বসু বাটী পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের একটি সুবৃহৎ অট্টালিকা। এই অট্টালিকার সদরের বহির্ভাগ বিশালাকৃতি করিন্থিয়ান গঠনশৈলী অবলম্বনে নির্মিত।[] ১৮৭৮ সালে প্রায় ২২ বিঘা জমির উপর বাগান সহ এই অট্টালিকা নির্মাণ করেন গয়া জেলার জমিদার মহেন্দ্র বসুর দুই ভাই পশুপতি বসু এবং নন্দলাল বসু।

বসু বাটী
বসু বাটী
সাধারণ তথ্য
অবস্থানবাগবাজার,কলকাতা
দেশভারতবর্ষ
নির্মাণকাজের আরম্ভ১৯শে অক্টোবর ১৮৭৬
নির্মাণকাজের সমাপ্তি১০ই জুলাই ১৮৭৮
স্বত্বাধিকারীবসু পরিবার
ভূমিমালিকবসু পরিবার
নকশা এবং নির্মাণ
স্থপতিনীলমণি মিত্র

তৎকালীন শাসক ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে স্থির করা বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এই বসু বাটী থেকেই রাখিবন্ধন উৎসবের সূত্রপাত হয় ।

ইতিহাস

সম্পাদনা

১৮৭৪ সালে গয়ার জমিদার বসু পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র মহেন্দ্র বসু বাগবাজারে তার কাকার কাছ থেকে একটি বৃহৎ সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। তবে অকালমৃত্যুর কারণে মহেন্দ্রর পক্ষে এই সম্পত্তি ভোগ করা হয়ে ওঠেনি। পরে তার দুই ভাই - নন্দলাল বসু এবং পশুপতি বসু ১৯শে অক্টোবর ১৮৭৬ সালে এই বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বসু পরিবার ১০ই জুলাই ১৮৭৮ থেকে এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। সেই সময় এই বাড়ির ঠিকানা ছিল ৬৫, বাগবাজার স্ট্রীট। [] প্রায় ২২ বিঘা জমির উপর বাগান সহ এই বাড়ী তৈরি করা হয় । আদতে এই বাড়িটি পেছনের দিকে মারাঠা ডিচ লেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কোন এক সময়ে এখানে একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা এবং একটি আস্তাবল ছিল । বর্তমানে এই অট্টালিকা এক সঙ্কীর্ণ চত্বরের উপর বিদ্যমান। বসু পরিবারের বংশধররা বর্তমানে এই বাটীর বিপরীত দিকে অবস্থিত ৩৫ বছর পূর্বে নির্মিত একটি বাড়িতে বসবাস করেন।

স্থাপত্য

সম্পাদনা
 
বসুবাটীর বহির্ভাগ

বসু পরিবার প্রথম বাঙ্গালী ইঞ্জিনিয়ার শ্রী নীলমণি মিত্রকে নিযুক্ত করেছিলেন নকশা তৈরী করে বাড়ীটি সম্পূর্ণ ভাবে গড়ে তোলার জন্য। নীলমণি মিত্রের তত্বাবধানে তৈরি বাড়ীগুলির একটি হল সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের বাড়ী। মাহেশের বিখ্যাত রথটির পুনরায় পরিকল্পনা করেন এই নীলমণি মিত্র মহাশয়। তবে এই বসু বাটীকে নীলমণি মিত্রের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করা হয়। এই প্রাসাদের নকশাটি তৈরী করার সময় তিনি তৎকালীন বহুল প্রচলিত ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলী থেকে বেরিয়ে এসে ঐতিহ্যগত বাংলা এবং ইসলামীক স্থাপত্যের মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছিলেন।

 
খিলানের শিল্পকলা
 
ডোরিক থামের শিল্পকলা

স্থাপত্য শিল্পে বাংলার রেনেসাঁর এক অপূর্ব নিদর্শন এই বসু বাটী। ক্ল্যাসিকাল ইউরোপীয় স্থাপত্যের সঙ্গে বাংলার স্থানীয় শিল্পের এক অনবদ্য মেলবন্ধনের ফসল হিসাবে পাশ্চাত্য থাম এবং খিলানের সঙ্গে প্রাচ্যদেশের ঠাকুরদালানের আঙ্গিনা এবং ফ্রেস্কোর এক মিশ্রণ এখানে লক্ষ্য করা যায়। [] দক্ষিণমুখী বসু বাটীর গঠনরীতি ' বিম অ্যাণ্ড পিলার বিল্ডিং টাইপ'-এর। সারি সারি ষোলোটি ডোরিক থামের দ্বারা বাড়ির সামনের দিকটি সুসজ্জিত। থামের মাথায় লোহার কড়ি ও ইট দিয়ে বিম গাঁথা ছিল। দক্ষিণের বারান্দাকে মজবুত করার জন্য থামের গায়ে লোহার ব্রাকেট দিয়ে আটকানো ছিল। বারান্দার রেলিং-এ ঢালাই লোহার কারুকাজ লক্ষ করা যায় ।

