ডিপলোডোকাস হচ্ছে ডিপলোডোসিড সরোপড ডাইনোসর এর এক বিলুপ্ত প্রজাতি। ১৮৭৭ সালে স্যার স্যামুয়েল ওয়েনডেল উইলিস্টন সর্বপ্রথম এই প্রজাতির ফসিল আবিষ্কার করেন। ১৮৭৮ সালে অথনিয়েল চার্লস মার্শ এর প্রজাতিগত নামকরণ করেন। নামটি একটি নিও-লাতিন শব্দ যা দুটি গ্রিক শব্দ থেকে আগত,  διπλός(ডিপ্লোস) "দ্বৈত" এবং δοκός (ডোকোস) "রশ্মি"। নামটি এর লেজের নিম্নাংশে থাকা দ্বৈত-রশ্মি আকারযুক্ত শেভরন হাড়কে নির্দেশ করে। এই আকৃতির শেভরন হাড়কে ডিপলোডোকাসের অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে মনে করা হত, কিন্তু পরবর্তীতে এই হাড় ডিপলোডোসিড পরিবারের অন্যান্য সদস্যের পাশাপাশি ননডিপলোসিড সরোপডে, যেমন মেমেনশিয়াসরাস এ খুঁজে পাওয়া যায়। তাই এখন মনে করা হয় সেইসমোসরাস হ্যালোরাম , ডিপলোডোকাসেরই একটি প্রজাতি।

ডিপ্লোডোকাস
সময়গত পরিসীমা: অন্ত জুরাসিক ১৬–১৫কোটি
ডিপ্লোডোকাস
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: প্রাণী
পর্ব: কর্ডাটা
বর্গ: সরিস্কিয়া
পরিবার: ডিপলোডসিডে


এই প্রজাতির ডাইনোসরেরা জুরাসিক যুগ এর শেষের দিকে বর্তমান উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে বাস করত। মরিসন ফরমেশন এর মধ্যভাগ থেকে উপরের দিকে পাওয়া সুলভ কিছু ডাইনোসর ফসিলের মধ্যে এটি অন্যতম। ১৫২-১৫৪ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্রাক-কিমারিজিয়ান যুগের ফসিল এগুলো। মরিসন ফরমেশন এমন এক স্থান-কালের সাক্ষী যেখানে রাজত্ব করত অ্যাপাটোসরাস, ব্যারোসরাস, ব্রাকিওসরাস, ব্রন্টোসরাস, ক্যামারাসরাস এর মত দৈত্যাকার সরোপড ডাইনোসরেরা।

অতি সহজে চেনা যায় এমন এক প্রজাতির ডাইনোসর ডিপলোডোকাস, যার কারণ এর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সরোপড আকৃতি, লম্বা গলা ও লেজ এবং চারটি বলিষ্ঠ পা। অনেক বছর ধরে এটি আমাদের পরিচিত সবচেয়ে বড় ডাইনোসর ছিল। এর বিশালাকার একে শিকারি অ্যালোসরাস এবং সেরাটোসরাস এর কাছে অনাকর্ষনীয় করে তুলেছিল। এদের সকলের ফসিল একই স্তরে পাওয়া যাওয়ায় মনে করা হয় এরা একই স্থানে বসবাস করত।

বর্ণনা সম্পাদনা

 
ডিপলোডোকাস কার্নেগী (সবুজ) এবং ডিপলোডোকাস হ্যালোরাম (কমলা) এর সাথে মানুষের আকারের তুলনামূলক চিত্র।

সুপরিচিত সরোপডদের মধ্যে ডিপলোডোকাস ছিল বিশালবপু, লম্বা গলার অধিকারী, চতুষ্পদী প্রাণী যার লম্বা চাবুকের মত লেজ ছিল। এদের অগ্রপদ পশ্চাদপদের তুলনায় একটু খাটো ছিল, যার ফলে এরা সুদীর্ঘ অনুভূমিক দেহভঙ্গিমার অধিকারী। এদের কঙ্কাল কাঠামোকে ঝুলন্ত সেতুর সাথে তুলনা করা হয়। বর্তমানে ডিপলোডোকাস কার্নেগী দীর্ঘতম ডাইনোসরগুলোর মধ্যে অন্যতম যার দৈর্ঘ্য ২৫ মিটার (৮২ ফুট) এবং ওজন আনুমানিক ১০ থেকে ১৬ মেট্রিক-টন।

ডিপলোডোকাস হ্যালোরাম -এর দেহাবশেষ দেখে মনে করা হয় যে এটি সম্ভবত চারটি হাতির সমান ছিল। ১৯৯১ সালে যখন প্রথম এর বর্ণনা প্রকাশিত হয় তখন আবিষ্কারক ডেভিড গিলেত্তে হিসাব করে এর দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেন ৫২ মিটার (১৭১ ফুট), যা একে দীর্ঘতম ডাইনোসরের মর্যাদা দেয়। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী এর ওজন ১১৩ টনের অধিক ছিল। পরবর্তীতে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৩.৫ মিটার (১১০ ফুট) হিসাব করা হয়, কেননা জানা যায় যে গিলেত্তে দৈর্ঘ্য পরিমাপের সময় ১২-১৯ নং কশেরুকাকে ২০-২৭ নং কশেরুকা হিসেবে মেপেছেন। পিটসবার্গ, পেন্সিল্‌ভেনিয়াতে অবস্থিত Carnegie Museum of Natural History এর যে ডিপলোডোকাসের আকারের উপর ভিত্তি করে এদের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা হয়েছিল তার ১৩তম কশেরুকা অন্য একটি ডাইনোসরের।

 
ডিপলোডোকাসের লেজের কঙ্কাল

ডিপলোডোকাসের অত্যন্ত লম্বা লেজ ছিল, যা প্রায় ৮০ টি কশেরুকার সমন্বয়ে গঠিত। মনে করা হয় এই লেজ তারা আত্মরক্ষা বা কোন কিছু ভাঙ্গার কাজে ব্যবহার করত। হয়তো এই লেজ লম্বা গলার বিপরীতে ভারসাম্য রক্ষায় কাজে লাগত। লেজের মধ্যভাগে দ্বৈত-রশ্মি (অদ্ভুত আকারের শেভরন হাড়, যা এর নামকরনের কারণ) দেখা যায়। এগুলো হয়ত অন্যান্য কশেরুকাকে স্থিতাবস্থায় রাখত অথবা লেজের রক্তনালী রক্ষা করত।

অন্যান্য সরোপডের ন্যায় ডিপলোডোকাসের অগ্রপদও সুগঠিত। এদের আঙ্গুল ছিল, হাড়গুলো উলম্ব কলামে সজ্জিত। হাড়ের সন্ধিস্থলগুলো অশ্বখুড়াকৃতির। ডিপলোডোকাসের অগ্রপদের একটিমাত্র আঙ্গুলে নখর ছিল, যা অন্যান্য সরোপডদের তুলনায় বড় ছিল। এটি সমান ছিল এবং হাতের হাড় থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এই অস্বাভাবিক নখরের ব্যবহার এখনও জানা যায়নি।

 
ডিপলোডোকাস কার্নেগী এর বাস্তব রূপ চিত্রায়ন কাঁটা, লম্বা গলা এবং লেজসহ

এমন কোন খুলি এখনও পাওয়া যায়নি যা সুনিশ্চিতভাবে ডিপলোডোকাসের বলে দাবি করা যায়। যদিও অন্যান্য ডিপলোডোসিডসদের খুলি ডিপলোডকাসের খুলির সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ডিপলোডকাসের ছোট ছোট তীক্ষ্ণ দাঁত ছিল যা চোয়ালের সম্মুখভাগে সাজানো থাকতো। এদের করোটিকা সমগ্র দেহের তুলনায় ছোট ছিল। এদের ঘাড়ে ১৫ টি কশেরুকা থাকত এবং এদের মাথা ভূমির সমান্তরালে থাকায় এরা মাথা বেশি উঁচুতে তুলতে পারত না।

১৯৯০ সালে ডিপলোসিডের চামড়ার কিছু অংশ আবিষ্কার হওয়ায় দেখা যায় এদের কিছু কিছু প্রজাতির চামড়ায় সরু কেরাটিনময় কাঁটা ছিল, অনেকটা ইগুয়ানাদের ন্যায়। যা ১৮ সেন্টিমিটার (৭.১ ইঞ্চি) লম্বা হয়। কাঁটাগুলো লেজে এবং সম্ভবত পিঠে এবং ঘাড়েও ছিল। বর্তমানে ডাইনোসরের সম্পূর্ণ রুপ গঠনে এই কাঁটাগুলো এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। Walking with Dinosaurus[১] প্রামান্যচিত্রে এদের সম্পূর্ণরুপে উপস্থাপন করতে কাঁটাগুলো দেখানো হয়।

আবিষ্কার এবং প্রজাতিসমূহ সম্পাদনা

 
হ্যাচারের কঙ্কাল পুনস্থাপন

ডিপলোডকাসের বেশ কয়েকটি প্রজাতি ১৮৭৮ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে বর্ণিত হয়। প্রথম কঙ্কালটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮৭৭ সালে কলোরাডোক্যানন সিটিতে, আবিষ্কারকদ্বয় ছিলেন বেঞ্জামিন মাজ এবং স্যার স্যামুয়েল ওয়েনডেল উইলিস্টন। এর নাম রাখা হয়েছিল ডিপলোডোকাস লঙ্গাস । ডিপলোডোকাসের দেহাবশেষ ইউটা, মন্টানা এবং কলোরাডোএর মরিসন ফরমেশন এ পাওয়া যায়। প্রাণীদের ফসিল প্রায় একই রকম থাকে, খুলি বাদে। কখনও খুলিসহ সম্পূর্ণ কঙ্কাল পাওয়া যায়নি। ১৯২৪ সালে জানা যায় ১৯০২ সালে উইলিয়াম এইচ. আটারব্যাক ডিপলোডকাস হাই এর কঙ্কালতন্ত্রের অংশবিশেষ আবিষ্কার করেন খুলিসহ। ২০১৫ সালে এর গণ গ্যালিমোপাস এ পরিবর্তন করে এর পুনরায় নামকরণ করা হয়। এবং পরবর্তীতে বহু ডিপলোডোকাসকে এই গণভুক্তি করা হয়। যার ফলে ডিপলোডকাসের কোন নির্দিষ্ট খুলি নেই।

মরিসন ফরমেশনে পাওয়া সরোপডের দুইটি গণ ডিপলোডকাস এবং ব্যারোসরাস এর অঙ্গীয় কঙ্কালের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষণীয়। অতীতে অনেক হাড়কে ডিপলোডোকাসের অধিভুক্ত করা হয়, যা হয়ত ব্যারসরাসের হতে পারে। ডিপলোডোকাসের ফসিল মরিশন ফরমেশনের ৫ নং পাললিক স্তরে পাওয়া গিয়েছিল।

বৈধ প্রজাতিসমুহ সম্পাদনা

  • ডিপলোডোকাস কার্নেগী এর নাম রাখা হয়েছিল অ্যান্ড্রু কার্নেগী এর নামে। এটি অত্যন্ত সুপরিচিত ছিল এর প্রায় সম্পূর্ণ কঙ্কালের জন্য (নমুনা CM 84)। ফসিলটি আবিষ্কার করেছিলেন জ্যাকব ওর্টম্যান, নামকরণ এবং বর্ণনা প্রদান করেছিলেন জন বেল হ্যাচার, ১৯০১ সালে।
  • ডিপলোডোকাস হ্যালোরাম প্রথম বর্ণিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে, গিলেত্তে একে বর্ণনা করেছিলেন সেইসমোসরাস হ্যালাই হিসেবে। ১৯৭৯ সালে এর আংশিক কঙ্কাল পাওয়া যায়, যাতে ছিল কশেরুকা, শ্রোণিঅস্থিচক্র এবং বক্ষঅস্থিচক্র (নমুনা NMMNH P-3690)।