চেমন আরা

বাংলাদেশি শিক্ষক, সাহিত্যিক, ভাষাসৈনিক ও ডানপন্থী রাজনীতিবিদ

চেমন আরা ১৯৩৫ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের চান্দগাঁও উপজেলার মৌলবী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী থাকাবস্থায় স্বামী শাহেদ আলীর অনুপ্রেরণায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। [১]

ভাষা সৈনিক

চেমন আরা
জন্ম (1935-07-01) জুলাই ১, ১৯৩৫ (বয়স ৮৮)
জাতীয়তাবাংলাদেশি
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি
মাতৃশিক্ষায়তনকামরুন্নেছা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ইডেন মহিলা কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাশিক্ষক, রাজনীতিবিদ
পরিচিতির কারণভাষাসৈনিক
রাজনৈতিক দলতমদ্দুন মজলিস (১৯৪৮–১৯৫২), ছাত্রী পরিষদ (সভাপতি)
আন্দোলনভাষা আন্দোলন
দাম্পত্য সঙ্গীকথাশিল্পী ও ভাষা সৈনিক শাহেদ আলী
সন্তান৩ ছেলে, ৩ মেয়ে
পিতা-মাতা

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

চেমন আরার পিতা এ. এস. এম মোফাখখার কলকাতা হাইকোর্টে মুসলমান এডভোকেটদের মধ্যে একজন ও মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কথাশিল্পী ও ভাষাসৈনিক শাহেদ আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তার অনুপ্রেরণায় ভাষা সৈনিকসহ বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত হন।

শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

১৯৫১ সালে ঢাকার কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৫৩ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৬ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৫৭ সালে এমএ পাশ করেন।[২]

শিক্ষকতা সম্পাদনা

৩৬ বছরের কর্মজীবনে একাধিক প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে শিক্ষার আলো বিস্তার করে গেছেন। ১৯৫৯ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেন। সে বছরই বাদশা মিয়া চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৯-৬১ সালে চেমন আরা আন্দরকিল্লাস্থ মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির স্কুলে প্রাতঃকালীন শিফ্টে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করেন। ১৯৬২ সালে ইডেন কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে কিছুদিন দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৬৭-৬৮ চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে পুনরায় ইডেন কলেজে এ আসেন এবং অধ্যাপনার পাশাপাশি নতুন হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবেও কাজ করেন (১৯৭০-১৯৮২)। তিনি ৮২-৮৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং ১৯৯৩ সালে ঢাকা তিতুমীর কলেজে থাকাবস্থায় শিক্ষাকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।[৩]

ভাষা সৈনিক সম্পাদনা

চেমন আরা ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠনে ১৯৪৮ সালে যোগ দেন। এ সংগঠনের নেতৃত্বে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন।[৪] ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা শহীদ বরকতের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে যে মিছিল বের করে তাতে তিনিও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে সাহিত্যচর্চার সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছেন চেমন আরা।

সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

চেমন আরা ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস নামে সাংস্কৃতিক সংগঠনে ১৯৪৮ সালে ৮ম শ্রেণিতে থাকাবস্থায় যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে ডানপন্থী ছাত্রীদের সমন্বয়ে ফরমান উল্লাহ খানের তত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ছাত্রী পরিষদ’ গঠন করেন। ১৯৬৩ সালে শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন এবং এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে ‘সবুজ সেনা’ গঠন করেন এবং ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম মহিলা কলেজে ‘ইসলামী পাঠচক্র‘ নামে মহিলাদের জন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে যাওয়ার পর মুসলিম নারীদের নিয়ে ‘নারী’ অধিকার আন্দোলন সনামে একটি সংগঠন গঠিত হলে তিনি সেখানে সভানেত্রী নির্বাচিত হন। সূচনালগ্ন থেকে তিনি এ সংগঠনের চেয়ারপার্সন। ১৯৮০ সনে তিনি ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের সংগে শিক্ষা প্রতিনিধি হয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর এবং ইউরোপের সুইডেন,নরওয়ে, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ সফর করেন। ১৯৮৭ সালে তার স্বামী কথাশিল্পী শাহেদ আলী, ড. কাজী দীন মুহাম্মদ. ড. এম শমশের আলী, জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-এর আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় ‘তামরিন’ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে চেমন আরা এই স্কুলের পরিচালনার ভার নেন।[৫]

প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পাদনা

১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন সময় থেকে তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একাধিক সাপ্তাহিক ও দৈনিকে লেখালেখি শুরু করেন।[৬] তার প্রথম লেখা সাপ্তাহিক সৈনিকে প্রকাশিত হয়। পিতার জীবনীগ্রন্থও তিনি সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। তার লেখা একটি কিশোর উপন্যাস ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অগ্রপথিক' পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের সময় দেশের বরেণ্য সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। তার কিছু ভ্ৰমণ কাহিনীও দৈনিক ইনকিলাবের সাহিত্য সাময়িকীতে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছে।[৭] তার প্রকাশিত গ্রন্থ-

  • হৃদয় নামের সরোবরে- গল্পগ্রন্থ
  • সত্তরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
  • তানিয়ার যতো কথা - কিশোর উপন্যাস।
  • নিরুদ্দেশের অভিযাত্রী- ভ্রমণ কাহিনী
  • চন্দগাঁও মৌলবী বাড়ির ইতিকথা- সম্পাদিত
  • সিলমির প্রথম স্কুল
  • বাবুর ফুলের বাগান
  • এম. এম মোফাখখার- সম্পাদিত
  • ইমনের ফুলের বাগান- ছোটদের জন্য লেখা।[৮]

পুরস্কার ও সম্মাননা সম্পাদনা

আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৮ দৈনিক ভোরের কাগজের পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা, ৯ জানুয়ারি ২০১৫ সালে মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট–এর ১৯তম বর্ষপূর্তিতে প্রবীণ পেশাজীবী নারী সম্মাননা,[৯] ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ২০০৪ সালে তমদ্দুন মজলিস ভাষা সৈনিক পদক, ২০০৬ সালে জালালাবাদ ফাউন্ডেশন নারী নেতৃত্বের জন্য- 'হাছান রাজা স্মৃতি' পদক ভূষিত হন।

গ্রেফতার সম্পাদনা

ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কার্যালয় থেকে ২০ কর্মীকে গ্রেফতারে প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবিতে ৫ জানুয়ারি ২০১৩ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে নারী অধিকার আন্দোলনে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। নারী অধিকার আন্দোলনের সভাপতি হিসেবে অধ্যাপিকা চেমন আরাকে ওই বৈঠক থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। [১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "একুশের ভাষাকন্যা চেমন আরা"। দৈনিক খোলা কাগজ। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 
  2. "অধ্যাপিকা চেমন আরা"। অপরাজিতা বিডি। 
  3. "অধ্যাপিকা চেমন আরা"। অপরাজিতা বিডি ডটকম (সাক্ষাতকার)। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 
  4. "অগ্রযাত্রায় অদম্য আট নারীকে সম্মাননা"। ঢাকা টাইমস। ৯ মার্চ ২০১৮। ৩ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 
  5. "অধ্যাপক চেমন আরার সাক্ষাতকার"। অপরাজিতা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 
  6. "ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদান : চেমন আরা"। দৈনিক ইনকিলাব। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 
  7. "লেখকঃ চেমন আরা"পাঠাগার ডট কম। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 
  8. "চেমন আরা এর বই সমূহ"রকমারি। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 
  9. "২০ পেশাজীবী নারীকে সম্মাননা প্রদান"। প্রথম আলো। ১৫ জানুয়ারি ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 
  10. "নারী অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক চেমন আরাসহ আটক ১২"। দৈনিক সংগ্রাম। ৬ জানুয়ারি ২০১৩। ৩ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৯ 

আরো পড়ুন সম্পাদনা

শাহেদ আলী