ধনতেরাস
ধনতেরাস[১] (হিন্দি: धनतेरस) বা ধনত্রয়োদশী (সংস্কৃত: धनत्रयोदशी) হলো বাংলাদেশ আর ভারতের অধিকাংশ স্থানে উদ্যাপিত দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন।
ধনতেরাস | |
---|---|
আনুষ্ঠানিক নাম | ধনতেরাস |
অন্য নাম | ধন ত্রয়োদশী |
পালনকারী | হিন্দু |
ধরন | দিওয়ালির অংশ |
তাৎপর্য | স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উদ্যাপন |
তারিখ | আশ্বিন ২৮ (অমান্ত ঐতিহ্য) কার্তিক ১৩ (পূর্ণিমান্ত ঐতিহ্য) |
সংঘটন | বার্ষিক |
সম্পর্কিত | দীপাবলি |
হিন্দু উৎসব তারিখ হিন্দু পঞ্জিকা চান্দ্র-সৌর-ভিত্তিক হলেও অধিকাংশ উৎসবের তারিখ পঞ্জিকার চান্দ্র অংশ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট করা হয়। প্রতি চান্দ্র দিবসকে তিনটি পঞ্জিকা উপাদান দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা হয়: মাস (চান্দ্রমাস), পক্ষ (চান্দ্র পক্ষ) ও তিথি (চান্দ্র দিবস)। অধিকন্তু, মাস নির্দিষ্ট করার সময় দুটি ঐতিহ্যের মধ্যে একটি প্রযোজ্য, যথা: অমান্ত / পূর্নিমান্ত। একটি উৎসব চাঁদের ক্ষয় সময়ে পড়ে। এই দুটি ঐতিহ্য একই চান্দ্র দিবসকে দুটি ভিন্ন (কিন্তু পরপর) মাসে আপতিত হিসাবে চিহ্নিত করে। একটি চান্দ্র বছর একটি সৌর বছরের তুলনায় প্রায় এগারো দিন ছোট। ফলস্বরূপ, বেশিরভাগ হিন্দু উৎসব গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ধারাবাহিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন দিবসে অনুষ্ঠিত হয়। | |
এ দিনটি হিন্দু পঞ্জিকা মাসের আশ্বিন (অমান্ত ঐতিহ্য অনুসারে) বা কার্তিক (পূর্ণিমান্ত ঐতিহ্য অনুসারে) কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে পালিত হয়। ধন্বন্তরী-কে ধনতেরাস উপলক্ষেও পূজা করা হয়। তাকে আয়ুর্বেদের দেবতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিনি মানবজাতির উন্নতির জন্য ও রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে আয়ুর্বেদের জ্ঞান প্রদান করেছিলেন।[২] ভারতীয় আয়ুর্বেদ, যোগ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা, ইউনানি, সিদ্ধ এবং হোমিওপ্যাথি মন্ত্রণালয় ধনতেরাসকে "জাতীয় আয়ুর্বেদ দিবস" হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে, যা ২৮ অক্টোবর ২০১৬ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল।[৩]
উদ্যাপন
সম্পাদনাধনতেরাস হল ধন্বন্তরীর পূজার দিন। হিন্দু ঐতিহ্য অনুসারে, ধন্বন্তরি সমুদ্র মন্থনের সময় আবির্ভূত হন। তিনি এক হাতে অমৃত পাত্র ও অন্য হাতে আয়ুর্বেদ সম্পর্কিত পবিত্র বই ধারণ করেন। তাকে দেবগণের বৈদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। [৪]
উৎসবটি লক্ষ্মী পূজা হিসাবে পালিত হয়। এ দিন সন্ধ্যায় মাটির দিয়া ( প্রদীপ ) জ্বালানো হয়। ভজন বা ভক্তিমূলক গান দেবী লক্ষ্মীর প্রশংসায় গাওয়া হয় ও দেবীকে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি নিবেদন করা হয়। মহারাষ্ট্রে একটি অদ্ভুত প্রথা বিদ্যমান যেখানে লোকেরা গুড়ের সাথে শুকনো ধনে বীজ অল্প আধা কেজির মিশ্রণ তৈরি করে উপচার হিসাবে দেওয়া হয়।
