ডিএনএ আলেখন

কোন ব্যক্তির ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁকে শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যগুলির ক্ষুদ্র সেট তৈরিকরণ

ডিএনএ আলেখন (ইংরেজি: DNA profiling বা DNA fingerprinting) হল একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে কোষের মধ্যে অবস্থিত ডিএনএ বিশ্লেষণ করে কোন মানুষের একটি প্রতিকৃতি বা আলেখ্য তৈরি করা হয়, যে আলেখ্য তাকে ভবিষ্যতে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রতিটি মানুষের আঙুলের ছাপের যেমন স্বাতন্ত্র্য থাকে, তেমনি তার কোষস্থ ডিএনএ-র গঠন ভঙ্গিতেও স্বাতন্ত্র্যতা দেখা যায়। দুটি মানুষের মধ্যে যেমন আঙুলের ছাপের পার্থক্য লক্ষণীয় তেমনি ডিএনএ সজ্জার মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়। ডিএনএ এর এমন পার্থক্যের ভিত্তিতে দুটি মানুষকে আলাদা করা যায়। সহোদর যমজ ছাড়া প্রত্যেক মানুষেরই ডিএনএ সজ্জা আলাদ।[১] বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে জেনেছেন যে মানুষের ডিএনএ এর মধ্যে এমন কিছু নিউক্লিওটাইডের পুনরাবৃত্তি থাকে যা নির্দিষ্ট মাতা এবং পিতার সঙ্গে কেবলমাত্র তাদের সন্তানেরাই ভাগ করে নেয় । মানুষের ক্ষেত্রে শ্বেত-কণিকাতে বা শুক্ররসে, চুলের গোড়ায় অথবা অস্থিতে অবস্থিত কোষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে এই ডিএনএ আলেখন প্রস্তুত করা হয়। ডিএনএ আলেখনকে পূর্ণ জিনোম সজ্জাকরন এর সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।[২]

আবিষ্কার সম্পাদনা

 
৬ জন পৃথক ব্যক্তির VNTR অ্যালিলি দৈর্ঘ্যের পার্থক্য
 
ডিএনএ ফিংগার প্রিন্টিং এর জনক অ্যালেক জেফ্রিস

বহুদিন আগে থেকেই অপরাধীকে শনাক্ত করার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি বের করার যে চেষ্টা চলছিল, তাকে পূর্ণতা দেয় আঙুলের ছাপের মাধ্যমে শনাক্তের পদ্ধতি। কিন্তু ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ডের Leicester বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী অ্যালেক জেফ্রিস (Alec Jeffreys) ফরেনসিক গবেষণায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনলেন আলেখন আবিষ্কারের মাধ্যমে।[৩] ল্যাবটারিতে কাজ করার সময় তিনি একটি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের ডিএনএ এর এক্স-রে ফ্লিমের মধ্যে মিল খুঁজে পান, যা তার ডিএনএ আলেখন পদ্ধতি আবিষ্কারের মুল ভিত্তি।[৪] বর্তমানে এই পদ্ধতি National DNA database এ ব্যাপক ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। ১৯৮৭ সাল থেকে এই পদ্ধতি commercial ক্ষেত্রে বাবহ্রিত হয় যখন Imperial Chemical Industries (ICI) নামে একটি কোম্পানি রক্ত পরীক্ষাগার খোলেন।[৫]

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পাদনা

 
এক বিশেষজ্ঞ ডিএনএ প্রোফাইল এর ফ্লিম দেখছেন

মানুষের আঙুলের ছাপ দিয়ে যেমন আসল এবং নকল মানুষকে চেনা যায়, তেমনি ডিএনএ আলেখনের সাহায্যেও আসল এবং নকল মানুষকে শনাক্ত করা যায়। আসলে এই পদ্ধতিতে মানুষ চেনার বিষয়টি অনেক বেশি বিজ্ঞান সম্মত হওয়ায় অপরাধী নির্ণয়ের জন্য ফরেনসিক জীববিদ্যায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ এর ফলে এক নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে সঠিক অপরাধীকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ডিএনএ আলেখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইতি মধ্যে জৈব বিবর্তনের বিভিন্ন কাজে এটি সফল ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ডিএনএ আলেখন তৈরির পদ্ধতি সম্পাদনা

কোন মানুষের দেহ কোষ থেকে যৎসামান্য ডিএনএ সংগ্রহ করা গেলেও তার থেকে ওই মানুষের একটি ডিএনএ আলেখ্য তৈরি করা যায়। সুতরাং কোন কোষ থেকে ডিএনএ আহরণ করার পর তার সাহায্যেই কোন মানুষের ডিএনএ আলেখ্য তৈরি করা সম্ভব হয়। প্রাপ্ত ডিএনএ এর পরিমাণ কম হলে পিসিআর (PCR) পদ্ধতিতে ওই ডিএনএ এর পরিমাণ বাড়িয়ে নেওয়া যায়। কোন লোকের দেহ কোষ থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ এর থেকে কতিপয় পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি অনুসারে ওই ব্যক্তির ডিএনএ আলেখ্য তৈরি করা যায়।

ডিএনএ সংগ্রহ সম্পাদনা

ডিএনএ আলেখ্যের মুখ্য উপাদান ডিএনএ প্রধানত কোন অপরাধের স্থান (যেমন – খুনের স্থল, কোন জায়গায় পরে থাকা রক্ত ইত্যাদি), মানব দেহের রক্ত, চুল, শুক্ররস এছাড়াও একবার বা দুবার পরা জামা কাপড় থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা যেতে পারে। অনেকদিন ধরে মাটির তলায় থাকা মানুষের মৃতদেহের কঙ্কাল থেকেও ডিএনএ সংগ্রহ করা যেতে পারে। মানুষের ক্ষেত্রে শ্বেত-কণিকার বা শুক্ররসে, চুলের গোড়ায় অথবা অস্থিতে অবস্থিত কোষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে ডিএনএ আলেখন করা হয়। সংগৃহীত ডিএনএ কে প্রধানত টেস্ট টিউবে সংগ্রহ করা হয় এবং একে সংরক্ষিত রাখার জন্য ঠাণ্ডা বা কম উষ্ণতায় রাখা হয়।

ডিএনএ খন্ডীকরন সম্পাদনা

সংগৃহীত ডিএনএ, যাকে বলা হয় জিনোমের ডিএনএ, রেস্ট্রিকশন এন্ডনিউক্লিয়েজের সঙ্গে মেশানো হয়। এর ফলে সমস্ত ডিএনএ ছোট বড়ো টুকরোতে ভেঙে যায়। যদিও রেস্ট্রিকশন এন্ডনিউক্লিয়েজের ক্লিভেজ স্থানে পলিমরফিজম উপস্থিত থাকতে পারে, সাধারন ভাবে এই উৎসেচক এবং ডিএনএ খণ্ড ভিএনটিআর (VNTR) লোসাই গুলি চিনতে সহায়তা করে। যদিও সাউদার্ন ব্লট প্রক্রিয়াটি খুবই কষ্টসাধ্য এবং এর জন্য অনেক ডিএনএ খন্ড প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়ায় ডিএনএ টুকরো টুকরো হলেও তার মিনি স্যাটেলাইট পুনরাবৃত্ত অঞ্চল গুলি অবিকৃত থাকে। এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন ডিএনএ খণ্ডাংশ গুলি বিভিন্ন আকারের হয়, যেগুলির ভোঁতা বা ছুঁচলো প্রান্ত দেখা যায়। এই খণ্ড গুলিকে বলা হয় Restriction Fragments Length Polymorphisms বা RFLP ।

পিসিআর (PCR) এর ব্যবহার সম্পাদনা

ডিএনএ আলেখনের কাজে অনেক পরিমাণ ডিএনএ খন্ড প্রয়োজন হয়। তাই কম পরিমাণ নমুনা সংগৃহীত হলে polymerase chain reaction (PCR) পদ্ধতির মাধ্যমে ডিএনএ এর পরিমাণ দ্রুত হারে বাড়ানো যায়। এটি একটি কৃত্রিম ডিএনএ প্রতিলিপিকরন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে দ্বিতন্ত্রী ডিএনএ কে একতন্ত্রী ডিএনএ তন্ত্রীতে পৃথক করা হয়। একটি PCR মেশিন ২ ঘণ্টা বা তার কম সময়ে লক্ষাধিক কপি তৈরি করতে পারে।

ডিএনএ খণ্ডের পৃথকীকরণ সম্পাদনা

সাধারণত জেল ইলেক্ট্রোফোরেসিস পদ্ধতিতে RFLP বা ডিএনএ খণ্ড গুলিকে পৃথক করা হয়। অ্যাগরোজ দিয়ে তৈরি জেল ব্লকের একদিকে চিরুনি দিয়ে গর্ত করা জায়গায় (যাকে ওয়েল বলা হয়) টুকরো ডিএনএ-কে একটু একটু করে দিয়ে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত ডিএনএ খণ্ড গুলি বাফার দ্রবণে গুলে থাকে। এবার ইলেক্ট্রোফোরেসিসের সাহায্যে ওয়েলে রাখা ডিএনএ খণ্ড গুলিকে পৃথক করা হয়। ইলেক্ট্রোফোরেসিসের সময় অ্যাগরোজ জেলের ওয়েল প্রান্তের দিকে –ve ইলেক্ট্রোড এবং অপর প্রান্তের দিকে +ve ইলেক্ট্রোড যোগ করে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করা হয়। এর ফলে ডিএনএ খণ্ডগুলি ঋণাত্মক তড়িৎধর্মী বলে +ve ইলেক্ট্রোড এর দিকে যাত্রা করে। এই সময় অ্যাগারোজ ব্লকের ছোট ছোট ছিদ্রের মধ্য দিয়ে ওয়েল থেকে ডিএনএ +ve প্রান্তের দিকে যেতে পারে। অপর সিকে যে ডিএনএ খণ্ড গুলি আকারে বড়ো, তাদের যাত্রা অ্যাগারোজ ছিদ্রের মধ্যে বেশি প্রতিবন্ধকতা পায় বলে পিছিয়ে পড়ে । ফলে বড়ো থেকে ছোট খণ্ড গুলি সারিবদ্ধ ভাবে অ্যাগারোজের মধ্যে পৃথক হয়ে পড়ে। এছাড়াও ক্ষারকীয় অংশগুলি হাইড্রোজেন বন্ধন ভেঙে ডিএনএ কে একতন্ত্রী করতে সাহায্য করে। ডিএনএ গুলি একতন্ত্রী হওয়ার ফলে এটি নিউক্লিওটাইড গুলিকে মুক্ত করে যা পড়ে প্রোবের সাথে জোড় বাঁধতে সাহায্য করে।

সাদার্ন ব্লটিং পদ্ধতি সম্পাদনা

অ্যাগারোজ এর ব্লকের মধ্যে পৃথকীকৃত ডিএনএ খন্ডগুলিকে এমনিতে দেখা যায় না। এদের দেখার জন্য নিম্নলিখিত কৌশল গৃহীত হয়। অ্যাগারোজকে একটুকরো নাইলন এবং পাতলা পেপার টাওয়েল (Paper Towel) দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় যা জেল থেকে আর্দ্রতা দূরীকরণে সাহায্য করে এবং জেল থেকে ডিএনএ খণ্ডগুলি স্থানান্তরিত হয় নাইলনের উপরিভাগে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ব্লটিং। বিজ্ঞানী ই এম সাদার্ন (E. M. Southern) এর নাম অনুসারে একে সাদার্ন ব্লটিং বলা হয়। এইভাবে অ্যাগারোজের ডিএনএ তন্তুগুলিকে সাদার্ন ব্লটিং পদ্ধতিতে একটি নাইট্রোসেলুলোজ পর্দায় তুলে নেওয়া হয়।

প্রোবিং পদ্ধতি সম্পাদনা

নাইট্রোসেলুলোজ পর্দার সাথে বিশেষ তেজস্ক্রিয় প্রোব যোগ করা হয়। এর ফলে পৃথকীকৃত একতন্ত্রী ডিএনএ খন্ডকগুলির মিনি স্যাটেলাইট অঞ্চলে প্রোবগুলি আবদ্ধ হয়। তেজস্ক্রিয় মৌলের উপস্থিতির জন্য বিভিন্ন জায়গায় লেগে থাকা ডিএনএ খণ্ডকগুলির উপস্থিতি বোঝা সহজ হয়। এই তেজস্ক্রিয় প্রোবগুলি যুক্ত হয় নির্দিষ্ট সমগঠনিক ডিএনএ খন্ডকগুলির সাথে।

আলোকচিত্র পাতের উপর ডিএনএ আলেখ্য গঠন সম্পাদনা

নাইট্রোসেলুলোজ পর্দার ওপর একটি এক্স-রে ফ্লিম রাখলে ডিএনএ খণ্ডের অবস্থান অনুযায়ী এক্স-রে ফ্লিমের ওপর দাগ জেগে ওঠে। ফটোগ্রাফিক পদ্ধতিতে এক্স-রে ফ্লিম এর ওপর ডিএনএ খন্ডক অনুযায়ী কালো পটির মত দাগ দেখা যায়। অর্থাৎ বিভিন্ন জায়গায় জমা ডিএনএ খন্দকগুলির প্রতিচ্ছবি হল এক্স-রে ফ্লিমের ওপর দেখা দেওয়া কালো দাগ গুলি। এক্স-রে ফ্লিমের ওপর জেগে ওঠা কালো পটির মত দাগ গুলি ডিএনএ আলেখ্য বিশ্লেষণের কাজে লাগে।

ডিএনএ আলেখন প্রস্তুতির সময়কাল সম্পাদনা

যখন ডিএনএ আলেখন সদ্য আবিষ্কৃত পদ্ধতি ছিল (১৯৮৫-১৯৯০) তখন পরীক্ষাগারে এটি সম্পন্ন করতে ৪-৬ সপ্তাহের বেশি সময় লাগত, কিন্তু অ্যালেক জেফ্রিস ১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসে এক নতুন উন্নত প্রযুক্তির ডিএনএ আলেখন ফরেনসিক বিজ্ঞানের সামনে আনলেন যা ২ দিনেরও কম সময়ে খুব সুক্ষ ভাবে সম্পন্ন করা যায়।

ডিএনএ তথ্য ভান্ডার সম্পাদনা

ডিএনএ তথ্য ভাণ্ডার এর প্রথম প্রয়োগ ছিল কেল্ভিন W.P. মিলার এবং জন এল ডাসণ এর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ একত্রীকরণ (১৯৯৬ - ১৯৯৮)।[৬] এই তথ্য মিলার এর PhD থিসিস এর জন্য প্রয়োজন ছিল। সারা বিশ্ব জুড়ে এখন অনেক গুলি ডিএনএ তথ্য ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কিছু বাক্তিগত। কিন্তু বেশিরভাগ বড় তথ্য ভাণ্ডার গুলি সরকার পরিচালিত। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় ডিএনএ তথ্য ভাণ্ডার টি পরিচালনা করে। এতে প্রায় ৫ মিলিয়ন তথ্য সংরক্ষিত আছে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ।[৭] ইউনাইটেড কিংডম ও একটি একই রকম ডিএনএ তথ্য ভাণ্ডার পরিচালনা করেন যার নাম National DNA Database (NDNAD) ।

ডিএনএ আলেখনের উপযোগিতা সম্পাদনা

অপরাধী শনাক্তকরণে ডিএনএ আলেখ্য সম্পাদনা

ডিএনএ আলেখন সাধারনত প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে। কোন অপরাধমূলক কাজে যখন একাধিক সন্দেহভাজন লোক ধরা পড়ে, তখন প্রকৃত অপরাধীকেডিএনএ আলেখনের মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়। খুন ও ধর্ষণ দুটি চরম অপরাধমূলক কাজ। অপরাধ করার পর অপরাধী পালায় ও তাকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে দাঁড়ায়। তখন সন্দেহভাজন একাধিক লোককে ধরা হয় ও বিভিন্ন সূত্র ধরে প্রকৃত অপরাধীকে খোঁজার চেস্টা হয়। এতে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধী যে ছাড়া পেয়ে যায় তাই নয়, নিরপরাধ লোকও অভিযুক্ত হয়ে যায়। এমন সমস্যার হাত থেকে অব্যাহতি পেতে ডিএনএ আলেখন উল্লেখযোগ্যভাবে সাহায্য করে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেখানে অপরাধমূলক ক্রিয়া (খুন বা ধর্ষণ) ঘটে থাকে সেখানে অপরাধী তার কোন না কোন জিনিস ফেলে যায়। এই পরিত্যক্ত জিনিস এক ফোঁটা রক্ত, গায়ের চামড়া থেকে খুলে পরা দু একটা কোষ, চুল কিংবা বীর্যও হতে পারে। অনুসন্ধানীরা অপরাধের জায়গায় অপরাধীর পরিত্যক্ত কোন পদার্থ পেলে তা সংরক্ষণ করে পরীক্ষাগারে নিয়ে যায়। কোষ থেকে ডিএনএ পদ্ধতিতে বের করা হয়। প্রাপ্ত ডিএনএ এর পরিমাণ কম হলে PCR মাধ্যমে তার পরিমাণ বাড়িয়ে নেওয়া হয়। এর সঙ্গে যত জন সন্দেহভাজন লোক ধরা পড়ে তাদের প্রত্যেকের ডিএনএ ও অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিএনএ নিয়ে, সকল ডিএনএ এর আলাদা আলাদা ডিএনএ আলেখ্য তৈরি করা হয়। অপরাধের জায়গা থেকে পাওয়া ডিএনএ কে বলা যায়, এভিডেন্স (Evidence) বা প্রমাণ। প্রমাণ স্বরূপ ডিএনএ থেকে যে ডিএনএ আলেখ্য পাওয়া যায়, তার সঙ্গে আবার সকল সন্দেহ ভাজন লোকের ডিএনএ আলেখ্যের তুলনা করলে বোঝা যায় কে প্রকৃত অপরাধী। অপরাধী ও প্রমাণের ডিএনএ আলেখ্যে ডিএনএ ব্যান্ডগুলি হুবহু মিলে যায়।

