পুলি কালি (অর্থ: বাঘের নাচ) হল ভারতের কেরালা রাজ্যের একটি বিনোদনমূলক লোকশিল্প।[১][২] ভারতের কেরালা রাজ্যে উদযাপিত একটি বার্ষিক ফসলের উৎসব ওনম উপলক্ষে মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত শিল্পীদের দ্বারা প্রধানত এটি পরিবেশিত হয়।[৩] ওনম উদযাপনের চতুর্থ দিনে (নালাম ওনম বা চাথায়াম), প্রদর্শনকারীরা তাদের শরীরে উজ্জ্বল হলুদ, লাল ও কালো রঙে বাঘ এবং চিতাবাঘের মতো অঙ্কন করে। নৃত্যের সময় তারা তাদের উদরের আন্দোলনের মাধ্যমে নৃত্য করে। তারা উদুক্কু এবং থাকিলের মতো বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচে।[৪] পুলি কালির আভিধানিক অর্থ হল 'বাঘের নাচ'।[২] তাই নৃত্য পরিবেশনাটি বাঘ শিকারের আখ্যানকে ঘিরে চলে। এই লোকশিল্প প্রধানত কেরালার ত্রিশূর জেলায় চর্চা করা হয়।[২] ওনমের চতুর্থ দিনে অনুষ্ঠানটি দেখার সেরা জায়গা হল ত্রিশূর। সেখানে সমস্ত জেলা থেকে পুলিকালি দলগুলি তাদের দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য একত্রিত হয়।[৫][৬] উৎসবটি ত্রিশূর শহরে হাজার হাজার মানুষকে আকর্ষণ করে।[৬] পুলি কালি অন্যান্য বিভিন্ন উৎসব মরশুমেও সঞ্চালিত হয়।[২]

পুলি কালি
പുലിക്കളി
ধরনপুলি কালি (বাঘ নৃত্য)
তারিখসমূহচিংম মাসের ৪র্থ ওনাম দিন (বিশাখাম)
পুনরাবৃত্তিবার্ষিক
ঘটনাস্থলস্বরাজ রাউণ্ড, ত্রিশূর
দেশভারত
গঠিত১৮৮৬; ১৩৮ বছর আগে (1886)
প্রতিষ্ঠাতাসাকথান থামপুরান

ইতিহাস সম্পাদনা

পুলি কালির উৎপত্তি ২০০ বছর আগে। কোচিনের তৎকালীন মহারাজা, মহারাজা রাম বর্মা সাকথান থামপুরান এই লোকশিল্পের প্রবর্তন করেছিলেন বলে জানা যায়।[২] শিল্পীরা বাঘের মতো অদ্ভুত পদক্ষেপের সাথে বাঘের মতো সজ্জিত হয়ে এই নৃত্যরূপটি পরিবেশন করত। এটি তখন 'পুলিক্কেত্তিকালি' নামে পরিচিত ছিল এবং স্থানীয়রা অত্যন্ত উপভোগ করত। এই অনুষ্ঠানের স্মরণে ত্রিশূরের পুলি কালি অনুষ্ঠিত হয়।[৭]

 
পুলি কালি শিল্পী

আধুনিক সম্পাদনা

 
পুলি কালি ২০১০

বছরের পর বছর ধরে, পুলি কালি নৃত্যশিল্পীদের সাজসজ্জায় পরিবর্তন এসেছে। প্রারম্ভিক দিনগুলিতে, মুখোশ ব্যবহার করা হত না এবং অংশগ্রহণকারীরা তাদের মুখের উপরেও নিজেরাই রঙ করত। কিন্তু এখন, অংশগ্রহণকারীরা আগে থেকে তৈরি করা মুখোশ, নকল দাঁত, জিভ, দাড়ি এবং গোঁফ ব্যবহার করে এবং সেইসঙ্গে নিজেদের গায়ে রং দিয়ে আঁকে। এই বাঘশিল্পীরা তাদের কোমরে ঝুমঝমি সহ একটি প্রশস্ত বেল্টও পরে থাকে।[২] ত্রিশূরের শিল্পটি এখন একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে যুবকরা যারা উৎসবে অংশ নিতে এগিয়ে আসে। এছাড়াও স্পনসরদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। অনুষ্ঠানটি পুলিকালি কো-অর্ডিনেশন কমিটি দ্বারা সংগঠিত হয়। এটি পুলিকালি গোষ্ঠীগুলির একটি ঐক্যবদ্ধ পরিষদ, যা ২০০৪ সালে ত্রিশূরে সংগঠিত হয়েছিল। এই পরিষদ শিল্পটির সমস্ত আসল রঙ এবং সুর বজায় রেখে তাকে সংরক্ষণ ও প্রচার করে। ত্রিশূর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন প্রতিটি পুলিকালি দলের জন্য ৩০,০০০ টাকা ($৪০০) অনুদান দেয়।

