বাদি হাঁস
বাদি হাঁস (Cairina scutulata) (ইংরেজি: White-winged Duck) বা ভাদি হাঁস Anatidae (অ্যানাটিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Cairina (কাইরিনা) গণের এক প্রজাতির বৃহদাকায় গেছো হাঁস।[১][২] বাদি হাঁসের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ কায়রোর হীরক-হাঁস (ইতালিয়ান Cairina = কায়রোর অধিবাসী; ল্যাটিন: scutulatas = হীরক-আকৃতি)।[২] একসময় দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে মোট ৩ লক্ষ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে এরা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত থাকলেও প্রধানত বনাঞ্চল উজাড়ের কারণে এদের সংখ্যা ভয়ংকরভাবে হ্রাস পেয়েছে।[৩] সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে Endangered বা বিপন্ন বলে ঘোষণা করেছে।[৪] বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[২] সমগ্র পৃথিবীতে আনুমানিক মাত্র ২৫০টি থেকে ১০০০ এর কম বাদি হাঁস রয়েছে।[৩]
বাদি হাঁস | |
---|---|
বাদি হাঁস, নর্থ ক্যারোলাইনা, যুক্তরাষ্ট্র | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | Animalia |
পর্ব: | কর্ডাটা |
শ্রেণী: | পক্ষী |
বর্গ: | Anseriformes |
পরিবার: | Anatidae |
গণ: | Cairina Salvadori, 1895 |
প্রজাতি: | C. scutulata |
দ্বিপদী নাম | |
Cairina scutulata (Müller, 1842) | |
প্রতিশব্দ | |
Asarcornis scutulata, Anas scutulata |
বিস্তৃতি
সম্পাদনাবাদি হাঁস একসময় উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও সুমাত্রা পর্যন্ত বেশ ভালভাবে বিস্তৃত ছিল। কিন্তু নাটকীয়ভাবে এরা হ্রাস পাওয়ায় এই অঞ্চলে এদের দেখা পাওয়াটাই মুস্কিলের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে বাদি হাঁসের সংখ্যা প্রায় ৪৫০টি; থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় রয়েছে প্রায় ২০০টি; মিয়ানমারে এদের সংখ্যা ১০০টিরও কম ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় রয়েছে প্রায় ১৫০টি বাদি হাঁস। ২০০৭ সালে ভুটানে বাদি হাঁস দেখা গেছে। মালয়েশিয়া ও জাভায় একসময় বাদি হাঁস থাকলেও সেখান থেকে এরা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একসময় পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে বাদি হাঁস বিস্তৃত থাকলেও এখন এদের দেখা যায় কেবল আসাম আর অরুণাচল প্রদেশে।[৪] বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সিভিটবহুল (Swintonia floribunda) বনে এদের দেখা যেত। সেখানে মাইনীমুখ থেকে শীশক, মাহাইল্লা, আমতলী ও শেবরাতলী বনে প্রায় দুই ডজন বাদি হাঁস বাস করত ১৯৮০ সালের আগে। এরপর সেখানে শান্তি বাহিনীর আক্রমণ, বাঙালি সেটলারদের উপদ্রব ও বনে সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ পুরো এলাকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। মূলত সিভিট, উড়িআম, গর্জন ও চাকুয়া কড়ই গাছ কেটে ফেলার ফলেই এসব অঞ্চল থেকে বাদি হাঁস চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।[১]
বিবরণ
সম্পাদনাবাদি হাঁস বিশালাকৃতির পাখি। এদের দৈর্ঘ্য কমবেশি ৭৩.৫ সেন্টিমিটার, ডানা ২০.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৬ সেন্টিমিটার, পা ৫.৭ সেন্টিমিটার ও লেজ ১৫ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় তিন কিলোগ্রাম।[২] পুরুষ ও স্ত্রী হাঁসের চেহারা কিছুটা ভিন্ন। পুরুষ পাখিরডানায় কাঁধ বরাবর কোভার্টে সাদা পট্টি থাকে। মাথা, ঘাড় ও গলা সাদা এবং মাথা ও ঘাড়ে কালো ছিট ছিট দাগ থাকে। পিঠের বাকি অংশ কালচে ও তামাটে বাদামি মেশানো পালকে ঢাকা। এছাড়া ডানায় আছে নীলাভ ও কালো বন্ধনী। চোখ কমলা-হলুদ। স্ত্রী হাঁসের আকার ছোট এবং অনুজ্বল পালকের জন্য পুরুষ হাঁস থেকে দেখতে আলাদা। মাথার কালো দাগ বেশ ঘন। চোখ বাদামি। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় হাঁসের ঠোঁট হলুদ, তার উপর কালচে দাগ। পা ও পায়ের পাতা কমলা-হলুদে মেশানো।[১][২]
স্বভাব
সম্পাদনাবাদি হাঁস গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পাহাড়ি বনের বদ্ধ জলে এবং ধীরগতির স্রোতধারায় বিচরণ করে। এছাড়া তৃণসম্বৃদ্ধ জলাভূমি এদের পছন্দের জায়গা। এদের সমূদ্রসমতলের ১৪০০ মিটারের মধ্যে দেখা যায়। সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় বা ৫-৬টির দলে দেখা যায়। এরা সাধারণত এমন জায়গায় বিচরণ করে যাতে আশেপাশে খুব সহজেই নজর রাখা যায় আর ঝটপট পালানো যায়।এরা রাতে গাছে ঢাকা জঙ্গলের জলাশয়ে বা মাটিতে খাবার খুঁজে বেড়ায়। উঁচু গাছের গাছের বড় ডালে এরা বিশ্রাম করে। ভোরে আর সন্ধ্যায় বেশি সক্রিয় থাকে। রাতে বিশ্রাম নেয়। পূর্ণিমা রাতেও এরা সক্রিয় থাকে। দিনের বেলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাবার খুঁজে বেড়ালেও রাতের বেলা এরা দলবদ্ধভাবে বিশ্রাম নেয়। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে) এরা এক পক্ষকালের জন্য উড়তে পারে না। এ সময় এরা শরীরের পালক পরিবর্তন করে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে শামুক, পোকামাকড়, ছোট মাছ, ব্যাঙ, ভাসমান উদ্ভিদ ও জলজ লতাগুল্ম । প্রাণীজ খাদ্য বেশি পছন্দ করে। পুরুষ হাঁস শিঙ্গার মত আওয়াজ করে ডাকেঃ ক্রংক-ক্রংক....। এদের প্রজননকাল জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। এসময় পানির কাছাকাছি কোন গাছের কোটরে ঘাস ও আবর্জনা দিয়ে বাসা বাঁধে। বাসার উচ্চতা ৩-১২ মিটার পর্যন্ত হয়।[৫] মাটিতেও বাসা বাঁধে, তবে এমন ঘটনা বিরল। বাসা বানানো শেষে স্ত্রী বাদি হাঁস ৭-১০টি ডিমপাড়ে। ডিমগুলো সবুজাভ-হলুদ বর্ণের। ডিমের মাপ ৬.৫ × ৪.৫ সেন্টিমিটার।[২] কেবল স্ত্রী হাঁসই ডিমে তা দেয়। পুরুষ হাঁস বাসা পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে থাকে। ৩০ দিনে ডিম ফোটে। স্ত্রী হাঁস সন্তান প্রতিপালনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
সংরক্ষণের উদ্যোগ
সম্পাদনাবাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বাদি হাঁস মারা, ধরা বা অন্য যেকোন উপায়ে উত্ত্যক্ত করা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। তবে এসব দেশে এ ব্যাপারে আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। বিশ্বব্যাপী প্রায় একুশটি এলাকাকে বাদি হাঁসের জন্য সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কাসালং ভ্যালিতে অবস্থিত পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সম্ভবত দেশটির শেষ কয়েকটি জীবিত বাদি হাঁসের একমাত্র আবাসস্থল। তবে সম্প্রতি সেখানে প্রজাতিটি দেখতে পাবার কোন নজির নেই।[৫]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮), পৃ. ১১৮।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ১৮-৯।
- ↑ ক খ Cairina scutulata, BirdLife International এ বাদি হাঁস বিষয়ক পাতা।
- ↑ ক খ Cairina scutulata ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ জুলাই ২০১২ তারিখে, The IUCN Red List of Threatened Species এ বাদি হাঁস বিষয়ক পাতা।
- ↑ ক খ বাদি হাঁস বিষয়ক তথ্যাবলী
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- Oriental Bird Images, বাদি হাঁসের আরও আলোকচিত্র।
- ARKive, বাদি হাঁসের আলোকচিত্র, ভিডিও ও তথ্য।