বংশাণুসমগ্র
কোনও জীব প্রজাতির প্রতিটি স্বতন্ত্র জীব যেসব বংশগতিমূলক তথ্য (বংশাণু বা জিন) বহন করে, তাদের সমষ্টি বা সামগ্রিক অনুক্রমকে বংশাণুসমগ্র বা জিনোম বলে। অর্থাৎ কোনও জীবের বংশাণুসমগ্রে ঐ জীবের বংশগতিমূলক সমস্ত তথ্য সঙ্কেতায়িত থাকে। ইংরেজি পরিভাষায় বংশাণুসমগ্রকে জিনোম (Genome) বলা হয়।
মানুষের বংশাণুসমগ্র মানুষের প্রতিটি দেহকোষের কোষকেন্দ্রের ভেতরে অবস্থিত ২৩ জোড়া বংশসূত্রে (ক্রোমোজোম) পাওয়া যায়। প্রতিটি বংশসূত্রে দুইটি ডিএনএ অণুর সূত্র সর্পিলাকারে একে অপরকে ঘিরে পেঁচিয়ে থাকে। ডিএনএ এক ধরনের পলিমার অণু, অর্থাৎ এটি একই রকমের অনেকগুলি একক অণু বা মনোমারের একটি দীর্ঘ শৃঙ্খল। ডিএনএর সাংগঠনিক একক তথা মনোমার অণুগুলিকে নিউক্লিওটাইড বলে। একটি পলিমার ডিএনএ অণুর ভেতরে অসংখ্য মনোমার নিউক্লিওটাইড অণু নির্দিষ্ট অনুক্রমে সজ্জিত থাকে। নিউক্লিওটাইডগুলির এই অনুক্রমগুলিতেই বংশগতিমূলক তথ্য সঙ্কেতায়িত থাকে। এখন একটি ডিএনএ অণুর যে খণ্ডাংশগুলি (অর্থাৎ ডিএনএ-র অভ্যন্তরে নিউক্লিওটাইডের যে অনুক্রমগুলি) জীবদেহকে গঠনকারী একেকটি প্রোটিন সংশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দানকারী ভূমিকা পালন করে, সেরকম একেকটি ডিএনএ খণ্ডাংশকে একেকটি বংশাণু (জিন) বলে। এ পর্যন্ত করা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনুমান করা হয় যে মানবদেহের বংশাণুসমগ্রে তথা ডিএনএ-সমগ্রে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার বংশাণু (অর্থাৎ প্রোটিন সংশ্লেষণের নির্দেশনামূলক সঙ্কেত বহনকারী নিউক্লিওটাইড অনুক্রম) আছে। তবে একটি ডিএনএ শুধুমাত্র হাজার হাজার বংশাণু নিয়েই গঠিত হয় না। ডিএনএ অণুর ভেতরে নিউক্লিওটাইডগুলির এমন অনেক অনুক্রম আছে, যেগুলি প্রকৃত অর্থে বংশাণু নয়, অর্থাৎ এগুলি জীবের বহির্বৈশিষ্ট্য (ফেনোটাইপ) নির্ধারণে কোনও ভূমিকা রাখে না; এগুলিকে বংশাণুহীন ডিএনএ অনুক্রম বা বাতিল ডিএনএ (Junk DNA) বলে। সুতরাং বংশাণুসমগ্রের মধ্যে বংশাণুবাহী ডিএনএ অনুক্রম এবং বংশাণুহীন ডিএনএ অনুক্রম (বাতিল ডিএনএ) উভয়ই বিদ্যমান থাকে।
সুকেন্দ্রিক কোষবিশিষ্ট জীবের দেহকোষের কোষকেন্দ্রে বংশসূত্রগুলির (ক্রোমোজোমগুলির) দুইটি পূর্ণাঙ্গ সেট থাকে, অর্থাৎ প্রতি ধরনের বংশসূত্র দুইটি করে থাকে। এর বিপরীতে ঐসব জীবের জননকোষের (শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর) কোষকেন্দ্রে বংশসূত্রসমূহের একটিমাত্র পূর্ণাঙ্গ সেট থাকে, অর্থাৎ প্রতি ধরনের বংশসূত্র একটি করে থাকে। তাই অপেক্ষাকৃত পুরাতন একটি সংজ্ঞায় বংশাণুসমগ্র বলতে কোনও জীবের জননকোষের কোষকেন্দ্রে অবস্থিত বংশসূত্রগুলির একটিমাত্র পূর্ণাঙ্গ সেট (যাতে বংশাণুবাহী ডিএনএ অনুক্রম ও বংশাণুহীন ডিএনএ অনুক্রম উভয়েই বিদ্যমান) বোঝায়। প্রজননের সময় সন্তান বাবার কাছ থেকে এক সেট বংশসূত্র এবং মায়ের কাছ থেকে এক সেট বংশসূত্র উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে দুই সেট বংশসূত্রের অধিকারী হয়, ফলে সন্তানের বংশাণুসমগ্রে বাবা ও মা উভয়ের সমান অবদান থাকে। যেমন মানব সন্তান বাবার কাছ থেকে ২৩টি বংশসূত্রের একটি সেট এবং মায়ের কাছ থেকে ২৩টি বংশসূত্রের একটি সেট উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে।
সুকেন্দ্রিক কোষবিশিষ্ট জীবের দেহকোষে কোষকেন্দ্রস্থিত বংশসূত্রের বাইরেও মাইটোকন্ড্রিয়া বা হরিৎ কণিকা (ক্লোরোপ্লাস্ট) নামক কোষীয় অঙ্গাণুগুলিতে এবং প্রাককেন্দ্রিক কোষবিশিষ্ট জীবের কোষের (যেমন ব্যাকটেরিয়া) প্লাজমিড নামক অংশে ডিএনএ থাকতে পারে। এগুলিকে বংশসূত্র-বহির্ভূত ডিএনএ বলে। অনেক সময় বংশাণুসমগ্রের সংজ্ঞায় এই ডিএনএ-গুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কোনও কোনও ভাইরাসের ক্ষেত্রে ডিএনএ-র পরিবর্তে আরএনএ অণুতে এর বংশগতিমূলক তথ্য সঙ্কেতায়িত থাকতে পারে।
