নক্ষত্রের রাত
নক্ষত্রের রাত কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত একটি কালজয়ী নাটক। সামাজিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত নাটকটি বিটিভিতে প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৯৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি।[১] এতে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, দিলারা জামান, আসাদুজ্জামান নূর, আব্দুল কাদের, লাকি ইনাম, ড. ইনামুল হক, জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, আজিজুল হাকিম, মেহের আফরোজ শাওন, শিলা আহমেদ, আলী যাকের, সারা যাকের, কবির আহমেদ প্রমুখ।[২]
সার সংক্ষেপ
সম্পাদনাহুমায়ূন আহমেদের নাটক বেশির ভাগ পারিবারিক। নক্ষত্রের রাত নাটকও একটা পারিবারিক নাটক। নাটকটিতে সেই সময়ের বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প ফুটে উঠেছে। পরিবারের সবার সাথে সবার ভালোবাসা, মায়া, মহব্বত, সুখ দুঃখ ভাগাভাগি, বাবা-মায়ের সাথে ছেলে মেয়ের ভালোবাসা, ভাইদের সাথে বোনের ভালোবাসা, মজা মশকরা, হাসিঠাট্টা সব কিছু ফুটে উঠেছে।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের আরেকটা বৈশিষ্ট্য ধর্ম চর্চা। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রেমী।
হুমায়ূন আহমেদ প্রায় নাটকেই ধর্ম চর্চা পরিলক্ষিত হয়। নামাজ পড়া, আল কোরআন তেলাওয়াত করা, রোজা রাখা ইত্যাদি। যা নাটকগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলে। এই নাটকটিতে মনিষার বাবাকে নামাজ পড়তে ও ধর্ম চর্চা করতে দেখা যায়। যা দ্বারা বাংলাদেশের মানুষের ধর্মভীরুতা লক্ষ্য করা যায়।
নাটকের শুরুতে দেখা যায় শমী কায়সার আজিজুল হাকিমের মাথায় পানি ঢালছে আর উপর থেকে এক ভদ্রলোক মনীষা মনীষা বলে চীৎকার করছে। মনীষা (শমী কায়সার) মাথায় পানি ঢালা শেষ করে দৌড়ে উপরে গিয়ে দেখে তার বাবা (আবুল হায়াত) চায়ের কাপ সামনে নিয়ে প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করছে! ঘটনা কি জানার জন্য সে বাবার কাছে গিয়ে দেখে ভদ্রলোকের সামনের টেবিলের উপর সাতটি মরা পিঁপড়ে! যা তিনি এইমাত্র তাঁর চায়ের কাপ থেকে উদ্ধার করেছেন! এবং তার জন্যই সকাল সকাল এত চেঁচামেচি। মনীষা বোঝানোর চেষ্টা করে চায়ে যে চিনি দেওয়া হয়েছে সেই চিনির কৌটায় পিঁপড়ে ছিল যা সে খেয়াল করেনি! ভদ্রলোক মানতে নারাজ! মনীষাকে চোখের সামনে থেকে দূর হতে বলে সে আছাড় দিয়ে কাপ প্লেট দুটোই ভেঙ্গে ফেলে!
মনীষা কিছুক্ষন স্থির চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে চলে আসে।
মনীষা এ বাড়ির ছোট মেয়ে। সুন্দরী, মেধাবী, বুদ্ধিমতী। বাড়ির সকলের প্রাণ সে। তার মা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি, এই সময় বাড়ির আপাত বিচিত্র সদস্যগুলোকে নিয়ে সে বেশ গুছিয়েই সংসার করছে। প্রতিটা মানুষকে সে বেঁধে রেখেছে আশ্চর্য নিপুণতায়। দেখে মনে হয় এই বিচিত্র প্রাণীদের সংসারে সেই একমাত্র স্বাভাবিক মানুষ। যদিও শেষের দিকে এই স্বাভাবিক মানুষটার অস্বাভাবিক আচরণ বিরক্ত করে ছাড়ে।
এ বাড়ির বড় ছেলের নাম মবিন। মবিন এমএ পাশ বেকার। সকালের নাস্তা করে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, সারাদিন পথে পথে ঘুরে পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে সে বাড়ি ফেরে রাত এগারোটায়, বাবা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর। কারণ সে মনে করে বেকার ছেলেরা বাবার সামনে যত কম পড়ে ততই ভালো ।
বাড়ির ছোট ছেলে রঞ্জু (আজিজুল হাকিম)। সামনেই তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। রাত জেগে পড়াশোনা করতে করতে তার মাথায় কিঞ্চিত সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়। অবশ্য পরে জানা যায় সমস্যার কারণ অন্য। যে কারণে শেষের দিকে মনীষার আচরণে বৈচিত্র্য দেখা যায়।
এই নাটকের সবচেয়ে মজার চরিত্রটি হলো মনীষার দুলাভাই, এ বাড়ির বড় জামাই। ভদ্রলোক ঘুষ খান, দুই নম্বরী ব্যবসা করেন আর একটু কিছু হলেই দুটো বড় বড় লাগেজ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে এসে ওঠেন। যদিও তিনি নিজেকে সব সময় একজন খারাপ মানুষ বলে দাবি করেন কিন্তু দেখা যায় সামান্য কিছু উপলক্ষ পেলেই তিনি এমন সব কাজ করেন যা শুধু একজন হৃদয়বান ভালো মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব। এবং নাটকের শেষ দিকে এসে সব থেকে ভালো কাজের দায়িত্বটা তার উপর ই এসে বর্তায়। চরিত্রের এমন পরস্পরবিরোধী দ্বৈততা — এ কেবল হুমায়ূন আহমেদ এর সৃষ্টিতেই সম্ভব।
এ নাটকে এরকম আরো অনেক অনেক চরিত্র আছে যেগুলো নজর কাঁড়ে। তার মধ্যে পলিন, শেহেরজান দুটি অসম্ভব মিষ্টি চরিত্র।
পলিন চরিত্রে অভিনয় করেছে শীলা আহমেদ (হুমায়ূন আহমেদ এর মেয়ে)। তার সুন্দর হাসি, ছেলেমানুষি আর বিদেশি অ্যাক্সেন্ট সবই মিলিয়ে যেনো একটা মিষ্টির প্যাকেট। তার মায়াবী চেহারা, তার বাচন ভঙ্গি, আর তার অভিনয় পুরো নাটকটিকে আরও অসাধারণ করে তুলেছে। পলিনের সাথে সাথেই যে চরিত্রের নাম আসে তা হলো “ময়না’’। ময়না চরিত্রটিতে অভিনয় করেছে শাওন। নাটকের মাঝে মাঝে একটু পর পর শাওনের খালি গলার মিষ্টি গান নাটক শেষ হওয়ার পরও কানে বাজতে থাকে।
নাটকের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটির নাম “হাসান” যেটিতে অভিনয় করেছেন কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর। নাটকের শুরুতে তাকে ভীষণ বোকা আর গায়ে পড়া একটি চরিত্র মনে হলেও ধীরে ধীরে তার চারিদিকে রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে। পরিচালক এই নাটকে তার যাবতীয় দর্শনের কথাগুলো বলিয়েছেন হাসান এর মুখ দিয়ে।
নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র মনীষার অপরিসীম দুঃখবিলাস। আগেই বলেছি মনীষা স্নিগ্ধ, শান্ত, বুদ্ধিমতি মেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এম এস সি কমপ্লিট করেছে। চমৎকার রেজাল্ট। তার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। অথচ সেই সব কিছুকে উপেক্ষা করে সে পড়ে আছে এক সীমাহীন দুঃখের জগতে। তার দুঃখ একটাই সে জানতে পেরেছে যে, আসলে এতদিন জানতো বাড়ির ছোট ছেলে রঞ্জু আর মনীষা জমজ। তাদের দুজনেরই জন্ম হাসপাতালে হয়েছিল।
কিন্তু, পরে রঞ্জুর মাধ্যমে নিশ্চিত হয় হাসপাতালে একটাই সন্তান জন্ম হয় তার নাম রঞ্জু। এটা শুনে মনিষার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এতদিন সে যাদের আপন ভেবেছে তারা কেউ তার আপন না। সে মনে মনে তার আপন বাবা মায়ের সন্ধান করতে থাকে। কোনো এক সময় তার মায়ের সন্ধান পেয়েও যায় সে। কিন্তু তার মা সেই অতীত গুলো আর মনে করতে চায় না। মা অতীত মনে না করায় বাধ্য হয়ে তাকে সেই জায়গা ত্যাগ করতে হয়। সব কিছু ছাপিয়ে তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা বিপর্যয় তাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে সে তার জীবনের সুন্দর দিকগুলো রীতিমত অস্বীকার করছে। প্রথম দিকে তার এই দুঃখবোধ দেখে মায়া হয় তারপর আসে বিরক্তি এবং শেষে এসে তা রীতিমত রাগে রূপ নেয়।
অভিনয় শিল্পীবৃন্দ
সম্পাদনা- আবুল হায়াত – বাবা
- দিলারা জামান – মা
- আব্দুল কাদের – দুলাভাই
- লাকি ইনাম – রেহনুমা
- ডাঃ ইনামুল হক – খান সাহেব
- জাহিদ হাসান – মবিন
- শমী কায়সার – মনীষা
- কবির আহামেদ – শওকত
- আজিজুল হাকিম – রঞ্জু
- আফসানা মিমি – শেহেরজান
- আসাদুজ্জামান নূর – হাসান
- মেহের আফরোজ শাওন – ময়না
- শিলা আহমেদ – পলিন
- সারা জাকের – রুপা
- আলী জাকের – পলিনের বাবা
- নাজমা আনোয়ার – নাসিমা বেগম
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "ধারাবাহিকের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ"। দেশ রূপান্তর। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০২১।
- ↑ "জাদুকরী হুমায়ূন"। বাংলাদেশ প্রতিদিন। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০২১।