দেবপাল

ধর্মপালের উত্তরসুরি ছিলেন (খৃস্টীয় ৯ম শতাব্দী)

দেবপাল (খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দী) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলের পাল সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা শক্তিধর সম্রাট। তিনি অধুনা ভারতের অসমওড়িশা রাজ্যের ভূখণ্ড জয় করে সাম্রাজ্যের সীমানা প্রসারিত করেছিলেন। পাল উৎকীর্ণ লিপিগুলিতে উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি আরও কিছু অঞ্চল জয় করেছিলেন। তবে সেই দাবিগুলি অতিরঞ্জিত।

দেবপাল
রাজা দেবপালের অধীনে পাল সাম্রাজ্যের মানচিত্র।[][]
কার্যকাল৮১০ - ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বসূরিধর্মপাল
উত্তরসূরিমহেন্দ্রপাল
দাম্পত্য সঙ্গীমহতা দেবী[]
রাজবংশপাল
পিতাধর্মপাল
ধর্মবৌদ্ধধর্ম

রাজত্বকাল

সম্পাদনা

দেবপাল ছিলেন পাল রাজবংশের তৃতীয় রাজা। তার পিতা তথা পূর্বসূরি ছিলেন ধর্মপাল[] তার মা ছিলেন রাষ্ট্রকূট রাজকুমারী রণ্ণাদেবী।[]:১৭৮ প্রথম যুগের ইতিহাসবিদগণ দেবপালকে ধর্মপালের ভ্রাতুষ্পুত্র মনে করতেন। কারণ নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রলিপিতে দেবপালকে জয়পালের ‘পূর্বজভ্রাতা’ (যে শব্দটিকে ‘জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল) বলা হয়েছে। একাধিক পাল উৎকীর্ণ লিপিতে জয়পালকে ধর্মপালের ভ্রাতা বাকপালের পুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও মুঙ্গের (মোঙ্ঘির) তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই মত পরিবর্তিত হয়। এই তাম্রলিপিতে স্পষ্টভাবে দেবপালকে ধর্মপালের পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[]

উৎকীর্ণ লিপি ও ঐতিহাসিক নথিগুলির ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ দেবপালের রাজত্বের ভিন্ন ভিন্ন সময়কাল নির্ধারণ করেছেন:[]:৩২–৩৭

ইতিহাসবিদ অনুমিত রাজত্বকাল
রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৯৭১) ৮১০-আনুমানিক ৮৫০
আব্দুল মোমিন চৌধুরী (১৯৬৭) ৮২১-৮৬১
বিন্ধ্যেশ্বরীপ্রসাদ সিনহা (১৯৭৭) ৮২০-৮৬০
দীনেশচন্দ্র সরকার (১৯৭৫-৭৬) ৮১২-৮৫০
দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৯৪) ৮০৬-৮৪৫

পাল সাম্রাজ্যের প্রসার

সম্পাদনা

দেবপালের সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন তার সেনাধ্যক্ষ জয়পাল। জয়পাল ছিলেন ধর্মপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাকপালের পুত্র।[] জয়পাল প্রাগজ্যোতিষ (অধুনা অসম রাজ্য, ভারত) আক্রমণ করলে সেখানকার রাজা বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন। জয়পাল উৎকল (অধুনা ওড়িশা রাজ্য, ভারত) আক্রমণ করলে সেখানকার রাজা রাজধানী পরিত্যাগ করে পলায়ন করেন।[]

দেবপালের উত্তরসূরি নারায়ণপাল কর্তৃক উৎকীর্ণ অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত[১০] বাদল স্তম্ভলিপি অনুসারে, দেবপালের সাম্রাজ্য বিন্ধ্য, হিমালয় এবং দুই মহাসাগর (আরব সাগরবঙ্গোপসাগর বলে অনুমিত) পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এই স্তম্ভলিপি আরও দাবি করে যে, দেবপাল উৎকল (অধুনা ওড়িশা) ধ্বংস করেছিলেন, প্রাগজ্যোতিষ (অধুনা অসম) জয় করেছিলেন, হুনদের দর্পচূর্ণ করেছিলেন, গুর্জর ও দ্রাবিড় রাজাদের পদানত করেছিলেন।[১১][১২] এই দাবিগুলি অতিরঞ্জিত হলেও সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয় নয়। রাষ্ট্রকূট ও গুর্জর-প্রতিহারদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলি সেই সময় দুর্বল ছিল। দেবপাল সম্ভবত সেই রাজ্যগুলি জয় করেছিলেন।[][১৩]:২০

