তড়িৎ দ্বিমেরু ভ্রামক

তড়িৎ দ্বিমেরু ভ্রামক হচ্ছে কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক আধানের মধ্যে বিভাজনের একটি পরিমাপ, অর্থাৎ প্রক্রিয়াটির সামগ্রিক ধ্রুবীয়তার একটি পরিমাপ। তড়িৎ দ্বিমেরু ভ্রামকের এসআই একক হচ্ছে কুলম্ব-মিটার (C⋅m)। পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে প্রচলিত এর অপর একক হচ্ছে ডিবাই (D)।

একটি বিন্দু দ্বিমেরুর জন্য তড়িৎ ক্ষেত্র (উপরে বাঁদিকে), বৈদ্যুতিক আধানবিশিষ্ট একটি ভৌত দ্বিমেরু (উপরে ডানদিকে), একটি পাতলা মেরুকৃত চাকতি (নিচে বাঁদিকে) কিংবা একটি পাত ধারক (নিচে ডানদিকে)। এগুলো সবই একইরকম তড়িৎ ক্ষেত্র প্রস্তুত করে যখন সরঞ্জামটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

তাত্ত্বিকভাবে তড়িৎ দ্বিমেরু হচ্ছে বহুমেরু প্রসারণের প্রথম ক্রমের মান; এটি দুই সমান ও বিপরীত আধান দ্বারা গঠিত যারা শূন্যসন্নিকর্ষীভাবে কাছাকাছি, যদিও বাস্তব দ্বিমেরুর ক্ষেত্রে আধান পৃথকীকৃত।[ক]

প্রাথমিক সংজ্ঞা সম্পাদনা

 
দুই বিন্দু আধানের মধ্যে তড়িৎ দ্বিমেরু ভ্রামক সম্পর্কিত বিভিন্ন রাশি।
তড়িৎ দ্বিমেরু কাছাকাছি অবস্থিত বিপরীতধর্মী দুই বিন্দু বৈদ্যুতিক আধান নিয়ে গঠিত। এই অ্যানিমেশনে বিন্দু আকৃতির দ্বিমেরু থেকে নির্দিষ্ট আকারের দ্বিমেরুতে রূপান্তর দেখানো হয়েছে।
পানি বা জলের অণু (H2O) ধ্রুবীয়, কারণ এর ইলেকট্রনগুলো "বক্র" আকারে অসমানভাবে বণ্টিত। এখানে আধানের বিভাজন স্পষ্ট, যেখানে ঋণাত্মক আধান মাঝখানে (লাল) এবং ধনাত্মক আধান প্রান্তদেশে (নীল)।

পদার্থবিজ্ঞানে অনেকসময় কোনো বৃহৎ বস্তুর মাত্রাদের ধরা হয় না এবং তাকে এক বিন্দু কণা হিসাবে ধরা হয়। বৈদ্যুতিক আধানবিশিষ্ট বিন্দু কণাকে বিন্দু আধান বলা হয়। দুই বিন্দু আধান, একটির আধান +q এবং অপরটির আধান q, পরস্পর d দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত হলে একটি "তড়িৎ দ্বিমেরু" গঠিত হয় (তড়িৎ বহুমেরুর একটি সরল রূপ)। এক্ষেত্রে তড়িৎ দ্বিমেরু ভ্রামকের মান হচ্ছে

 
এবং এটি ঋণাত্মক আধান থেকে ধনাত্মক আধানের অভিমুখী। কিছু বক্তা d দূরত্বকে দুই ভাগে ভাগ করেন এবং s = d/২ ব্যবহার করেন, যেহেতু এই রাশিটি যেকোনো একটি আধান এবং দ্বিমেরুর কেন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব, যার ফলে সংজ্ঞায় ২-এর গুণনীয়ক যুক্ত হচ্ছে।

আরও কড়া গাণিতিক সংজ্ঞা হচ্ছে সদিক রাশির বীজগণিত ব্যবহার করা, যেহেতু মান ও অভিমুখ বর্তমান এমন কোনো রাশিকে, যেমন দুই বিন্দু আধানের মধ্যে দ্বিমেরু ভ্রামককে,

