বঙ্গীয় অববাহিকা
বঙ্গীয় অববাহিকা[১] হল একটি পাললিক অববাহিকা। বঙ্গীয় অববাহিকা বা বেঙ্গল বেসিন শব্দটি বঙ্গীয় অঞ্চলের পাললিক অববাহিকার ভূতাত্ত্বিক গঠন বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়।[২] এটি ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ জুড়ে বিস্তৃত।[৩] ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলস্থিত বঙ্গীয় অববাহিকা পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ ও অগভীর সামুদ্রিক পাললিক অববাহিকা গঠন করেছে। এই অগভীর সামুদ্রিক পাললিক অববাহিকাটি বঙ্গোপসাগরের নীচে বেঙ্গল ফ্যানের সাথে মিলিত হয়ে আধুনিক বিশ্বে পরিচিত বৃহত্তম পলল বিচ্ছুরণ ব্যবস্থা গঠন করে।[৪]
বঙ্গীয় অববাহিকার সূচনা মেসোজোয়িক যুগের শেষভাগে গন্ডোয়ানাল্যান্ডের ভাঙনের সময় হয়েছিল। এই অববাহিকায় প্রাথমিক ক্রিটেসিয়াস-হলোসিন যুগের পুরু পাললিক অধঃক্ষেপণ রয়েছে। পূর্ব হিমালয় ও ইন্দো-বর্মা উচ্চভূমি থেকে ওরোজেনিক পলির একটি অংশের প্রক্সিমাল অবক্ষেপণ বঙ্গীয় অববাহিকায় জমা হয়েছে। বেসিনের সর্বাধিক পুরু পাললিক স্তর বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় দেখা যায়, এখানে প্রায় ২০ কিমি পুরু পাললিক স্তর রয়েছে।[১]
এটি সব দিকেই ভূ-চ্যুতি দ্বারা আবদ্ধ। অববাহিকার পশ্চিমে পশ্চিম মার্জিন ভূ-চ্যুতি ও মালদা-কিষাণগঞ্জ ভূ-চ্যুতি, পূর্বে সুরমা মার্জিন ভূ-চ্যুতি এবং উত্তর-পূর্বে যমুনা ভূ-চ্যুতি ও ডাউকি ভূ-চ্যুতি অবস্থিত।[৪]
উৎপত্তি
সম্পাদনাবঙ্গীয় অববাহিকার উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে, চারটি মতবাদ সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। মতবাদগুলি হল:[৪]
- অববাহিকাটি ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ পাতের নীচে ভারতীয় পাতের অবস্থানের ফলাফল।
- বঙ্গীয় অববাহিকাটি মূলত একটি অবশিষ্ট মহাসাগর অববাহিকা, এবং এটি ভারতের পূর্ব মহাদেশীয় প্রান্তিক অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে।
- বঙ্গীয় অববাহিকা হল একটি ফোরল্যান্ড অববাহিকা, যেখানে প্রধানত হিমালয় ও ইন্দো-বর্মী পর্বতের ক্ষয় থেকে প্রাপ্ত প্রধানত বদ্বীপীয় পলির উত্তরাধিকার রয়েছে।
- বঙ্গীয় অববাহিকাটি গন্ডোয়ানা ভূমি ভেঙ্গে যাওয়ার সময় বেসমেন্ট বা তলদেশে বিচ্ছিন্ন গ্র্যাবেন নিয়ন্ত্রিত অববাহিকায় বিকশিত হয়েছিল।
ভূতত্ত্ব
সম্পাদনাবঙ্গীয় অববাহিকার পশ্চিম ও উত্তর অংশে মৃদুভাবে ঢালু ও অগভীর পলির আবরণ রয়েছে। স্ট্র্যাটিগ্রাফি, অবক্ষেপন টেকটোনিক্স ও অববাহিকা বিবর্তনের ক্ষেত্রে অববাহিকার বিভিন্ন অংশে যথেষ্ট ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ভূতাত্ত্বিক গঠনের ভিন্নতার জন্য সমগ্র অববাহিকাকে তিনটি ছোট উপ-অববাহিকায় ভাগ করা হয়, যথা উত্তর উপ-অববাহিকা, পশ্চিম উপ-অববাহিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব উপ-অববাহিকা।
উত্তর উপ-অববাহিকা
সম্পাদনাউত্তর উপ-অববাহিকা মূলত বঙ্গীয় অববাহিকার উত্তর অংশ নিয়ে গঠিত। এটি দক্ষিণে গারো-রাজমহল গ্যাপ (নিমজ্জিত রিজ) ও হিমালয় ফ্রন্টের 'স্যাডল'-এর মধ্যে অবস্থিত, যা বর্তমান সময়ের ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অন্তর্গত। উপ-অববাহিকাটির অগভীরতম অংশটি দক্ষিণে অবস্থিত, যেখানে নিওজিন পলির পুরুত্ব ১২৮ মিটার থেকে ১,১৬০ মিটারের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। এই অংশে পলি প্রিক্যামব্রিয়ান বেসমেন্ট ও ফ্যানেরোজয়িক গন্ডোয়ানা রিফ্ট-বেসিনের উপরে জমা হয়েছে। হিমালয়ের টেকটোনিকলি ডাউন-ওয়ার্পড ফ্রন্টাল বেল্টে নিওজিন পলি রয়েছে। গারো-রাজমহল বরাবর নিমজ্জিত পর্বতমালার দক্ষিণ প্রান্তটি হল একটি ফল্ট জোন, যা পূর্ব-পশ্চিমমুখী ডাউকি ফল্ট নামে পরিচিত।[৪]
পশ্চিম উপ-অববাহিকা
সম্পাদনাবঙ্গীয় অববাহিকার পশ্চিমতম অংশে নিয়ে পশ্চিম উপ-অববাহিকা গঠিত। এটি মুর্শিদাবাদ জেলায় ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি চওড়া এবং দক্ষিণে মেদিনীপুরে একটু তুলনামূলকভাবে কম চওড়া। পশ্চিম উপ-অববাহিকার স্তরবিন্যাসে প্রারম্ভিক ক্রিটেসিয়াস থেকে সাম্প্রতিক সময়ের পলল সঞ্চয়ের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিম উপ-অববাহিকার পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত অংশটি মৃদুভাবে পূর্ব দিকে ঢাল এবং ছোট স্থানচ্যুতি সহ অসংখ্য ধাপের ভূ-চুত্যি দ্বারা চিহ্নিত। পলির পুরুত্ব পশ্চিম প্রান্তের কাছাকাছি প্রায় ৫০০ মিটার থেকে সমানভাবে বৃদ্ধি পেয়ে কলকাতার কাছে ৬,৫০০ মিটারের অধিক হয়।[৪]
এই অংশে ল্যারাইট ও ল্যারিটিক মাটির উপস্থিতি দেখা যায়। ভূ-অভ্যন্তরে বেলেপাথর, লাল শেল, গ্রিট এবং নুড়ির স্তর রয়েছে। রাজমহল খাদের তলদেশে ধনঞ্জয়পুর স্তরসমষ্টিটি পশ্চিম মার্জিন ভূ-চ্যুতির পূর্ব দিকের অংশে অবক্ষয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এই উপ-অববাহিকায় রাজমহল ও জয়ন্তী পাহাড় থেকে পাথর এবং ভাগীরথী নদীর মাধ্যমে পলিমাটি জমা হয়েছে। রাজমহল পাহাড় থেকে আসা অধঃক্ষেপণ বোলপুর ও ঘাটাল স্তরসমষ্টির মাধ্যমে জমা হয়েছে। বোলপুর স্তরসমষ্টিতে কাদাপাথর, বেলেপাথর ও ট্র্যাপওয়াশ এবং ঘাটাল স্তরসমষ্টিতে বেলেপাথর, চুনাপাথর ও শেল জমা হয়েছে। ভাগীরথী নদীর মাধ্যমে রানাঘাট ও মালদা স্তরসমষ্টির সৃষ্টি হয়েছিল। রানাঘাট স্তরসমষ্টিতে বেলেপাথর, চুনাপাথর ও শেল এবং মালদা স্তরসমষ্টিতে বালি ও কাদা পাথর উপস্থিত রয়েছে।[৪][৫]
দক্ষিণ-পূর্ব উপ-অববাহিকা