উক্ত স্তম্ভলিপিতে উল্লিখিত ‘গুর্জর’ শব্দটির দ্বারা মিহির ভোজের নেতৃত্বাধীন গুর্জর-প্রতিহারদের বোঝানো হয়েছে। হুন বলতে সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটি ক্ষুদ্র নৃপতি-শাসিত রাজ্যকে বোঝানো হয়েছে।[১৪] সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ‘দ্রাবিড়’ বলতে অমোঘবর্ষের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যকে বোঝানো হয়েছে। তবে রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন যে, এই শব্দটির দ্বারা পাণ্ড্য রাজা শ্রীমার শ্রীবল্লভকে বোঝানো হয়েছে। যদিও দেবপাল দক্ষিণ ভারতে অতদূর রাজ্যবিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন বলে কোনও নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদি তিনি দাক্ষিণাত্যে রাজ্যবিস্তার করেও থাকতেন, তবে সেই রাজ্যবিস্তার ছিল সাময়িক। তার সামরিক কৃতিত্ব মূলত উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল।[১৫]

কম্বোজ নামে পরিচিত প্রাচীন দেশটি অধুনা আফগানিস্তান রাষ্ট্রে অবস্থিত ছিল। দেবপালের সাম্রাজ্য ততদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল বলেও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না।[] এই স্তম্ভলিপিতে কম্বোজ বলতে উত্তর ভারতে প্রবেশকারী কম্বোজ উপজাতিকে বোঝাতে পারে (কম্বোজ পাল রাজবংশ দেখুন)। মুঙ্গের তাম্রলিপি (‘মোঙ্গির সনদ’) থেকে অনুমিত হয় যে, পাল রাজারা কম্বোজদের থেকে যুদ্ধ-অশ্ব আমদানি করতেন। পাল সেনাবাহিনীতে কম্বোজদের একটি অশ্বারোহী বাহিনীও সম্ভবত ছিল।[১৬] দেবপাল বীরদেব নামে এক পণ্ডিতকে নালন্দার মঠাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেছিলেন। মনে করা হয় বীরদেব ছিলেন নগরহরের (অধুনা জালালাবাদ বলে চিহ্নিত) বাসিন্দা।[১৫] এর থেকে কোনও কোনও গবেষক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, দেবপাল অধুনা আফগানিস্তান ভূখণ্ডে সত্যসত্যই সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছিলেন এবং সেই সময়েই বীরদেবের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়।[১৭]

ধর্মবিশ্বাস

সম্পাদনা

দেবপাল ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কথিত আছে, তিনি মগধে অনেক মন্দির ও মঠ নির্মাণ করেছিলেন।[১৮] তিনি বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ ওদন্তপুরীর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বুতোন রিনচেন দ্রুব লিখেছেন যে, এই মঠটি দেবপালের পিতা ধর্মপাল নির্মাণ করেছিলেন। যদিও তারানাথ প্রমুখ পণ্ডিতদের দ্বারা রচিত তিব্বতি বিবরণ অনুসারে, এই মঠটি অলৌকিক উপায়ে নির্মিত হয়েছিল এবং তা দেবপালের প্রতি সমর্পিত হয়েছিল।[]:৪৫

যবদ্বীপের শৈলেন্দ্র রাজা বালপুত্রদেব দেবপালের কাছে একজন দূত প্রেরণ করে নালন্দায় একটি মঠ নির্মাণের জন্য পাঁচটি গ্রাম অনুদান হিসেবে চেয়েছিলেন। দেবপাল তার অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।[১৫] তিনি বিক্রমশিলানালন্দা মহাবিহারেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

বৌদ্ধ কবি বজ্রদত্ত (লোকেশ্বরশতক গ্রন্থের রচয়িতা) ছিলেন দেবপালের সভাসদ।[১৫]

উত্তরসূরি

সম্পাদনা

দেবপাল প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। প্রথম দিকে ইতিহাসবিদগণ মনে করতেন যে, তার উত্তরসূরি ছিলেন প্রথম শূরপাল ও/অথবা প্রথম বিগ্রহপাল[]:৩২–৩৭ ২০০০-এর দশকে জগজীবনপুরে একটি তাম্রলিপি দানপত্র আবিষ্কৃত হয়। এই লিপি অনুসারে, ৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মহেন্দ্রপাল নামে ইতিপূর্বে-অজ্ঞাত এক পাল রাজা এটি স্থাপন করেছিলেন।[১৯] মহেন্দ্রপাল ছিলেন দেবপালের পুত্র এবং প্রথম শূরপালের ভ্রাতা। মহেন্দ্রপাল ও প্রথম শূরপাল উভয়েই রানি মহতার পুত্র ছিলেন।[২০]

পূর্বসূরী
ধর্মপাল
পাল সম্রাট
খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দী
উত্তরসূরী
মহেন্দ্রপাল

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Chakrabarti, Dilip K. (১৯৯২)। Ancient Bangladesh, a study of the archaeologcial sources। Internet Archive। Delhi ; New York : Oxford University Press। পৃষ্ঠা 74। আইএসবিএন 978-0-19-562879-1 
  2. Rahman, Shah Sufi Mostafizur (২০০০)। Archaeological Investigation in Bogra District: From Early Historic to Early Mediaeval Period (ইংরেজি ভাষায়)। International Centre for Study of Bengal Art। পৃষ্ঠা 50–51। আইএসবিএন 978-984-8140-01-7 
  3. "দৈনিক জনকন্ঠ || নিবন্ধ ॥ রাজরানী"দৈনিক জনকন্ঠ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২১ 
  4. History and Culture of Indian People, The Age of Imperial Kanauj, 1964, p. 50, Dr R. C. Majumdar, Dr A. D. Pusalkar
  5. George E. Somers (১৯৭৭)। Dynastic History Of Magadha। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 185। আইএসবিএন 978-81-7017-059-4 
  6. Dilip Kumar Ganguly (১ জানুয়ারি ১৯৯৪)। Ancient India, History and Archaeology। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 27–28। আইএসবিএন 978-81-7017-304-5 
  7. Susan L. Huntington (১ জানুয়ারি ১৯৮৪)। The "Påala-Sena" Schools of Sculpture। Brill Archive। আইএসবিএন 90-04-06856-2 
  8. Badal Pillar Inscription, verse 13, Epigraphia Indica II, p 160; Bhagalpur Charter of Narayanapala, year 17, verse 6, The Indian Antiquary, XV p 304.
  9. Bhagalpur Charter of Narayanapala, year 17, verse 6, Indian Antiquary, XV p 304.
  10. Nitish K. Sengupta (১ জানুয়ারি ২০১১)। Land of Two Rivers: A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib। Penguin Books India। পৃষ্ঠা 43–45। আইএসবিএন 978-0-14-341678-4 
  11. History and Culture of Indian People, The Age of Imperial Kanauj, 1964, p. 50, 55, 56, Dr R. C. Majumdar, Dr A. D. Pusalkar.
  12. Badal Pillar Inscription, verse 5, Epigraphia Indica, II p 160.
  13. Sen, S.N., 2013, A Textbook of Medieval Indian History, Delhi: Primus Books, আইএসবিএন ৯৭৮৯৩৮০৬০৭৩৪৪
  14. Ronald M. Davidson (১ জানুয়ারি ২০০৪)। Indian Esoteric Buddhism: Social History of the Tantric Movement। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 53–55। আইএসবিএন 978-81-208-1991-7 
  15. Sailendra Nath Sen (১ জানুয়ারি ১৯৯৯)। Ancient Indian History and Civilization। New Age International। পৃষ্ঠা 280–। আইএসবিএন 978-81-224-1198-0 
  16. Dynastic History of Northern India, I. p 311; Indian Historical Quarterly, XV, p 511; History of Ancient Bengal, 1971, pp 127, 182-83 : "The Palas employed mercenary forces and certainly recruited horses from Kamboja (Ins B.8 V 13).
  17. Military History of India, 1980, p 88, H. C. Kar.
  18. Ancient India, 2003, Dr V. D. Mahajan.
  19. Bengal museum to reconstruct excavated Buddhist site
  20. Dimensions of Human Cultures in Central India: Professor S.K. Tiwari Felicitation Volume। Sarup & Sons। ২০০১। পৃষ্ঠা 239। আইএসবিএন 978-81-7625-186-0