অন্তঃপুরবাসিনীরা রাজবাড়ী থেকেই মেলা দেখতে পারেন।
নামকরণ
সম্পাদনাকারও কারও মতে, দোল পূর্ণিমার ১২ দিন পরে এই মেলা উদযাপিত হত, তাই এই নামকরণ। তবে এই ধারণা সম্পূর্ণই ভ্রান্ত। আসলে নদিয়ারাজের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবর্তিত এই মেলায় নদিয়ারাজ কুলবিগ্রহ বড়নারায়ণ ব্যতীত আরও বারটি কৃষ্ণ বিগ্রহ পূজিত হত। বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত এই বারটি বিগ্রহ এই মেলার সময় সমারোহ সহকারে কৃষ্ণনগরে আনা হত এবং তিনদিন নাটমন্দিরে থেকে বিগ্রহগুলির পূজার্চনা করা হত। বারটি বিগ্রহের জন্যই এর নাম বারদোলের মেলা রাখা হয়।
বিবরণ
সম্পাদনানদিয়ারাজ কুলবিগ্রহ হলেন বড়নারায়ণ। মেলায় বড়নারায়ণের সঙ্গে আরও বারটি কৃষ্ণ বিগ্রহ থাকেন যাঁরা নদিয়ারাজ কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত। বারদোলের মেলায় এই বারটি বিগ্রহকে মহাসমারোহে কৃষ্ণনগরে নিয়ে আনা হয়। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সুসজ্জিত, পঙ্খ অলংকৃত ঠাকুরদালানের চাঁদনী বা নাটমন্দিরে কৃষ্ণ বিগ্রহগুলি রেখে বারদোলের প্রথম তিনদিন পূজার্চনা করা হয়। পরে রাজবাড়ির দক্ষিণদিকের ঠাকুরদালানে বড়নারায়ণের সঙ্গে বিগ্রহগুলি রাখা হয়। একমাস পর বিগ্রহগুলি আবার যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে, এখন সব বিগ্রহ রাজবাড়িতে আসে না। তবুও সকলে এখন একে বারদোলের মেলাই বলে।[২]
বিগ্রহ
সম্পাদনানদিয়ারাজ কুলবিগ্রহ বড়নারায়ণ বাদে অন্যান্য বিগ্রহগুলি হল:
- বলরাম
- শ্রীগোপীমোহন
- লক্ষ্মীকান্ত
- ছোটনারায়ণ
- ব্রহ্মণ্যদেব
- গড়ের গোপাল (শান্তিপুরের অদূরে সুত্রাগড়ের)
- অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ
- নদিয়া-গোপাল
- তেহট্টের কৃষ্ণরায়
- কৃষ্ণচন্দ্র
- শ্রীগোবিন্দদেব
- মদনগোপাল[৩]
বিগ্রহগুলি বিরহী, শান্তিপুর, সুত্রাগড়, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, তেহট্ট, বহিরগাছি প্রভৃতি স্থানে প্রতিষ্ঠিত ও নিত্যপূজিত।
বিগ্রহগুলি বারদোলের তিনদিন পৃথক পৃথক মঞ্চে থাকেন এবং তিনদিন তাদের বেশও আলাদা আলাদা হয়। প্রথমদিন রাজবেশ অর্থাৎ সোনার অলংকার সহ মূল্যবান পোশাক (বর্তমানে অবশ্য নয়), দ্বিতীয়দিন ফুলবেশ অর্থাৎ সুগন্ধযুক্ত পুষ্পমাল্য সজ্জিত এবং তৃতীয়দিন রাখালবেশ অর্থাৎ দরিদ্র রাখালের বেশ।
বিধুভূষণ সেনগুপ্ত রচিত কবিতায় বারোদোলের বিগ্রহের বিবরণ :
“ | বিরহীর বলরাম, শ্রী গোপীমোহন । লক্ষ্মীকান্ত বহিরগাছি গুরুর ভবন ।। |
” |
ইতিহাসের পাতায়
সম্পাদনাদোলযাত্রার পর একমাত্র কৃষ্ণনগরেই বারদোলের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাসের পাতা উল্টালে ‘হরিভক্তিবিলাস’-এ এই দোলের উল্লেখ আছে:
“ | চৈত্রে সিতৈকাদশ্যাঞ্চ দক্ষিণাভিমুখং প্রভৃম্। দোলয়া দোলনং কুর্যান্নীতনৃত্যাদিনোৎসবম্।। |
” |
অর্থাৎ, চৈত্রমাসে শুক্লা একাদশী তিথিতে নৃত্যগীতাদি উৎসব সহকারে দেবদেবীকে দক্ষিণ মুখ করে দোলা দিয়ে দোলাতে হয়। গরুড় পুরাণেও উল্লেখিত আছে যে কলিকালে চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে দক্ষিণমুখী হরি বিগ্রহকে পূজার্চনা করে এক মাস দোলনে দোলাতে হয়।[৪]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ নদীয়া-কাহিনী। রানাঘাট: কুমুদনাথ মল্লিক। সন ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা ৩৬৭। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ নদীয়া-কাহিনী। রাণাঘাট: শ্রীকুমুদনাথ মল্লিক। সন ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা ৩৬৮। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ নদীয়া-কাহিনী। রাণাঘাট: শ্রীকুমুদনাথ মল্লিক। সন ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা ৩৬৯। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ নদীয়া-কাহিনী। রানাঘাট: শ্রী কুমুদনাথ মল্লিক। সন ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা ৩৬৮। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য)