খিলানগুলির মধ্যে ইসলামীয় বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলেও পদ্ম ফুলের আধিক্য এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয়। ডোরিক থামের মাথার দিকে থাকা বড় বড় পদ্ম ফুলের পাপড়ি গুলিকে নিচের দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে কেশরশোভিত এক ডজন সিংহের মাথা। সেই সঙ্গে ছিল প্লাস্টার করা রুদ্রাক্ষের মালা।

বসু বাটীর এক তলার ঠাকুর দালান বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল । দাবার বোর্ডের মত সাদা কালো মার্বেলের টালি দিয়ে এই ঠাকুর দালানর মেঝে সজ্জিত ছিল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঠাকুর দালান-এ পৌঁছতে হত। প্রথমে থাম এবং পরে দরজার আকারে কাটা দু সারি খিলান দেওয়া দেওয়াল পেরিয়ে প্রতিমার বেদির কাছে পৌঁছতে হত। সেই সময়ে এখানে দুর্গা, জগদ্ধাত্রি, আন্নপূর্ণা প্রায় সব পূজার প্রচলন ছিল। খিলান দেওয়া প্রথম দেওয়ালে ছিল দশ অবতারের মূর্তি । বেদির পেছনের দেওয়াল শিব, দুর্গা, মহেশ্বর, ব্রহ্মা এবং হরপার্বতীর প্লাস্টার করা রিলিফ দ্বারা সজ্জিত ছিল ।

এখানে ফিরোজা এবং অ্যাম্বার রং দিয়ে অঙ্কিত ম্যুরালরিলিফের কাজ বিশেষভাবে দেখা যায়। বিখ্যাত শিল্পী বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অঙ্কিত চিত্র দ্বারা বসু বাটীর দেওয়াল সজ্জিত থাকত। । পর পর তিন সারি দেওয়ালে মুখোমুখি এই ছবি আঁকা হয়েছিল।

বাড়ির আভ্যন্তরীন সজ্জায় বাঙালিয়ানার সুস্পস্ট প্রকাশ পাওয়া যায়। ঘরের ছাদ ছিল সোনালি রং-এর এবং এখানে ছিল মার্বেল পাথরের মূর্তি এবং বড় বড় ঝাড় লন্ঠন । দোতলার নাচঘরে মঞ্চ ছিল এবং দর্শকদের জন্য ছিল সারি সারি কেদারা। ঝুলবারান্দায় মহিলাদের জন্য আলাদা করে বসার ব্যবস্থা থাকত ।

রাখিবন্ধন উৎসব

সম্পাদনা

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এই বসু বাটী থেকেই রাখিবন্ধন উৎসবের সূত্রপাত হয় । এইদিন দুপুরে আনন্দমোহন বসুর সভাপতিত্বে আপার সার্কুলার রোডে স্থাপিত হয়েছিল ‘মিলন মন্দির’ বা ‘ফেডারেশন হল’-এর ভিত্তিপ্রস্তর। সেখান থেকে এক বিরাট মিছিল গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল বসু বাটীতে আয়োজিত এক সভায়। ওই সভায় ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল । আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি পণ্য বর্জন করা এবং তার বিকল্প দেশজ পণ্য উৎপাদনে অগ্রণী হওয়া।[]

চিত্রশালা

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. [editor; Mitra], publisher Swati (২০১১)। Kolkata : city guide। New Delhi: Eicher Goodearth। পৃষ্ঠা ৮৭। আইএসবিএন 978-93-80262-15-4 
  2. Mitra, lekhā, Debāśisa Bandyopādhyāẏa ; chabi, Alaka (২০০১)। Banedi Kalakātāra gharabāṛi (1. saṃskaraṇa. সংস্করণ)। Kalikātā: Ānanda। পৃষ্ঠা 100। আইএসবিএন 81-7756-158-8 
  3. Guha, Nandini (২৭শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। "Heritage highs"। The Telegraph। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০১৬  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  4. বসুমল্লিক, গৌতম। "সূর্য সেন স্ট্রিট পরিক্রমা (পর্ব: ৮)"এই সময়। সংগ্রহের তারিখ ১৮ অক্টোবর ২০১৬