পিরামিড
পিরামিড (Pyramid) হলো এক প্রকার জ্যামিতিক আকৃতি বা গঠন যার বাইরের তলগুলো ত্রিভূজাকার (Triangular) এবং যারা শীর্ষে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। পিরামিড একটি বহুভূজাকৃতি ভূমির উপর অবস্থিত। বহুভূজের উপর অবস্থিত যে ঘনবস্তুর একটি শীর্ষবিন্দু থাকে এবং যার পার্শ্বতলগুলো প্রত্যেকটি ত্রিভুজাকার, তাকে পিরামিড বলে। পিরামিডের ভূমি যেকোনো আকারের বহুভূজ (Polygon) হতে পারে এবং এর পার্শ্বতলগুলো যেকোনো আকারের ত্রিভূজ (Triangle) হতে পারে। একটি পিরামিডের কমপক্ষে তিনটি ত্রিভূজাকার পার্শ্বতল (Triangular outer surfaces) থাকে, অর্থাৎ পিরামিডের ভূমিসহ কমপক্ষে চারটি তল থাকে। বর্গাকার পিরামিড (Square Pyramid) হলো এমন একটি পিরামিড যা একটি বর্গাকার ভূমির উপর অবস্থিত এবং যার চারটি ত্রিভুজাকার পার্শ্বতল আছে। এই ধরনের পিরামিডের বহুল ব্যবহার আছে।
পিরামিডের ডিজাইন এমনভাবে করা হয় যেব এর বেশি ওজন ভূমির নিকটে থাকে, ফলে এর আয়তনকেন্দ্র (Centre of volume) শীর্ষ হতে লম্ব দূরত্বের এক-চতুর্থাংশে অবস্থিত।
পিরামিড পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্যের একটি। প্রাচীন মিশর শাসন করতেন ফিরাউনরা (প্রাচীন মিশরীয় শাসক বা রাজাদের ফিরাউন (Pharaoh) বলা হতো)। তাদেরকে কবর বা সমাধী দেয়ার জন্যই পিরামিড নির্মান করা হতো। মিসরে ছোটবড় ৭৫টি পিরামিড আছে। সবচেয়ে বড় এবং আকর্ষনীয় হচ্ছে গিজা'র পিরামিড যা খুফু'র পিরামিড হিসেবেও পরিচিত। এটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর আগে। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১ ফুট। এটি ৭৫৫ বর্গফুট জমির উপর স্থাপিত। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং শ্রমিক খেটেছিল আনুমানিক ১ লাখ। পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিল বিশাল বিশাল পাথর খন্ড দিয়ে। পাথর খন্ডের এক একটির ওজন ছিল প্রায় ৬০ টন, আর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুটের মত। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর দুরান্তের পাহাড় থেকে। পাথরের সাথে পাথর জোড়া দিয়ে পিরামিড তৈরি করা হত। চার হাজারের বছরের পুরানো এক সমাধিতে অঙ্কিত এক চিত্রে দেখা যায় এক বিশাল স্তম্ভকে স্লেজে করে সরানো হচ্ছে; অনেক মানুষ রশি দিয়ে সেই স্লেজ টেনে নিচ্ছে। আর তাদের মধ্যে একজন পাত্র থেকে জল ঢালছে বালির উপরে। এতে ঘর্ষণ প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। এভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আড়াই টন ওজনের এক একটা ব্লক।[১]
পিরামিড সম্পর্কিত কতিপয় সংজ্ঞাসম্পাদনা
পিরামিডসম্পাদনা
কোনো বহুভূজের উপর অবস্থিত যে ঘনবস্তুর একটি শীর্ষবিন্দু থাকে এবং যার পার্শ্বতলগুলোর প্রত্যেকটি ত্রিভুজাকার তাকে পিরামিড (Pyramid) বলে।
সুষম পিরামিডসম্পাদনা
যে পিরামিডের ভূমি সুষম বহুভূজ এবং পার্শ্বতলগুলো সর্বসম ত্রিভুজ তাকে সুষম পিরামিড বলে।
পিরামিডের ভূমিসম্পাদনা
যে বহুভূজের উপর পিরামিড অবস্থিত, তাকে পিরামিডের ভূমি (Ground/Base) বলে।
