প্রমথনাথ দত্ত একজন বাঙালি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনকারী বিপ্লবী। বিদেশে ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন। তিনি দাউদ আলি দত্ত নামে বিদেশি বিপ্লবীদের কাছে অধিক পরিচিত হন। তিনি কলকাতার সুকিয়া স্ট্রীটের দত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন।


বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

অল্পবয়েসে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন প্রমথনাথ। বিপ্লবী দলের নির্দেশে, অস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে প্রথম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে দেশের বাইরে চলে যান। ১৯০৬ সালে আমেরিকা যান। সেখানে কোনো সামরিক ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হতে না পেতে ১৯০৯ সালে ফ্রান্সে চলে আসেন। মাদাম কামা প্রভৃতি বিপ্লবীদের সাহায্যে ফরেন লিজিয়নে যোগ দেন ৫ বছরের মেয়াদে। ঐ বাহিনীর সৈনিক হিসেবে ফরাসী ইকোয়েটোরিয়াল আফ্রিকা, ইন্দোচীন ইত্যাদি ফরাসী উপনিবেশগুলি ঘোরেন ও মেয়াদ শেষ হলে বাহিনী ছেড়ে কনস্টান্টিনোপল চলে যান। বৈদেশিক শক্তির সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব প্রচেষ্টা ছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য। কনস্টান্টিনোপল এসে দেশে দাউদ আলি ছদ্মনাম নেন। পরে সারা জীবন এই নামেই পরিচিত হয়েছেন।[১]

মুক্তিবাহিনী গঠন সম্পাদনা

তুরস্কে এসে তার সাথে অপর বিপ্লবী পাণ্ডুরং খানকোজে'র সাথে আলাপ হয়। আমেরিকা থেকে আগত গদর পার্টির বিপ্লবী এবং মধ্যপ্রাচ্যের ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনী থেকে পলাতক বা বন্দী দেশীয় সেপাইদের নিয়ে এক মুক্তিবাহিনী তৈরীর পরিকল্পনা করেন তারা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইরান ও বালুচিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ সাধন। তুরস্কে, আনোয়ার পাশা (সৈনিক) ও তালাত পাশার সাথে দেখা করে নিজেদের পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন।[২] আফগানিস্তান ও বালুচ সীমান্ত এলাকায় প্রমথনাথ ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে আহত হন। আর ইরান সরকারকে চাপ দিয়ে ব্রিটিশরা মুক্তিবাহিনীর বিপ্লবী সৈনিকদের বন্দী করে। তাদের প্রায় সকলকেই গুলি করে মারা হয়। প্রমথনাথ একাধিকবার ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও পলায়নে সক্ষম হন ও আশ্রয় নেন উত্তর ইরানের পার্বত্য উপজাতির মধ্যে। ১৯২১ সালে বীরেন চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখদের অনুরোধে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার প্রমথনাথকে উদ্ধার করে আনে ইরান থেকে।[৩]

অধ্যাপনা সম্পাদনা

পায়ে গুলি লাগার দরুন তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তাকে ক্রাচ নিয়ে চলতে হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকা শুরু করেন। লেনিনগ্রাদ ইনস্টিটিউট ফর ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে বাংলার পাশাপাশি উর্দু ও হিন্দি ভাষা পড়াতেন। সোভিয়েত দেশে বিদেশি ভাষার শিক্ষক হিসেবে প্রমথনাথ ওরফে দাউদ আলি দত্ত ব্যপক পরিচিতি পান।[৪]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

তিনি একজন রুশ মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। তাদের পুত্র ইগর দাউদোভিচ দত্ত একজন পরমাণু বিজ্ঞানী হয়েছিলেন। বিখ্যাত বাঙালি ভূ-পর্যটক বিমল মুখোপাধ্যায় লেনিনগ্রাড গেলে তার সাথে প্রমথনাথের আলাপ হয়। তিনি একদিনের জন্যে তাদের অতিথি হয়েছিলেন।[৫] ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় মারা যান প্রমথনাথ দত্ত।[৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. চিন্মোহন সেহানবীশ (১৯৭৩)। রুশ বিপ্লব ও প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী। কলকাতা: মনীষা গ্রন্থালয়। পৃষ্ঠা ৩২৪–৩২৬। 
  2. খণ্ড ২, শ্রীকৃষ্ণ সরালা (১৯৯৯)। Indian Revolutionaries: A Comprehensive Study, 1757-1961 (ইংরেজি ভাষায়)। প্রভাত প্রকাশন। পৃষ্ঠা ২০১। 
  3. প্রথম খন্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (২০০২)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৩০৭। 
  4. পিনাকী বিশ্বাস (২০২১)। রবীন্দ্রনাথ হত্যা ষড়যন্ত্র ও কতিপয় বিস্মৃত ইতিহাস। কলকাতা: লালমাটি। পৃষ্ঠা ৫৫। আইএসবিএন 978-81-953129-3-1 
  5. বিমল মুখার্জী (২০১৬)। দু চাকায় দুনিয়া। কলকাতা: স্বর্ণাক্ষর প্রকাশন।