সাধারণত, পুরুষ এবং শিশুরা এই নৃত্য শিল্পে ভাগ নেয়। প্রথমবারের মতো, ২০১৬ সালে ত্রিশূরের পুলিকালিতে ৫১-সদস্যের একটি দলের মধ্যে ৩ জন মহিলা অংশগ্রহণ করেছিলেন।[৮][৯]

কোভিড-১৯ এবং লকডাউন বিধিনিষেধের কারণে, অনেক ওনম উদযাপন স্থগিত করা হয়েছিল। আয়ানথোল দেশম পুলি কালি সমিতির উদ্যোগে, পুলি কালি তাদের ফেসবুক পাতায় সরাসরি দেখানো হয়েছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে কার্যত প্রায় ১৭ জন লোক নৃত্যে অংশ নেন।[১০][১১][১২]

প্রস্তুতি সম্পাদনা

এই লোকশিল্পের একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল পরিবেশনকারীদের রঙিন চেহারা। টেম্পেরা পাউডার এবং বার্নিশ বা এনামেলের একটি নির্দিষ্ট সংমিশ্রণ থেকে রং তৈরি করা হয়।[২][৬] প্রথমত, নর্তকরা শরীরের লোম কামিয়ে ফেলে এবং তারপরে, রঙের প্রাথমিক লেপন তাদের উপর প্রয়োগ করা হয়।[৬] লেপ শুকোতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। এর পরে, রংয়ের দ্বিতীয় আবরণটি একটি উন্নত নকশার সাথে প্রয়োগ করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত ঘন্টা সময় নেয়।[৬] বাঘের গায়ে রং লাগানোর জন্য বিপুল সংখ্যক শিল্পী জড়ো হয়। এটি একটি সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া এবং প্রায়শই অত্যন্ত ভোরে এটি শুরু হয়। বিকেল নাগাদত্রিশূরের চারি দিক থেকে পুলি কালি গোষ্ঠী বা 'সঙ্গম', মিছিলে করে এগিয়ে আসতে থাকে। তারা বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নেচে, লাফিয়ে ও উদর সঞ্চালন ক'রে প্যালেস রোড, করুণাকরণ নাম্বিয়ার রোড, শোর্নুর রোড, এ আর মেনন রোড এবং এমজি রোড হয়ে রাস্তার মধ্য দিয়ে ত্রিশূর শহরের কেন্দ্রস্থল স্বরাজ রাউণ্ডে এসে পৌঁছোয়।[৬]

 
পিঠে বাঘের ডোরা আঁকছেন শিল্পী।

বাঘ একটি প্রাণীকে শিকার করছে বা শিকারী একটি বাঘ শিকার করছে, এইরকম দৃশ্য সুন্দরভাবে তৈরি করা হয়।[৬] হাজার হাজার দর্শক রাস্তায় লাইন দিয়ে নাচ উপভোগ করে, নর্তকদের উৎসাহিত করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নাচে যোগ দেওয়ারও চেষ্টা করে। দলগুলি ভাদাকুন্নাথন মন্দিরের সামনে ত্রিশূরের স্বরাজ রাউণ্ডে নাডুভিলালে একত্রিত হয় এবং মাঠের চারপাশে শোভাযাত্রা করার আগে এখানে গণপতি মন্দিরের (নাদুভিলাল গণপতি কোভিল) দেবতাকে একটি করে নারকেল অর্পণ করে। শোভাযাত্রায় প্রতিটি গ্রামের সজ্জিত বাহনও থাকে। প্রতিটি দল অন্যের থেকে ভালোভাবে বাহন সজ্জা করার প্রতিযোগিতা করে। এর পাশাপাশি সেরা পোশাক পরা বাঘ নিয়েও প্রতিযোগিতা হয়।[২]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Pulikkali Procession on the occasion of Athachamayam celebrations in Tripunithura, Kerala, Musicmalt.com
  2. "Pulikali-The Tiger Dance, Swaraj Round Thrissur | Pulikali Onam Festival"Kerala Picnic Spot (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৪ 
  3. "Pulikali"Kerala Tourism (English ভাষায়)। জানুয়ারি ১৮, ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  4. "Pulikali, Tiger Dance, Onam" (English ভাষায়)। নভেম্বর ২৪, ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  5. "Culture & Heritage | District Thrissur, Government Of Kerala | India" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৪ 
  6. "Puli Kali"IndiaNetzone.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৪ 
  7. "Colourful tiger art with folk dance for Onam"Sify। ১৭ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১০ 
  8. "Tigresses roar: Kerala's Pulikali dance sees women actors for the first time in 200 years"। সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৬। 
  9. "Three women make roaring entry into Kerala's male-dominated Pulikali show" 
  10. "This year, over 25,000 Pulikali lovers watched the 'tigers' from Thrissur online" 
  11. "Pulikkali to go online this Onam" 
  12. "A virtual 'pulikali' in Thrissur this year" 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

টেমপ্লেট:Tourist attractions in Thrissurটেমপ্লেট:Culture of Keralaটেমপ্লেট:Tourism in Kerala