পিরামিডের পার্শ্বতলসম্পাদনা
পিরামিডের ভূমি ব্যাতিত একটি বিন্দুতে মিলিত অন্যাব্য ত্রিভূজাকাত তলগুলোকে পিরামিডের একটি পার্শ্বতল (Outer Surface) বলে।
পিরামিডের ধারসম্পাদনা
পিরামিডের দুইটি সন্নিহিত তল অর্থাৎ দুইটি পার্শ্বতল অথবা একটি পার্শ্বতল ও ভুমি যে রেখায় মিলিত হয়, তাকে পিরামিডের একটি ধার (Edges) বলে। আবার, পিরামিডের শীর্ষবিন্দু ও ভূমির যেকোনো কৌণিক বিন্দুর সংযোজক সরলরেখকে পিরামিডের ধার বলে।
পিরামিডের শীর্ষবিন্দুসম্পাদনা
পিরামিডের পার্শ্বতলগুলো যে একটি সাধারণ বিন্দুতে মিলিত হয়, তাকে পিরামিডের শীর্ষবিন্দু (Vertex) বলে।
পিরামিডের উচ্চতাসম্পাদনা
পিরামিডের শীর্ষ হতে ভূমির উপর অঙ্কিত লম্বদৈর্ঘ্যকে পিরামিডের উচ্চতা (Height) বলে।
প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভসম্পাদনা
মেসোপটেমিয়াসম্পাদনা
মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা সর্বপ্রথম পিরামিড আকৃতির স্থাপনা তৈরি করেছিল। এদের জিগুরাত নামে ডাকা হত। প্রাচীনকালে এদের উজ্জল সোনালি/তামাটে রঙ করা হত। যেহেতু এদের রোদে শুকানো কাদামাটির ইট দিয়ে তৈরী করা হত, এদের খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। স্থানীয় ধর্মের জন্য সুমেরইয়, ব্যাবিলনইয়ান,এলামাইট,আক্কাদীয় এবং আসিরীয়ানরা জিগুরাত বানাত। প্রতিটি জিগুরাত একটি মন্দির কমপ্লেক্সের অন্তর্গত ছিল যেখানে অন্যান্য স্থাপনাও থাকত। জিগুরাতের পূর্বসুরী উত্তোলিত মাচা যা চার হাজার খ্রিস্টপূর্বের উবাইদ আমল থেকে বিদ্যমান[২]। সবচেয়ে প্রাচীন জিগুরাতগুলো নির্মাণ শুরু হয়েছিল প্রাথমিক সুমেরীয় সভ্যতার শেষ দিকে। আর সর্বশেষ মেসোপটেমিয়ান জিগুরাত ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বের।
বর্গাকার,ডিম্বাকার অথবা আয়তাকার ভিত্তির উপর ক্রমহ্রাসমান স্তরে স্তরে তৈরী জিগুরাত ছিল একটি পিরামিড আকৃতির স্থাপনা, যার চূড়া ছিল সমতল। জিগুরাত এর কেন্দ্র হত রোদে পোড়ানো ইটের তৈরি, আর এর সম্মুখভাগ ছিল আগুনে পোড়া ইট মোড়ানো। এদের সম্মুখভাগ প্রায়ই বিভিন্ন রঙের প্রলেপ দেয়া থাকত, যা জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত গুরুত্ব বহন করত। মাঝে মাঝে রাজারা তাঁদের নাম এসব রাঙানো ইটে নিজেদের নাম অঙ্কন করে রাখতেন। স্তরের সংখ্যা দুই থেকে সাতের মাঝে উঠা নামা করত। এটা ধরে নেওয়া হয় যে এদের চুড়ায় মন্দির থাকত। কিন্তু এর পক্ষে কোন ভূতাত্তিক প্রমাণ পাওয়া যায় না এবং একমাত্র লিখিত প্রমাণ হচ্ছে হেরোডোটাস[৩]। মন্দিরে প্রবেশ করার পথ ছিল জিগুরাতের এক পাশে সারি সারি সিঁড়ি অথবা এর চারদিক ঘেরা সর্পিল সিঁড়ি যা তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত থাকত। মেসোপটেমিয়ান জিগুরাত সাধারণ মানুষের উপাসনা বা অনুষ্ঠানের জায়গা ছিল না। এদের ঐশ্বরিক বাসস্থান হিসেবে মানা হত এবং প্রতিটি নগরের নিজস্ব ঈশ্বর ছিলেন। কেবল পুরোহিতরা জিগুরাতের উপরে বা এর তলদেশের ঘরসমূহে প্রবেশ করতে পারত কারণ ঈশ্বরদের দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। সুমেরীয় সভ্যতায় পুরোহিতরা বেশ প্রভাবশালী সদস্য ছিল।