ধনতেরাসে যে গৃহগুলি এখনো পর্যন্ত দীপাবলির প্রস্তুতির জন্য পরিষ্কার করা হয়নি সেগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিষ্কার করা হয় এবং চুনকাম করা হয়। সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য ও আয়ুর্বেদের দেবতা ধন্বন্তরির পূজা করা হয়। মূল প্রবেশদ্বারটি রঙিন লণ্ঠন, ছুটির দিন আলোক দ্বারা সজ্জিত করা হয়। এবং রঙ্গোলি ডিজাইনের ঐতিহ্যবাহী মোটিফগুলি সম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীকে স্বাগত জানাতে তৈরি করা হয়। চালের আটা ও সিঁদুরের গুঁড়া দিয়ে ছোট ছোট পায়ের ছাপ সারা গৃহে আঁকা হয় যাতে দেবী লক্ষ্মীর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আগমন বোঝা যায়। ধনতেরাসের রাতে, লক্ষ্মী ও ধন্বন্তরীর সম্মানে দিয়া (প্রদীপ) সারা রাত জ্বালিয়ে রাখা হয়। [৫]
হিন্দুরা এ দিনটিকে নতুন কেনাকাটা( বিশেষ করে সোনা বা রূপার জিনিসপত্র ও নতুন পাত্র) করার জন্য অত্যন্ত শুভ দিন বলে মনে করে। বিশ্বাস করা হয়, নতুন "ধন" (সম্পদ) বা মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি জিনিস সৌভাগ্যের লক্ষণসূচক। আধুনিক সময়ে, ধনতেরাস স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য ধাতু বিশেষত রান্নাঘরের জিনিসপত্র ক্রয়ের জন্য সবচেয়ে শুভ উপলক্ষ হিসাবে পরিচিত হয়েছে। এ দিন যন্ত্রপাতি ও অটোমোবাইলেন মতো ভারী কেনাকাটাও করতে দেখা যায়।
এই রাতে, আকাশপ্রদীপগুলির আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় ও তুলসী বৃক্ষতলে অর্ঘ্য হিসাবে গৃহদ্বারের সামনে দিয়া(প্রদীপ) স্থাপন করা হয়। এই প্রদীপ দীপাবলি উৎসবের সময় অকাল মৃত্যু এড়াতে মৃত্যুর দেবতা যমের কাছে একটি অর্ঘ্যস্বরূপ। এই দিনটি সম্পদ ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদযাপিত হয়। ধনতেরাস শুদ্ধকরণ, নবায়ন ও লক্ষ্মীর দ্বারা মঙ্গলপ্রতীকস্বরূপ সুরক্ষার উৎস হিসেবে কল্পিত হয়। [৬]
গ্রামাঞ্চলে গবাদি পশুকে কৃষকরা তাদের আয়ের প্রধান উৎস হিসাবে সম্মানিত ও পূজা করে।
ভারতের অভ্যন্তরে
সম্পাদনাদক্ষিণ ভারতে (বিশেষত তামিলনাড়ু), ব্রাহ্মণ নারীরা মারুন্ডু তৈরি করে নরক চতুর্দশীর প্রাক্কালে ধনত্রয়োদশীতে 'ওষুধ' হিসাবে ব্যবহার করে। মারুন্ডু প্রার্থনার সময় দেওয়া হয় এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে নরক চতুর্দশীতে খাওয়া হয়। বহু পরিবার তাদের মেয়ে ও জামাইদের হাতে ওষুধের প্রণালী তুলে দেয়। শরীরে ত্রিদোষের ভারসাম্যহীনতা দূর করতে মেরুন্ডু খাওয়া হয়।
সাধারণত, গুজরাটি পরিবারগুলি নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য ডাল বাথ ও মালপুয়া খাদ্য উপভোগ করে। [৭]
গুরুত্ব
সম্পাদনাধনত্রয়োদশীর দিনে সমুদ্র মন্থনের সময় দেবী লক্ষ্মী দুধসায়র থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয় । তাই ত্রয়োদশীতে দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
কিংবদন্তি
সম্পাদনাএক কিংবদন্তিতে, রাজা হিমের ষোল বছর বয়সী পুত্রের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। তার রাশিফল তার বিয়ের চতুর্থ দিনে সাপের কামড়ে তার মৃত্যুর পূর্বাভাস দিয়েছিল। সেই বিশেষ দিনে তার নববধূ তাকে ঘুমাতে দেয়নি। তিনি তার সমস্ত অলঙ্কার ও বহু সোনা ও রৌপ্য মুদ্রা শয়নকক্ষের প্রবেশদ্বারে একটি স্তূপে রেখেছিলেন ও অনেকগুলি প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। তারপর তিনি তার স্বামীকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য গল্প শোনাতে লাগলেন ও গান গাইলেন; পরের দিন, মৃত্যুর দেবতা যম যখন সর্পের ছদ্মবেশে রাজকুমারের দোরগোড়ায় উপস্থিত হলেন, তখন প্রদীপ ও অলঙ্কারের তেজে তাঁর চোখ ঝলসে তিনি অন্ধ হয়ে গেলেন। যম রাজকুমারের কক্ষে প্রবেশ করতে পারেননি, তাই তিনি স্বর্ণমুদ্রার স্তুপের উপরে উঠে সেখানে বসে গল্প ও গান শুনতে লাগলেন। সকালে তিনি নিঃশব্দে চলে গেলেন। এইভাবে, যুবরাজ তার নববধূর বুদ্ধির নৈপুণ্যে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পান এবং দিনটি ধনতেরাস হিসাবে উদযাপন করা হয়েছিল। [৮]
বাড়ির মহিলারা যমকে মহিমান্বিত করে রাতভর মাটির প্রদীপ জ্বালাতেন বলে এই প্রথাটি যমদীপদান নামে পরিচিত হয়। যেহেতু এদিন দীপাবলির পূর্বের রাত, তাই এ দিনটিকে উত্তর ভারতে 'ছোটি দিওয়ালিও' বলা হয়।
জৈন ধর্মে, এই দিনটি ধনতেরাসের পরিবর্তে ধন্যতেরাস হিসাবে পালিত হয় যার অর্থ "তেরো তারিখের শুভ দিন"। কথিত আছে, এদিন মহাবীর পার্থিব জগতের সমস্ত কিছু ত্যাগ করে মোক্ষের পূর্বে ধ্যানরত অবস্থায় ছিলেন যা এই দিনটিকে শুভ বা ধন্য করে তুলেছে।
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "এবারের ধনতেরাস ঘুরে দাঁড়ানোর, এবারের ধনতেরাস পাশে দাঁড়ানোর"। Nagarik News। ১৩ নভেম্বর ২০২০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Hope-Murray, Angela (২০১৩)। Ayurveda For Dummies। John Wiley & Sons। পৃষ্ঠা 10। আইএসবিএন 9781118306703।
- ↑ "Dhanteras to be observed as National Ayurveda Day"। Times of India। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১৩ অক্টোবর ২০১৮।
- ↑ Dash, Mousumi (২০১৯-১০-২৫)। "Why is Lord Dhanvantari worshiped on Dhanteras?"। oneindia.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১২।
- ↑ Vera, Zak (ফেব্রুয়ারি ২০১০)। Invisible River: Sir Richard's Last Mission। AuthorHouse। আইএসবিএন 978-1-4389-0020-9। সংগ্রহের তারিখ ২৬ অক্টোবর ২০১১।
- ↑ Pintchman, Tracy (২০০৫)। Guests at God's Wedding: Celebrating Kartik among the Women of Benares। SUNY Press। পৃষ্ঠা 59। আইএসবিএন 9780791482568।
- ↑ "Ayurveda Day 2020: Narendra Modi To Inaugurate Two Ayurveda Institutions On November 13"। NDTV.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১২।
- ↑ Crump, William D. (২০১৬-০৩-৩০)। Encyclopedia of New Year's Holidays Worldwide (ইংরেজি ভাষায়)। McFarland। পৃষ্ঠা 112। আইএসবিএন 978-1-4766-0748-1।