পেরিয়র ই. ভি. রামস্বামী

এরোডে ভেঙ্কটাপ্পা রামস্বামী[] (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯-২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩), সাধারণত পেরিয়ার নামে পরিচিত, থানান্তাই পেরিয়ার নামেও পরিচিত, তিনি একজন ভারতীয় সামাজিক কর্মী এবং রাজনীতিবিদ, যিনি আত্ম-সম্মান আন্দোলন এবং দ্রাবিড় কাজগাম শুরু করেছিলেন। তিনি দ্রাবিড় আন্দোলনের পিতা হিসাবে পরিচিত।[] তিনি তামিলনাড়ুতে ব্রাহ্মণ্য কর্তৃত্ব, জাতি প্রজনন ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আদর্শ কাজ করেছেন।[][][]

থানান্তে পেরিয়ার

ই. ভি. রামস্বামী
জন্ম(১৮৭৯-০৯-১৭)১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯
মৃত্যু২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩(1973-12-24) (বয়স ৯৪)
অন্যান্য নামইভিআর, ভিকমন ভিয়ার, ভেঙ্গেদি ভেন্থান
পেশাকর্মী, রাজনীতিবিদ, সামাজিক সংস্কারবাদী
রাজনৈতিক দলভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
জাস্টিস পার্টি
দ্রাবিড় কাজগাম এর প্রতিষ্ঠাতা
আন্দোলনআত্ম-সম্মান আন্দোলন, দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদ
দাম্পত্য সঙ্গীনাগাম্মায় (১৯৩৩ সালে মারা যান), মানিয়ামময়(১৯৪৮- ১৯৭৩)

ই. ভি. রামস্বামী ১৯১২ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন, কিন্তু ১৯২৫ সালে তিনি মনে করেন যে পার্টি শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের স্বার্থে কাজ করছে। তিনি দ্রাবিড় অব্রাহ্মণদের পরাধীনতা বিষয়ে প্রশ্ন করেন যে, ব্রাহ্মণরা অব্রাহ্মণদের থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন কিন্তু তারাই আবার অব্রাহ্মণদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে বঞ্চিত করে।[][] ১৯২৪ সালে, ই.ভি. রামাস্বামী কেরালের ভিকমনে একটি অহিংস আন্দোলনে (সত্যগ্রহ) অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯২৯ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ই.ভি. রামাস্বামী ব্রিটিশ মালয়, ইউরোপ এবং রাশিয়া সফর করেছিলেন, যা তাকে প্রভাবিত করেছিল।[] ১৯৩৯ সালে, ই.ভি. রামাস্বামী জাস্টিস পার্টির প্রধান হয়ে উঠেছিলেন[] এবং ১৯৪৪ সালে তিনি দলটির নাম পরিবর্তন করে দ্রাবিড় কাজগাম করেছিলেন।[১০] পার্টিটি পরে ১৯৪৯ সালে সি এন এননাদুরাই নেতৃত্বে বিভক্ত হয়ে দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজগাম (ডিএমকে) নামে একটি দল গঠন করে।[১০] আত্ম-সম্মান আন্দোলন অব্যাহত রাখার সময় তিনি একটি স্বাধীন দ্রাবিড় নাড়ু (দ্রাবিড়দের ভূমি)-এর পক্ষে সমর্থন করেন।[১১]

ই. ভি. রামাস্বামী যুক্তিবাদ, আত্মসম্মান, নারী অধিকার ও বর্ণপ্রথাকে নির্মূলের নীতিগুলি প্রচার করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের অ-ব্রাহ্মণ দ্রাবিড় জনগণকে শোষণ ও প্রান্তিককরণের বিরোধিতা করেছিলেন এবং ইন্দো-আর্য ভারতকে বিবেচনা করেছিলেন।[১২]

পেরিয়ার পঞ্চাশ বছর ধরে নানা ভাষণে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে সকল নাগরিক সমান এবং জাত-পাত আধারিত পার্থক্য মানুষ দ্বারা তৈরি, যার সৃষ্টি নিরপরাধ এবং নির্বোধ মানুষকে হতভাগ্য রাখার জন্য। যদিও এই ভাষণ সাধারণত নিরক্ষর মানুষের জন্য ছিলো, অনেক পড়াশুনো জানা লোকেরাও এই ভাষণ শুনতেন।[১৩] পেরিয়ার যুক্তিতর্ককে এক বিশেষ যন্ত্র হিসেবে দেখতেন। উনি বিশ্বাস করতেন যে সবাই এই যন্ত্রের অধিকারী, কিন্তু খুব কম লোকে এটির ব্যবহার করে। অতএব, পেরিয়ার সামাজিক গুরুত্বের বিষয়ে যুক্তিতর্ক ব্যবহার করে নিজের শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত করতেন।[১৩] অনেকে মনে করেন পেরিয়ার আসার আগে ধার্মিক পার্থক্য তামিল জাতির সমাজের একটি গভীর বৈশিষ্ট ছিলো।[১৪]

পেরিয়ারের মতে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর শোষণ করে তাকে সদা নিম্নপদস্হ রাখতে চাইছে। পেরিয়ার চাইতেন এই শোষিত গোষ্ঠী উঠে দাঁড়াক এবং নিজের অবস্থার ব্যাপারে চিন্তন করুক, এবং তারপর যুক্তিবাদের সাহায্যে এটা বুঝতে পারুক যে তারা গোনা কয়েকজন লোকের হাতে শোষিত হচ্ছে। শোষিতরা যদি চিন্তন করতে শুরু করে তাহলে ওরা বুঝবে যে কাউর জন্ম তাকে সমাজে অন্যের ঊর্ধ্বে রাখতে পারে না। শোষিতদের নিজেদের জাগাতে হবে এবং এমন সব কিছু করতে হবে যেটা তাদের অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে পারে।[১৩]

পেরিয়ার বোঝালেন যে জ্ঞান একমাত্র চিন্তন করেই লাভ করা সম্ভব, এবং তা হলো চিন্তনের বূ্যহমুখ। জাত সম্বন্ধে তিনি বলতেন যে পৃথিবীর কোনো জীব নিজের শ্রেণীর ক্ষতি করেনা। একমাত্র মানুষ, যার যুক্তি আছে, সে নিজের শ্রেণীর ক্ষতি করছে। সমাজে পার্থক্য, ঘৃণা, শত্রুতা, অবক্ষয়, দারিদ্র, দুষ্টতা সমাজের যুক্তিবাদ কমে যাওয়ার পরিনাম, এটা ঈশ্বরের হাত বা সময়ের নিষ্ঠুরতার জন্য হচ্ছে না। পেরিয়ার অনেক সময় নিজের নানান বই এবং ম্যাগাজিনের রচনায় ব্রিটিশ শাসনকে স্বরাজ থেকে ভালো লিখেছেন।[১৫]

পেরিয়ার পুঁজিপতিদের দোষারোপ করতেন যন্ত্রপাতির ওপর অধিকার করে শ্রমিকদের কষ্ট দেওয়ার জন্য। ওনার মতে কোনো আত্মসম্মান বা জ্ঞান ছাড়া ধন সম্পদ জমিয়ে জীবনের কোন লাভ হয় না। এটি বোঝাতে উনি এই উদাহরণ দেয় পশ্চিমের দেশ যেখানে ভীনগ্রহে বার্তা পাঠাচ্ছে, সেখানে তামিল সমাজ নিজেদের পূর্বপুরুষদের চাল-ডাল পাঠাচ্ছে ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে।[১৫]

ব্রাহ্মণ-সমাজের উদ্দেশে একটি বার্তায় তিনি বলেন "ঈশ্বর, ধর্ম এবং শাস্ত্রের নামে আপনারা আমাদের বোকা বানিয়েছেন। আমরাই একসময়ে রাজ করতাম। এই বছর থেকে আমাদের ঠকানোর জীবন বন্ধ করুন।[১৬] উনি এটিও বলেন "কোনো বিরোধিতা যেটা বিজ্ঞান, অথবা অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেনা, সে বিরোধিতা ঠিক একদিন না একদিন নিজের প্রতারণা, স্বার্থপরতা, মিথ্যে এবং ষড়যন্ত্র উজাড় করে ফেলবে"[১৬]

আত্মসম্মান

সম্পাদনা

পেরিয়ারের আত্মসম্মানের দর্শন ওনার ধারণার এক আদর্শ সমাজের ওপর ভিত্তি, যেটিকে সমস্ত জগতের কাছে গ্রহণযোগ্য। ওনার দর্শনমতে মানুষের কর্ম সবসময় তার যুক্তির অনুসার হওয়া উচিত। মানুষের স্বাভাবিক আচরণ হলো প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি কর্ম এমন কি প্রতিটি স্বভাব একটি জানার ইচ্ছে নিয়ে পরীক্ষা করা, এবং কখনোই গোলামির মতো যুক্তিহীন কিছুর আগে নিজেকে আত্মসমর্পণ না করা। এতএব, পেরিয়ারের আত্মসম্মানের দর্শন এটি শেখায় যে মানুষকে নিজের কর্ম যুক্তির অনুসার করতে হবে। জগতে কি ঠিক এবং কি ভুল সেটা যুক্তি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে, এবং যুক্তি দিয়ে বোঝা তত্ত্বকে সবাইকে মেনে নিতে হবে। স্বাধীনতা মানে 'যুক্তি' দিয়ে খোঁজা 'ঠিক'কে সম্মান দেয়া। 'স্বাধীনতা' এবং 'আত্মসম্মান' এর মধ্যে বেশি পার্থক্য নেই।[১৭]

পেরিয়ারের মানুষের প্রতি সবথেকে প্রাথমিক আবেদন ছিলো নিজের আত্মসম্মান তৈরি করা। ওনার তত্ত্ব অনুযায়ী ব্রাহ্মণরা একচেটিয়া অন্য জাতীদের ঠকিয়ে তাদের আত্মসম্মান বঞ্চিত করেছে বহুকাল ধরে। বেশিরভাগ ব্রাহ্মণরা মনে করে তারা এক "উচ্চতর" জাতি যাদের মন্দির দেখাশুনা এবং পুজো-অর্চনা করার একমাত্র অধিকার আছে। পেরিয়ারের মনে হয় ব্রাহ্মণরা ধর্মের ওপর আবার অধিকার জমাতে চাইছে, নিজেদের বিশেষ পদমর্যাদা দ্বারা যেটা তাদের ঈশ্বর বিগ্রহ ছুঁতে এবং মন্দিরের গর্বগৃহে ঢুকতে অনুমতি দায়ে।[১৪]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "About Periyar: A Biographical Sketch from 1879 to 1909"। Dravidar Kazhagam। ১০ জুলাই ২০০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০১৫ 
  2. "Statue wars: Who was Periyar and why does he trigger sentiment in Tamil Nadu?"The Economic Times। ২০১৮-০৩-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-২৮ 
  3. Mehta, Vrajendra Raj; Thomas Pantham (২০০৬)। Political Ideas in Modern India: thematic explorations। Sage Publications: Thousand Oaks। পৃষ্ঠা 48। আইএসবিএন 978-0-7619-3420-2 
  4. Arora, N.D.; S.S. Awasthy (২০০৭)। Political Theory and Political Thought। Har-Anand Publications: New Delhi। পৃষ্ঠা 425। আইএসবিএন 978-81-241-1164-2 
  5. Thakurta, Paranjoy Guha; Shankar Raghuraman (2004). A Time of Coalitions: Divided We Stand. Sage Publications. New Delhi. p. 230. আইএসবিএন ০-৭৬১৯-৩২৩৭-২.
  6. "Biography of Periyar E.V. Ramasami (1879–1973)"। Barathidasan University। ১৪ জুন ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ 
  7. Kandasamy, W.B. Vansantha; Florentin Smarandache; K. Kandasamy (২০০৫)। Fuzzy and Neutrosophic Analysis of E.V. Ramasamy's Views on Untouchability। HEXIS: Phoenix। পৃষ্ঠা 106। আইএসবিএন 978-1-931233-00-2 
  8. Saraswathi, p. 54.
  9. Kandasamy (২০০৫)। NFuzzy and Neutrosophic Analysis of E.V. Ramasamy's Views on Untouchability। American Research Press। পৃষ্ঠা 109। আইএসবিএন 978-1-931233-00-2 
  10. Pandian, J., (1987). Caste, Nationalism, and Ethnicity. Popular Prakashan Private Ltd.: Bombay. pp. 62, 64. আইএসবিএন ০৮৬১৩২১৩৬৭.
  11. Chatterjee, Debi [1981] (2004) Up Against Caste: Comparative study of Ambedkar and Periyar. Rawat Publications: Chennai. pp. 40-42. আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭০৩৩-৮৬০-৪
  12. "10 Reasons Why Ambedkar Would Not Get Along Very Well With 'Periyar'"। ৭ মে ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  13. Gopalakrishnan, pp. 59-60.
  14. Gopalakrishnan, pp. 45–49.
  15. Veeramani 2005, p. 511.
  16. Veeramani 2005, p. 504.
  17. Saraswathi, p. 2.

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা