বাবুরহাট শেখেরচর সমগ্র বাংলাদেশের প্রধান পাইকারী ও খুচরা বস্ত্রশিল্প কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। সারাদেশ হতে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা এই হাটে তাদের কাপড় কেনা-বেচা করে। বাবুরহাট শেখেরচরের মতো এতো বিশাল নয় বস্ত্রশিল্পের আরো দুটি কেন্দ্র পাবনা-সিরাজগঞ্জ।[১]

অবস্থান সম্পাদনা

ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের একদম লাগোয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায় এটি অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ০.১৫ বর্গ কিলোমিটার। তবে আয়তন প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষের চাহিদা বাড়ছে, আর এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশাই হচ্ছে তাঁতবস্ত্র উৎপাদন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা। তাই প্রায় সবাই এধরনের পেশায় আত্মনিয়োগ করছে। ফলে এই হাটের আয়তন দিন দিন বেড়েই চলেছে। শেখেরচর বাজার বণিক সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী এই হাটে স্থায়ী দোকানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মতো এবং প্রতি সপ্তাহে এখানে দুশো থেকে আড়াইশো কোটি টাকার লেনদেন হয়।[২] বর্তমানে এই হাটের ব্যবসায়ীদের হাট-কর্তৃপক্ষকে কোনো প্রকার খাজনা দিতে হয় না। তারা সরাসরি সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দেন।[৩]

ইতিহাস সম্পাদনা

সেই প্রাচীন তাম্রযুগ থেকেই এ-অঞ্চল বস্ত্রশিল্পের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলো। আদি মসলিনের সূতিকাগার ছিলো ঢাকা-সোনারগাঁও মহেশ্বরদী পরগণার গোটা অঞ্চল। বর্তমান নরসিংদী জেলা মহেশ্বরদী পরগণার অন্তর্ভুক্ত একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো।

মাধবদীর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একসময় আড়ং বসতো। আনন্দী গ্রামের সন্নিকটে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আড়ং নামের কাপড়ের এই হাট জমজমাট ছিলো। মাধবদী-শেখেরচর তাঁতশিল্পকেন্দ্র হওয়ার নেপথ্যে এই আড়ং নামের হাটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই কাপড়ের হাট ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এ-অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে হাট চলতে থাকে। কেননা, এ-অঞ্চলে সুতা থেকে কাপড় উৎপাদন প্রায় প্রতিটি গ্রামেই বিদ্যমান ছিলো। এসবের ফলাফলস্বরূপ গত শতকের তিরিশের দশকের প্রথমেই যখন মাধবদীর জমিদারদের দ্বারা সুতা-কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন একটা স্থায়ী রূপ পায়, যা অদ্যাবধি চলছে।[৪]

প্রাচীন আমলে বাবুরহাট সম্পাদনা

মাধবদী হাটে জমিদারদের সঙ্গে পাইকারদের খাজনাকেন্দ্রিক জটিলতায় যখন শেখেরচর-বাবুরহাট বাজারের উৎপত্তি ঘটে, তখন থেকেই ধীরে ধীরে মাধবদী হাট ‘সুতার হাট’, আর শেখেরচর-বাবুরহাট বাজার ‘কাপড়ের হাট’ হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে।[৫]

যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পাদনা

শেখেরচর-বাবুরহাটে পাইকাররা শুরুতে নদীপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করতো। পরবর্তীতে পঞ্চাশের দশকে মমিন মটর কোম্পানি নরসিংদী-তারাব সড়ক ও তাদের পরিবহন ব্যবসা শুরু করে। পাশাপাশি নরসিংদী-মাধবদী-নারায়ণগঞ্জ রুটে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে পাইকাররা সড়ক ও রেলপথেও যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করতে শুরু করে। নদী-সড়ক-রেলপথ একসাথে চালু থাকার কারণে বাবুরহাটের ব্যবসায়ের পরিধি হু হু করে বাড়তে থাকে। পরর্তীতে অবশ্য রেলপথটি বন্ধ হয়ে যায়।