মিশরসম্পাদনা
পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত পিরামিডগুলো মিশরে অবস্থিত। এগুলো ইট বা পাথরের তৈরি বিশাল স্থাপনা, যার মাঝে কিছু কিছু বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থাপনা হিসেবে পরিগণিত।
আত্মার বাসস্থানসম্পাদনা
প্রাচীনকালে মিশরীয়রা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো, মৃত্যুর পরও তাদের আত্মা বেঁচে থাকে। কাজেই পরবর্তী জীবনে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, জীবনটাকে যাতে উপভোগ করা যায়, সে চিন্তায় মিশরীয়রা অস্থির থাকতো। ব্যক্তির গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে গুরুত্ব আরোপ করা হতো এ ব্যাপারে। ব্যক্তি যতো গুরুত্বপূর্ণ হতো এ কাজে গুরুত্ব ততো বেশি বেড়ে যেতো। পরবর্তী জীবনের আরাম-আয়েশের জন্য স্বভাবতই ফারাওদের ব্যাপারেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। ক্ষমতায় আসা নতুন ফারাওয়ের প্রথম কাজ সম্পন্ন করা। প্রত্যেকেই চাইতেন বিশাল আয়তনের হোক তার সমাধিক্ষেত্র। অনেকেই মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যেত। এসব সমাধিক্ষেত্র আসলে মৃতের আত্মার ঘর। মিশরীয়রা মনে করত, লাশ বা মৃতদেহ টিকে থাকার ওপরই নির্ভর করে আত্মার বেঁচে থাকা বা ফিরে আসা। এ কারণেই মৃতদেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মমি করতো তারা। আত্মার বেঁচে থাকার জন্য চাই প্রয়োজনীয় নানা জিনিস। তাই নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিশেষ করে খাবার-দাবার মৃতদেহের সাথে দিয়ে দিতো তারা। সমাধিস্তম্ভ প্রধানের দায়িত্ব ছিলো দস্যুদের হাত থেকে মৃতদেহ আর তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রক্ষা করার। কিন্তু কবরে সমাধিত ব্যক্তিটি কত বিপুল পরিমাণ বিত্ত আর ক্ষমতাবান ছিল তা জাহিরের উদ্দেশ্যেও নির্মাণ করা হতো পিরামিড। তাই ফারাওদের মৃতদেহের সাথে কবরস্থ করা হতো বিপুল ধন-সম্পদ। সমাজের বিত্তশালীদের কবরেও মূল্যবানসামগ্রী দেয়া হতো। এমনকি, নিন্মশ্রেণীর মানুষদের কবরেও সামান্য পরিমাণ হলেও কিছু খাবার রেখে দেয়া হতো।[৪]
ছবির গ্যালারীসম্পাদনা
স্টকপোর্ট পিরামিড, যুক্তরাজ্য
ওয়াল্টার পিরামিড, দীর্ঘ সৈকত (Long Beach), ক্যালিফর্নিয়া
The Pyramid Arena in Memphis, Tennessee
Hanoi Museum in Hanoi, Vietnam features an overall design of a reversed Pyramid.
Metairie Cemetery, New Orleans
The Summum Pyramid in Salt Lake City, Utah
আরও দেখুনসম্পাদনা
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
বহিঃসংযোগসম্পাদনা
- National Geographic
- nytimes.com, In the Shadow of a Long Past, Patiently Awaiting the Future. *books.google
- EVALUATIONS OF CULTURAL PROPERTIES, UNESCO.
- books.google, Nubian Pyramids Kings Tomb.
- https://plus.google.com/u/0/116256788494132584731/posts/FqKk8vTvx4a?pid=6057736151829317970&oid=116256788494132584731