সম্পাদনাদক্ষিণ-পূর্ব উপ-অববাহিকাটি পশ্চিমে ইওসিন শেল্ফ-ব্রেক ও সিটিএফবি-এর পূর্বতম প্রান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই অববাহিকা ১০ কিলোমিটার থেকে ১৮ কিলোমিটারের একটি বিশাল পলল পুরুত্ব দেখা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব উপ-অববাহিকায় বিশাল ক্লাস্টিক পলির সঞ্চয় ঘটেছে, এবং উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পলির পুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।[৪] এই অববাহিকাকে টেকটোনিক ডোমেন অনুযায়ী ৫ টি অংশে বিভক্ত করা হয়, যথা সিলেট খাত, টাঙ্গাইল-ত্রিপুরা হাই (মধুপুর হাই নামেও পরিচিত), ফরিদপুর খাদ, বরিশাল-চাঁদপুর হাই ও হাতিয়া খাদ। হাতিয়া খাদে বঙ্গীয় অববাহিকার সবচেয়ে পুরু ক্লাস্টিক পলির স্তর রয়েছে, এবং এটি অববাহিকার গভীরতম খাদ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।[৪] ফরিদপুর খাদ ও হাতিয়া খাত দুটি একটি সংকীর্ণ অঞ্চল বরিশাল-চাঁদপুর হাই (৬০ কিমি প্রশস্ত) দ্বারা বিভক্ত।
সিলেট খাদের বিভিন্ন অংশে অলিগোসিন ও শেষ প্লাইস্টোসিন যুগে বিপুল পরিমাণ পলি জমা হয়েছিল, যা ১০ কিমি থেকে ১৭ কিলোমিটারেরও বেশি পুরু বেরাইল পলির স্তম্ভ তৈরি করেছিল। বরিশালে বেলেপাথর, পলিপাথর ও কাদাপাথরের ১,৫০০ মিটার পুরু স্তর পরিলক্ষিত হয়।
খনিজ সম্পদ
সম্পাদনাবঙ্গীয় অববাহিকায় প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাচুর্যতা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তল করা হয়। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে খনিজ তেলের বৃহৎ ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর তৈল ক্ষেত্র থেকে খনিজ তেল উত্তোলন করা হয়।[৬][৭]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ "Bengal Basin"। www.ndrdgh.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০২৩।
- ↑ "Geology, Geomorphology and Seismotectonics of Bengal Basin with special emphasis on Kolkata and its adjoining region" (পিডিএফ)। wbdmd.gov.in। ১৪ জুলাই ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০২৩।
- ↑ DK Guha; Haroun Er Rashid। "বঙ্গীয় অববাহিকা"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুলাই ২০২৩।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ A. B. Roy; Alokesh Chatterjee (১৪ জুলাই ২০২৩)। "Tectonic framework and evolutionary history of the Bengal Basin in the Indian subcontinent" (পিডিএফ)। www.currentscience.ac.in। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০২৩।
- ↑ "Paleoenvironment of Bengal Basin" (পিডিএফ)। www.wbdmd.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০২৩।
- ↑ "Dharmendra Pradhan dedicates West Bengal's first oil and gas reserve to nation"। www.livemint.com। livemint। ২০ ডিসেম্বর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০২৩।
- ↑ "Shri Dharmendra Pradhan dedicates the 8th producing Basin of India - Bengal Basin, to the nation"। pib.gov.in। New Delhi: PIB Delhi। ২০ ডিসেম্বর ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুলাই ২০২৩।