পাটলীপুত্র
পাটলীপুত্র ছিল প্রাচীন ভারতের একটি শহর। এটি অধুনা ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা শহরের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে মগধের রাজা অজাতশত্রু গঙ্গা নদীর তীরে একটি ছোটো দুর্গের আকারে (পাটলীগ্রাম) পাটলীপুত্র শহরটি স্থাপন করেন।[১]
পাটলীপুত্র | |
---|---|
প্রাচীন শহর | |
পাটনার মানচিত্র | |
স্থানাঙ্ক: ২৫°৩৬′৪০″ উত্তর ৮৫°০৮′৩৮″ পূর্ব / ২৫.৬১১° উত্তর ৮৫.১৪৪° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | বিহার |
অঞ্চল | মগধ |
বিভাগ | পাটনা |
জেলা | পাটনা |
সরকার | |
• শাসক | পাটনা পৌরসংস্থা |
উচ্চতা | ৫৩ মিটার (১৭৪ ফুট) |
আধুনিক পাটনা শহরের নিকটবর্তী অঞ্চলে ব্যাপকহারে পুরাতাত্ত্বিক খননকার্য চালানো হয়েছে।[২] ২০শ শতাব্দীর প্রথম দিকে চালানো খননকার্যের ফলে জানা গিয়েছে, এখানে একটি বড়ো আকারের দুর্গ অবস্থিত ছিল। এও জানা গিয়েছে যে, সেই দুর্গটিকে শক্তপোক্ত করার জন্য কাঠের ব্যবহার করা হয়েছিল।[৩]
নাম ব্যুৎপত্তি
সম্পাদনাপাটলীপুত্রের নামকরণের ইতিহাস অস্পষ্ট। ‘পুত্র’ শব্দের অর্থ ছেলে। ‘পাটলী’ ধানের একটি প্রজাতির নাম (বিগনোনিয়া সুয়াভেওলেনস)। [৪] একটি কিংবদন্তি অনুসারে,[৫] ধানের উক্ত প্রজাতিটির নামেই এই শহরের নামকরণ করা হয়েছিল।[৬] অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে, ‘পাটলীপুত্র’ নামটির অর্থ পাটলীর পুত্র। এই পাটলী ছিলেন রাজা সুদর্শনের কন্যা।[৭] এই শহরটি আগে পাটলীগ্রাম নামেও পরিচিত ছিল। কোনো কোনো গবেষকের মতে ‘পাটলীপুত্র’ শব্দটী এসেছে ‘পাটলীপুর’ শব্দটি থেকে।[৮]
ইতিহাস
সম্পাদনাআদি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলির (তিপিটক ও আগম) আগে পাটলীপুত্রের কোনো লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় না। উক্ত ধর্মগ্রন্থগুলিতে এটিকে পাটলীগ্রাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে এই অঞ্চলের প্রধান শহরগুলির তালিকায় পাটলীগ্রামের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।[৯] আদি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় যে, গৌতম বুদ্ধের জীবনের শেষ পর্যায়ে পাটলীগ্রামের কাছে একটি শহর তৈরি হচ্ছিল। পুরাতাত্ত্বিক খননকার্য থেকেও জানা গিয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় বা ৪র্থ শতাব্দীর আগে ওই অঞ্চলে নগরায়ণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।[৯] খ্রিস্টপূর্ব ৩০৩ অব্দে গ্রিক ঐতিহাসিক ও রাজদূত মেগাস্থিনিস তাঁর গ্রন্থ ইন্ডিকাতে পাটলীপুত্রের নাম উল্লেখ করেন।[১০]
পাটলীপুত্র শহরটি উত্তর মধ্য ভারতে অবস্থিত থাকায় এখানেই পরপর অনেকগুলি রাজবংশ তাদের রাজধানী স্থাপন করেছিল। এই রাজবংশগুলির মধ্যে নন্দ, মৌর্য, শুঙ্গ, গুপ্ত ও পাল রাজবংশ উল্লেখযোগ্য।[১১] গঙ্গা, গণ্ডকী ও সোন নদীর সংযোগ স্থলে অবস্থিত পাটলীপুত্র ছিল একটি ‘জলদুর্গ’।[১২] এই অবস্থানগত সুবিধের জন্য মগধ সাম্রাজ্যের গোড়ার দিকে সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে উক্ত সাম্রাজ্যের শাসকদের সুবিধে হয়েছিল। পাটলীপুত্র ছিল ব্যবসা ও বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। বণিক ও বিদ্বজ্জনেরা এই শহরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ চাণক্য এই শহরে বাস করতেন।
আদি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত প্রথম দুটি বৌদ্ধ সঙ্গীতি এই শহরে আয়োজিত হয়েছিল। এদুটি হল: বুদ্ধের পরিনির্বাণের অব্যবহিত পরে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি এবং সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি। জৈন ও ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় অজাতশত্রুর ছেলে উদয়ভদ্র পাটলীপুত্রকে মগধের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।[৯]
মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও মহামতি অশোকের রাজত্বকালে পাটলীপুত্র সমৃদ্ধির মধ্যগগনে আরোহণ করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে পাটলীপুত্র ছিল সেকালের বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলির অন্যতম। মৌর্য শাসনে এই শহরের উন্নতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন গ্রিক রাজদূত মেগাস্থিনিস। তিনি এই শহরটিকে "পালিবোথরা" বলে উল্লেখ করেন। পাটলীপুত্রে অশোকের প্রাসাদ ও সারা ভারতে তাঁর স্তম্ভগুলি নির্মিত হয়েছিল আখমানেশীয় প্রাসাদ ও পারসেপোলিস স্তম্ভগুলির আদলে। পাটলীপুত্রের অভ্যন্তরীণ স্থাপত্য ও অশোকের স্তম্ভগুলি পারস্যের অ্যাকিমেনিড স্থাপত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।[১৩]
পাটলীপুত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ কেন্দ্র ছিল। এখানে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ মঠ অবস্থিত ছিল। গুপ্ত (খ্রিস্টীয় ৩য়-৬ষ্ঠ শতাব্দী) ও পাল (খ্রিস্টীয় ৮ম-১২শ শতাব্দী) সাম্রাজ্যেও পাটলীপুত্র ছিল রাজধানী। হিউয়েন সাং যখন এই শহরে এসেছিলেন, তখন এটি অনেকাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ১২শ শতাব্দীতে মুসলমান আক্রমণের সময় এই শহর আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[১৪] পরবর্তীকালে শেরশাহ সুরি পাটলীপুত্রকে রাজধানী করে এই শহরের নাম রাখেন পাটনা।
গঠন
সম্পাদনাপুরাতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাচীন শহরের একটি অংশের সন্ধান পাওয়া গেলেও, এর কিছু অংশ এখনও আধুনিক পাটনা শহরের মাটির নিচে অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে। মৌর্য রাজত্বকালে শহরটির আকৃতি ছিল চতুষ্কোণাকার। এটির দৈর্ঘ্য ছিল ১.৫ মাইল এবং প্রস্থ ছিল ৯ মাইল। শহরের কাঠের প্রাচীরের গায়ে ৬৪টি প্রবেশদ্বার ছিল। মনে করা হয়, অশোকের সময় কাঠের প্রাচীরের পরিবর্তে পাথরের প্রাচীর দেওয়া হয়।
চিত্রকক্ষ
সম্পাদনা-
মগধ সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলীপুত্র
-
নন্দ সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলীপুত্র
নন্দ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন মহাপদ্মনন্দ (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দ) -
শুঙ্গ সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলীপুত্র
খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ অব্দে শুঙ্গ সাম্রাজ্য সর্বাধিক বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল। -
গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলীপুত্র।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তার -
শেরশাহ সুরির সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটনা
পাটলীপুত্রের প্রত্নস্থল
সম্পাদনাআরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ Kulke, Hermann; Rothermund, Dietmar (২০০৪), A History of India, 4th edition. Routledge, Pp. xii, 448, আইএসবিএন 0-415-32920-5 .
- ↑ "Patna". Encyclopædia Britannica. Encyclopædia Britannica Online. Encyclopædia Britannica Inc., 2013. Web. 13 Dec. 2013 <http://www.britannica.com/EBchecked/topic/446536/Patna>.
- ↑ Valerie Hansen Voyages in World History, Volume 1 to 1600, 2e, Volume 1 pp. 69 Cengage Learning, 2012
- ↑ Monier-Williams Sanskrit-English Dictionary: Pāṭali, [১] (a junior synonym of Stereospermum colais [২] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ জুলাই ২০১১ তারিখে)
- ↑ Encyclopaedia of Religion and Ethics, p.677
- ↑ Folklore, Vol. 19, No. 3 (September 30, 1908), pp. 349–350
- ↑ The Calcutta Review Vol LXXVI (1883), p.218
- ↑ Language, Vol. 4, No. 2 (June , 1928), pp. 101–105
- ↑ ক খ গ Sujato, Bhikkhu; Bhikkhu, Brahmali, "1.1.5", The Authenticity of the Early Buddhist Texts (পিডিএফ), Oxford Center for Buddhist Studies[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ].
- ↑ "Realty to broaden horizon"।
- ↑ Thapar, Romilak (১৯৯০), A History of India, Volume 1, New Delhi and London: Penguin Books. Pp. 384, আইএসবিএন 0-14-013835-8 .
- ↑ The Pearson Indian History Manual, Pearson Education India, A94.
- ↑ The Analysis of Indian Muria Empire affected from Achaemenid’s architecture art ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে. In: Journal of Subcontinent Researches. Article 8, Volume 6, Issue 19, Summer 2014, Page 149-174.
- ↑ Scott, David (মে ১৯৯৫)। "Buddhism and Islam: Past to Present Encounters and Interfaith Lessons"। Numen। 42 (2)। ডিওআই:10.1163/1568527952598657।
আরও পড়ুন
সম্পাদনা- Bernstein, Richard (2001). Ultimate Journey: Retracing the Path of an Ancient Buddhist Monk (Xuanzang) who crossed Asia in Search of Enlightenment. Alfred A. Knopf, New York. আইএসবিএন ০-৩৭৫-৪০০০৯-৫