পিতৃত্ব নির্নয়ে ডিএনএ আলেখ্য সম্পাদনা

অনেক সময় পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব নিয়ে বিবাদ দেখা যায়। এমন বিতর্কিত সমস্যা সমাধানে ডিএনএ আলেখন বিশদ ভাবে কাজে লাগে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য , যেহেতু সন্তান , পিতার অর্ধেক ও মাতার অর্ধেক ডিএনএ লাভ করে সেজন্য সন্তানের ডিএনএ আলেখ্যে সঙ্গে বাবা বা মায়ের ডিএনএ আলেখ্যের অর্ধেক মিল পাওয়া যায়।

বিকৃত শবদেহ শনাক্তকরণে ডিএনএ আলেখ্য সম্পাদনা

সাধারনত কোন মানুষের দেহ বা অন্যান্য অংশ অনেকদিন ধরে মাটির তলায় থাকলে বা কোন ভাবে আগুনে পুড়ে গেলে, অর্থাৎ দেহটি বিকৃত হলে, এটিকে সহজে সনাক্তকরন করা যায় না। এই ক্ষেত্রে সনাক্তকরনের জন্য ডিএনএ আলেখ্য এর সাহায্য নেওয়া হয়। প্রথমে ওই দেহাংশ থেকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়, ওর বিভিন্ন কোষ থেকে বা অস্থি কোষ থেকে। অনেকসময় অবিকৃত চুল থেকেও ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়।

লুপ্তপ্রায় প্রাণী দের বংশ বৃদ্ধির জন্য জিনগত মিল রয়েছে এমন আত্মীয় খুঁজতে সম্পাদনা

যেসব প্রাণী পৃথিবী থেকে লুপ্ত হতে চলেছে, অর্থাৎ লুপ্তপ্রায় প্রাণী গুলিকে এই পৃথিবীতে বাচিয়ে রাখতে গেলে এদের বংশ বৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে, এর জন্য দরকার ওদের জিনগত সম্পর্কযুক্ত প্রাণীদের সাথে মিলন। এছাড়াও ডিএনএ আলেখ্য পদ্ধতির সাহায্যে ওইসব জীবদের কাছাকাছি আত্মীয়দের খোঁজ মেলে, যার ফলে এইসব প্রাণীদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এছাড়া একই গোষ্ঠীতে অবস্থিত প্রাণীদের শ্রেণীকরণ করতেও ডিএনএ আলেখন পদ্ধতি কাজে লাগে। কোন প্রাচীন কালে জীবাশ্ম থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে তখন ঐ জীব সমন্ধে ধারণা করা যায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষত অস্থি মজ্জা সংস্থাপনের আগে দাতা ও গ্রহিতার সম্পর্ক নির্ণয়ে সম্পাদনা

যে সমস্ত রোগীদের লিউকেমিয়া, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, লিম্ফোমা যেমন- হজকিন্স ডিজিস, মাল্টিপিল মায়লেমা, ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম এবং কিছু কঠিন টিউমার যেমন স্তন ক্যানসার, জরায়ু ক্যানসার আছে, তাদের অস্থি মজ্জার স্টেম সেল গুলি ঠিক মত কাজ করে না। ফলে তৈরি হয় প্রচুর পরিমানে ত্রুটিপূর্ণ এবং অপরিনত কণিকা ও অল্প পরিমাণ কণিকা। এই ত্রুটিপূর্ণ কণিকা গুলি স্বাভাবিক রক্তকনিকা প্রস্তুতিতে হস্তক্ষেপ করে, রক্তস্রোতে পুঞ্জিভূত হয় এবং কলা গুলিকে আক্রমণও করতে পারে। সেই কারণে অস্থিমজ্জা সংস্থাপনের প্রয়োজন হয়। অভিন্ন জমজদের অস্থি সংস্থাপনের জন্য বা একই পিতা মাতার সন্তান বা রোগীর নিজস্ব অস্থিমজ্জার জেনেটিক মেকাপ যতটা সম্ভব বেশি মিল থাকা প্রয়োজন। দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে জেনেটিক মেকাপের মিল খোঁজার জন্য ডিএনএ আলেখনের সাহায্য নেওয়া হয়।

মানুষের বিবর্তনের সঠিক রাস্তা খোঁজার কাজে সম্পাদনা

আধুনিক মানুষ Homo sapiens sapiens এর পূর্বপুরুষ উদ্ভূত হএছিল আফ্রিকাতে ২.৪ মিলিয়ন বছর আগে, যার প্রমাণ ইথিওপিয়াতে (দক্ষিণ এশিয়া) পাওয়া গিয়েছিল। আরও অন্যান্য আলামত থেকে এটা প্রমাণ হয় যে প্রথম মানুষের উদ্ভব আফ্রিকাতেই (Jurmain et. al. 2005) । আদিম মানুষ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক মানুষে রুপান্তরিত হয়েছে। আণবিক জীববিজ্ঞানের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে The Complete Replacement Theory অনুযায়ী কোষের মধ্যে থাকা mt ডিএনএ এবং তাদের প্রতিলিপি যা মায়ের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। এটি বোঝা যায় সমস্ত মাতৃক বংশগত ত্রেটগুলি লক্ষ করলে। (Jenson, 1998) আদিম মানুষ বিবর্তনের পথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেও[৮] আবিষ্কৃত হওয়া জীবাশ্মের ডিএনএ আলেখন বিশ্লেষণের দ্বারা আধুনিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায়।

সহোদর যমজ সম্পাদনা

সহোদর যমজদের ক্ষেত্রে ডিএনএ আলেখন সম্পূর্ণ এক হয় । পৃথিবীতে প্রায় ১২ মিলিয়ন মোনোজাইগোটিক যমজ রয়েছে । এর ফলে তাদের শনাক্ত করতে খুব অসুবিধা হয়। ফলস্বরূপ ডিএনএ আলেখনের উপযোগিতা সামান্য কমে গেছে।

মিশ্র নমুনা সম্পাদনা

মিশ্র নমুনা যেমন- যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া মহিলার থেকে প্রাপ্ত (Vagenal Swab ) থেকে ডিএনএ প্রফাইলিং করা খুব কঠিন।

কৌশলগত ত্রুটি সম্পাদনা

  • প্রফাইলিং করার সময় সংকরায়ন ও প্রোবিং পদ্ধতির ত্রুটি ডিএনএ আলেখনের ত্রুটির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
  • পরিক্ষাগারের কর্মীদের কর্মদক্ষতা ও পারদর্শিতা এবং সতর্কতার অভাব ডিএনএ আলেখনের ফলের ওপর প্রভাব পড়ে।

ডিএনএ আলেখন মিলের সম্ভাবনা সম্পাদনা

প্রতি ৫ মিলিয়ন লোকের মধ্যে এক জন মানুষের ডিএনএ আলেখন প্রায় মিলে যায়, তাই বলা যায় ৬০ মিলিয়ন মানুষের দেশে প্রায় ১২ জন মানুষের একই ডিএনএ আলেখন হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. http://www.accessexcellence.org/RC/AB/BA/Use_of_DNA_Identification.php ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ মে ২০১৫ তারিখে , Use of DNA in Identification
  2. Kijk magazine, 1 January 2009
  3. Joseph Wambaugh, The Blooding (New York: A Perigord Press Book, 1989), 83.
  4. মৃন্ময় দাস এর প্রোজেক্ট অফ ডি এন এ ফিঙ্গার প্রিন্টিং
  5. Joseph Wambaugh, The Blooding (New York: A Perigord Press Book, 1989), 202.
  6. Miller, Kevin. "Mitochondrial DNA Concordance"
  7. "CODIS — National DNA Index System". Fbi.gov. Retrieved 2010-04-
  8. Multi Regional Evolution (Wolpoff, 1999)