মাধবদী আর শেখেরচর— এই দুই সুতা-কাপড়ের গুরুত্বপূর্ণ বাজারকে কেন্দ্র করে পঞ্চাশের দশক থেকেই গোটা অঞ্চলে সুতা থেকে কাপড় বুননের দেশি নানান যন্ত্রপাতি থেকে বিদেশি যন্ত্রপাতি আমদানি হতে শুরু করে এবং তা দ্বারা উন্নত মসৃণ কাপড় তৈরি শুরু হয়। এই মেশিনের বিপ্লব একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক ও গতিশীল বস্ত্র উৎপাদনে প্রবেশ করেছে এ-অঞ্চলের তাঁতীরা।[৬]

সাপ্তাহিক কার্যক্রম সম্পাদনা

শেখেরচর হাট সপ্তাহে তিনদিন বসে। এখন শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে রবিবার শেষ হয়। শুক্রবার ভোর হতেই সারাদেশ থেকে কাপড়ের পাইকাররা আসতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা হাটে জনসমাগমের যে-বিস্তার শুরু হয়, তা অভাবনীয়। ভ্যান, রিকশা, নসিমন, ট্রাক, পিকআপ ইত্যাদি যানের এক মহাযুদ্ধ চলে দিনমান। এখানে গলির সংখ্যা কতো, এটা কেউ বলতে পারে না। একেক গলিতে একেক ধরনের বস্ত্র। নানা জাতের বস্ত্র, যা এই হাটে নিত্য কেনা-বেচা হয়, সেসবের নাম জানা যাক। শাড়ি, লুঙি, গামছা, থ্রি-পিছ, শার্টিং, বেডশিট, পর্দা, মশারি, ছাপা কাপড় (ভয়েল, পপলিন, টিসি, টরে, মার্কিন, লালসালু, ক্যানভাস, টুইল, পলিয়েস্টার ইত্যাদি)-সহ আরো বহু ধরনের কাপড়[৭] এখানে সহজেই আপনি পেয়ে যাবেন।[৮]

জাতীয় রাজস্ব আয় সম্পাদনা

১৯৩৬ সালে এই শেখেরচর-বাবুরহাট প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এই ৮৬ বছর ধরে চলা কাপড়ের হাটটি এই অঞ্চলের অর্থনীতির সার্বিক গতি পরিবর্তন করার সাথে সাথে জাতীয়ভাবেও প্রভূত ভূমিকা রেখেছে। এই হাট দুই কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মাধবদীর সুতার হাটের অর্থনীতির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। মাধবদীতে সুতা কেনা-বেচা হয়, । কটন, পলিয়েস্টার, টিসি, ডেনিমসহ যাবতীয় সুতার আইটেমের পাইকারি ও খুচরা বাজার এটা।[৯]বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ ফ্যাশন হাউজগুলো বাবুরহাটের কাপড় দিয়েই তাদের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ। প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত ‘শেখেরচর-বাবুরহাট’ তার দীর্ঘ ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতায় আপন মহিমায় সারা বাংলাদেশের তাঁতবস্ত্রের যোগান অব্যাহত রেখেছে। এটা শেখেরচর-মাধবদী তথা নরসিংদীর গৌরব।[১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "বাবুরহাট - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  2. "বাবুরহাটে এবারের ঈদে ২ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রির টার্গেট"banglanews24.com। ২০২২-০৪-১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  3. "জমজমাট নরসিংদীর বাবুরহাট"Bangladesh Journal Online। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  4. জনকণ্ঠ, দৈনিক। "বাজারের নাম 'বাবুরহাট'"দৈনিক জনকণ্ঠ || Daily Janakantha (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  5. "বাবুরহাট"www.kalerkantho.com। ২০১৮-০৫-১২। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  6. "জমজমাট নরসিংদীর বাবুরহাটের কাপড়ের বাজার"দৈনিক ইত্তেফাক। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  7. "রুমাল থেকে জামদানি সব আছে বাবুরহাটে"আজকের পত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  8. দেবনাথ, প্রণব কুমার। "মন্দা কাটিয়ে ব্যবসায় ফিরল বাবুরহাট"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  9. "ঈদ ঘিরে জমজমাট শেখেরচর বাবুরহাট বাজার"www.shomoyeralo.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  10. "নরসিংদীর বাবুরহাট পাইকারী শাড়ী-লুঙ্গির বাজার!"www.uddoktarkhoje.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