 
এই সদিক আকারে প্রকাশ করা যায়, যেখানে d হচ্ছে ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক রাশি অভিমুখী সরণ সম্পন্ন সদিক রাশি এবং p হচ্ছে ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক রাশি অভিমুখী তড়িৎ দ্বিমেরু ভ্রামক সদিক রাশি। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী দ্বিমেরুর নিজেকে বহিঃস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রের দিকে সারিবদ্ধ করার প্রবণতা থাকে। লক্ষণীয় যে এই চিহ্নরীতি পদার্থবিজ্ঞানে ব্যবহৃত, অন্যদিকে ধনাত্মক আধান থেকে ঋণাত্মক আধানের অভিমুখে দ্বিমেরুর বিপরীত চিহ্নরীতি রসায়নে ব্যবহৃত।[১]

শক্তি ও টর্ক সম্পাদনা

 
E সুষম তড়িৎ ক্ষেত্রে তড়িৎ দ্বিমেরু p এবং তার টর্ক τ

p দ্বিমেরু ভ্রামকবিশিষ্ট কোনো বস্তুকে কোনো বহিঃস্থ তড়িৎ ক্ষেত্র E-তে স্থাপন করা হলে সেটি একটি টর্ক τ অনুভব করবে। এই টর্কের প্রবণতা থাকে তড়িৎ ক্ষেত্রের সঙ্গে দ্বিমেরুকে সারিবদ্ধ করার। তড়িৎ ক্ষেত্রের সঙ্গে সমান্তরাল কোনো দ্বিমেরুর স্থিতি শক্তি তড়িৎ ক্ষেত্রের সঙ্গে কোণ করা দ্বিমেরুর থেকে কম। দ্বিমেরু দ্বারা অধিকৃত ছোট অঞ্চল জুড়ে আঞ্চলিকভাবে সুষম তড়িৎ ক্ষেত্রের শক্তি U ও টর্ক  -কে নিম্নলিখিত আকারে প্রকাশ করা যায়:[২]

 

অদিক ডট গুণন () এবং ঋণাত্মক চিহ্ন বোঝাচ্ছে যে দ্বিমেরুটি তড়িৎ ক্ষেত্রের সঙ্গে একই অভিমুখে সমান্তরাল হলে স্থিতি শক্তি সর্বনিম্ন হবে, বিপরীত অভিমুখে সমান্তরাল হলে স্থিতি শক্তি সর্বোচ্চ হবে এবং লম্ব হলে স্থিতি শক্তি শূন্য হবে।

অণুর দ্বিমেরু ভ্রামক সম্পাদনা

বহিঃস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রের উপস্থিতিতে কোনো পদার্থের আচরণের জন্য অণুর দ্বিমেরু ভ্রামক দায়ী। এই দ্বিমেরুদের বহিঃস্থ তড়িৎ ক্ষেত্রের দিকে বিন্যস্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে, যা ধ্রুবক বা সময়ের উপর নির্ভরশীল হতে পারে। এই প্রভাব এক আধুনিক পরীক্ষামূলক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করে, যা অস্তরক বর্ণালীবীক্ষণ নামে পরিচিত।

পানি বা জলের মতো পরিচিত অণুতে দ্বিমেরু ভ্রামক পাওয়া যায়। এছাড়া প্রোটিনের মতো বায়োমলিকিউলেও দ্বিমেরু ভ্রামক পাওয়া যায়।[৩]

কোনো পদার্থের মোট দ্বিমেরু ভ্রামক থেকে অস্তরক ধ্রুবক গণনা করা যায়, যা পরিবাহিতার মতো আরও স্বজ্ঞাত ধারণার সঙ্গে জড়িত। যদি   কোনো নমুনার মোট দ্বিমেরু ভ্রামক হয়, তাহলে অস্তরক ধ্রুবক হচ্ছে:

 
যেখানে k একটি ধ্রুবক এবং   হচ্ছে মোট দ্বিমেরু ভ্রামকের টাইম কোরিলেশন ফাংশন। সাধারণভাবে বলতে গেলে, মোট দ্বিমেরু ভ্রামকে নমুনাটির অণুর স্থানান্তর ও ঘূর্ণনের অবদান বর্তমান। তাহলে,
 