বংশাণুসমগ্র যত বড় হবে, তার ধারণ করা তথ্যের পরিমাণও তত বেশি হবে। তবে সেই সম্পূর্ণ তথ্যের মর্মার্থ উদ্ধার করা এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। জীবদেহে বহুসংখ্যক কোষ থাকে। প্রতিটি কোষ সেই জীবের বিকাশ এবং গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বহন করে। এই সকল নির্দেশনার সমন্বয়ই হলো বংশাণুসমগ্র যা ডিএনএ কিংবা আরএনএ দিয়ে গঠিত। দেহের প্রতিটি কোষ একই বংশাণুসমগ্র বহন করে, তা ত্বকেরই হোক কিংবা হৃৎপিণ্ডেরই হোক; কিন্তু ঐ কোষের জন্য প্রয়োজনীয় বংশাণুগুলিই কার্যকর হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক মানব বংশাণুসমগ্র প্রকল্প ১৪ বছর ধরে গবেষণা করে শেষ পর্যন্ত ২০০৩ সালে মানব বংশাণুসমগ্রের ভেতরে অবস্থিত ৩ শত কোটি ডিএনএ বেস জোড়ের পূর্ণাঙ্গ অনুক্রম উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়। এই মানব বংশাণুসমগ্রে একটি মানুষের সমস্ত বংশগতিমূলক তথ্য সঞ্চিত আছে। ভবিষ্যতে এই তথ্য বংশানুক্রমে অর্জিত বিভিন্ন ব্যাধি নির্ণয় ও চিকিৎসায় সাহায্য করবে।
১৯২০ সালে জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক হান্স ভিংক্লার ইংরেজি "জিন" (অর্থাৎ "বংশাণু") ও "ক্রোমোজোম" (অর্থাৎ "বংশসূত্র") পরিভাষা দুইটির অংশবিশেষ জোড়া লাগিয়ে ইংরেজি "জিনোম" পরিভাষাটি উদ্ভাবন করেন।[১]
সাধারণ ব্যাখ্যা
সম্পাদনামানুষের বংশাণুসমগ্রকে যদি একটি বইয়ের সাথে তুলনা করা হয়, তবে-
- এই বইয়ে ২৩টি অধ্যায় থাকবে;
- প্রতিটি অধ্যায়ে ২৫ কোটি থেকে ৪৮ কোটি অক্ষর থাকবে, যাদেরকে A, T, G এবং C দ্বারা চিহ্নিত করা যায়;
- প্রতিটি বই ৩ শত ২০ কোটিরও বেশি অক্ষর বহন করেবে;
- এই বইটি সূচ্যগ্র পরিমাণ জায়গার চেয়েও কম জায়গায় আঁটবে;
- এই বইয়ের অন্তত একটি করে অনুলিপি বা কপি দেহের প্রায় প্রতিটি কোষেই থাকবে।
দীর্ঘতম বংশাণুসমগ্র অনুক্রম
সম্পাদনাপ্যারিস জাপোনিকা নামের একটি ফুলগাছের বংশাণুসমগ্র জীবজগতে দীর্ঘতম বলে আবিষ্কৃত হয়েছে। ফুলটি আকারে ছোট, শুভ্র বর্ণ। পাহাড়ী এ ফুলটির বিকাশের গতি অত্যন্ত ধীর। এটি জাপানের হনশু দ্বীপের স্থানীয় একটি উদ্ভিদ। সচরাচর অন্য কোথাও দেখা যায় না। তবে যুক্তরাজ্যের কিউি গার্ডেনস্ নামক উদ্যানে এই ফুলের চাষ করা হয়েছে। কিউই গার্ডেনস্-এ কর্মরত গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে এই ফুলের বংশাণুসমগ্র অনুক্রম মানুষের বংশাণুসমগ্রের তুলনায় ৫০ গুণ দীর্ঘ। এই ফুলের বংশাণুসমগ্রে ১৫ হাজার কোটি বেস জোড় রয়েছে। এর তুলনায় মানুষের বংশাণুসমগ্রে রয়েছে মাত্র তিন শত কোটি বেস জোড়। প্যারিস জাপোনিকার একটিমাত্র কোষের বংশগতিমূলক তথ্য যদি একটি পংক্তিতে বিন্যস্ত করা হয় তাহলে সেই পংক্তিটি ৩২৮ ফুট দীর্ঘ হবে। অপরদিকে মানুষের একটি কোষের বংশগতিমূলক তথ্য জোড়া লাগিয়ে একটি পংক্তিতে সাজালে তার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য হবে মাত্র সাড়ে ছয় ফুট। এর আগে প্রোটোপটিরাস ইথিওপিকাস (marbled lungfish) নামক আফ্রিকান একটি মাছ ছিল সর্বাধিক দীর্ঘ বংশাণুসমগ্র সংবলিত জীব।[২]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Joshua Lederberg and Alexa T. McCray (২০০১)। "'Ome Sweet 'Omics -- A Genealogical Treasury of Words" (পিডিএফ)। The Scientist। 15 (7)। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০০৭।
- ↑ "হাফিংটনপোস্ট পত্রিকায় ৭ অক্টোবর ২০১০ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদন"। ২২ অক্টোবর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ২০১০।