সুতরাং, অস্তরক ধ্রুবকে (এবং পরিবাহিতায়) স্থানান্তর ও ঘূর্ণনের অবদান বর্তমান। এই পদ্ধতিকে আরও সাধারণীকরণ করে কম্পাঙ্কের উপর নির্ভরশীল অস্তরক ফাংশনের গণনা করা সম্ভব।[৪]

ইলেকট্রনীয় গঠন তত্ত্ব থেকে হয় অবিরাম তড়িৎ ক্ষেত্রের প্রতিক্রিয়া হিসাবে কিংবা ঘনত্ব ম্যাট্রিক্স থেকে দ্বিমেরু ভ্রামক নির্ণয় করা যায়।[৫] নিউক্লিয় কোয়ান্টাম প্রভাবের সম্ভাব্য উপস্থিতির জন্য এইধরনের মান কিন্তু পরীক্ষার সাথে তুলনীয় নয়, যা এমনকি অ্যামোনিয়া অণুর (NH3) মতো সরল ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট।[৬]

টীকা সম্পাদনা

  1. অনেক তাত্ত্বিকদের ধারণা যে মৌলিক কণাদের অনেক সামান্য তড়িৎ দ্বিমেরু ভ্রামক থাকতে পারে, সম্ভবত পৃথকীকৃত আধান ব্যতীত। এধরনের বড় দ্বিমেরুর উপস্থিতি দৈনন্দিন পদার্থবিজ্ঞানে কোনো পার্থক্য আনতে পারে না, এবং এদের পর্যবেক্ষণ করা যায়নি। তবে আধানের মধ্যে দূরত্বের থেকে বেশি দূরত্বের পরিমাপ করার সময় দ্বিমেরু বাস্তব তড়িৎ ক্ষেত্রের এক ভাল অনুমান দেয়। দ্বিমেরুকে ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক আধান অভিমুখী সদিক রাশি হিসাবে প্রকাশ করা হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Peter W. Atkins; Loretta Jones (২০১৬)। Chemical principles: the quest for insight (7th সংস্করণ)। Macmillan Learning। আইএসবিএন 978-1464183959 
  2. Raymond A. Serway; John W. Jewett Jr. (২০০৯)। Physics for Scientists and Engineers, Volume 2 (8th সংস্করণ)। Cengage Learning। পৃষ্ঠা 756–757। আইএসবিএন 978-1439048399 
  3. Ojeda, P.; Garcia, M. (২০১০)। "Electric Field-Driven Disruption of a Native beta-Sheet Protein Conformation and Generation of a Helix-Structure"Biophysical Journal99 (2): 595–599। ডিওআই:10.1016/j.bpj.2010.04.040পিএমআইডি 20643079পিএমসি 2905109 বিবকোড:2010BpJ....99..595O 
  4. Y. Shim; H. Kim (২০০৮)। "Dielectric Relaxation, Ion Conductivity, Solvent Rotation, and Solvation Dynamics in a Room-Temperature Ionic Liquid"। J. Phys. Chem. B112 (35): 11028–11038। ডিওআই:10.1021/jp802595rপিএমআইডি 18693693 
  5. Frank., Jensen (২০০৭)। Introduction to computational chemistry (2nd সংস্করণ)। Chichester, England: John Wiley & Sons। আইএসবিএন 9780470011874ওসিএলসি 70707839 
  6. Puzzarini, Cristina (২০০৮-০৯-০১)। "Ab initio characterization of XH3 (X = N,P). Part II. Electric, magnetic and spectroscopic properties of ammonia and phosphine"। Theoretical Chemistry Accounts (ইংরেজি ভাষায়)। 121 (1–2): 1–10। আইএসএসএন 1432-881Xএসটুসিআইডি 98782005ডিওআই:10.1007/s00214-008-0409-8 

আরও পড়ুন সম্পাদনা

  • Melvin Schwartz (১৯৮৭)। "Electrical DIPOLE MOMENT"Principles of Electrodynamics (reprint of 1972 সংস্করণ)। Courier Dover Publications। পৃষ্ঠা 49ffআইএসবিএন 978-0-486-65493-5 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা