চালশে
চালশে বা চালিশা (ইংরেজি: Presbyopia) হলো মানব চোখের বয়োবৃদ্ধির কারণে উপযোজন ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে কাছের বস্তু দেখতে অসুবিধা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি প্রেজবিয়োপিয়া নামে পরিচিত।[৪] সাধারণত বয়স চল্লিশ পার হলে এই সমস্যা দেখা দেয়। ছোট অক্ষর পড়তে অসুবিধা হয় তবে অপেক্ষাকৃত একটু দূরে ধরলে কিছুটা ভালো দেখা যায়। তাছাড়া মাথাব্যথা ও চোখে চাপ অনুভূত হয়।[৪] ব্যক্তিভেদে সমস্যার প্রকটতা কমবেশি হতে পারে।[১] চালশের সাথে অন্যান্য দৃষ্টি ত্রুটিগুলোও যুগপৎভাবে থাকতে পারে।[১] এটি হাইপারমেট্রোপিয়া বা দূরদৃষ্টির মতোই যেখানে কাছের জিনিস দেখতে ঝাপসা লাগে, তবে হাইপারমেট্রোপিয়া অল্পবয়সিদের হয়।
চালশে, চালিশা | |
---|---|
প্রতিশব্দ | বয়স্কদের চোখের রোগ[১] |
চালশে ধরা একজন ব্যক্তি ছোট অক্ষরের উপাদান তালিকা সহজে পড়তে পারে না। | |
বিশেষত্ব | দৃষ্টিমিতি, চক্ষুবিজ্ঞান |
লক্ষণ | ছোট অক্ষর পড়তে সমস্যা, পড়ার বই দূরে ধরতে হয়, মাথাব্যথা, চোখে চাপ অনুভূত হওয়া।[১] |
রোগের সূত্রপাত | সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পরে হয়।[১] |
কারণ | বয়সজনিত কারণে চোখের লেন্সের স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পায়।[১] |
রোগনির্ণয়ের পদ্ধতি | চক্ষু পরীক্ষা[১] |
চিকিৎসা | চশমা,[১] কন্ট্যাক্ট লেন্স[২] |
সংঘটনের হার | বর্তমানে ২৫%;[৩] প্রায় প্রত্যেকেই এই সমস্যায় ভুগে থাকে।[১] |
চালশে হলো বয়োবৃদ্ধিজনিত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।[৪] অক্ষিকাচ বা চোখের লেন্স (স্থিতিস্থাপকতার হ্রাস ও কাঠিন্যের বৃদ্ধি) ও সিলিয়ারি পেশির বয়সজনিত পরিবর্তনের ফলে নিকটবর্তী বস্তু দেখার সময় বস্তু থেকে নির্গত আলোক রশ্মি রেটিনার উপর পতিত না হয়ে পশ্চাতে ফোকাস হয়।[৪] এটি চোখের প্রতিসরণজনিত ত্রুটি, চোখের এরূপ অন্যান্য প্রতিসরণজনিত ত্রুটি হলো নিকটদৃষ্টি, দূরদৃষ্টি ও বিষমদৃষ্টি।[৪] চোখের পরীক্ষা করে এই ত্রুটি নির্ণয় করা যায়।[৪]
চশমা, কন্ট্যাক্ট লেন্স, মাল্টিফোক্যাল ইন্ট্রাঅকুলার লেন্স বা ল্যাসিক সার্জারি করে এই ত্রুটি দূর করা সম্ভব।[২][৪][৫] চালশে ত্রুটি দূর করতে চশমায় উত্তল লেন্স ব্যবহার করা হয়।[৪]
চল্লিশ বছর বয়সের পর প্রেজবিয়োপিয়ার ঝুঁকি বাড়ে, প্রায় সব লোকই কিছু মাত্রায় এই সমস্যায় ভুগে থাকে। এই কারণে এই রোগকে চালশে বা চালিশা বলা হয়।[১] বিশ্বব্যাপী বর্তমানে প্রায় ২৫% (প্রায় ১৮০ কোটি) মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত।[৩]
লক্ষণসমূহ
সম্পাদনাপ্রথমদিকে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলো ছোট ছাপার অক্ষরগুলো পড়তে অসুবিধা হওয়া, বিশেষ করে অল্প আলোতে, দীর্ঘ সময় ধরে পড়লে চোখে টান অনুভব করা, কাছের বস্তু ঝাপসা দেখা বা দর্শন দূরত্বের পরিবর্তনের ফলে সাময়িকভাবে ঝাপসা দেখা। উজ্জ্বল সূর্যালোকে তারারন্ধ্র অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে আসলে এই লক্ষণগুলো অতটা বুঝা যায় না।[৬] নির্দিষ্ট কিছু পেশার ব্যক্তি ও নিকটদৃষ্টিতে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে চালশে রোগের লক্ষণ প্রকাশের সময়ে তারতম্য ঘটে।[৭] বিশেষ করে, কৃষক ও গৃহিণীদের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেরিতে প্রকাশ পায়, অপরদিকে চাকরিজীবী ও নির্মাণ শ্রমিকদের লক্ষণ দ্রুত প্রকাশ পায়।
কারণ
সম্পাদনাবয়োবৃদ্ধির ফলে লেন্স শক্ত হয়ে যায়, স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। α-ক্রিস্টালিনের মাত্রা কমে যাওয়াতে লেন্স শক্ত হয়ে যায়, উচ্চতর তাপমাত্রায় এটি বেশি হয়।[৮] এটি বয়োবৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর ফলে দৃষ্টির নিকট বিন্দু ২৫ সেন্টিমিটারের বেশি হয়ে যায়।[৯] লক্ষ্যবস্তু চোখের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে আরও কাছে এলে আর স্পষ্ট দেখা যায় না। আলোকবিজ্ঞানে, চোখের সবচেয়ে কাছে যে বিন্দু পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে খালি চোখে স্পষ্টভাবে দেখা যায় তাকে স্পষ্ট দৃষ্টির নিকট বিন্দু বলে এবং চোখ থেকে এই বিন্দুর দূরত্ব কে স্পষ্ট দর্শনের ন্যূনতম দূরত্ব বলা হয়। এই দূরত্ব মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রুত গতিতে, ১০ বছর বয়সে প্রায় ৯ সেন্টিমিটার ও ৬০ বছর বয়সে প্রায় ৮৩ সেন্টিমিটার।[১০] প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে লেন্সের আকৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতা কমে যায়, ফলে চোখের উপযোজন ক্ষমতা হ্রাস পায়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা প্রায় ১৪ ডাইঅপ্টার, তবে ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই এটি ২ ডাইঅপ্টারের নিচে নামে এবং ৭০ বছর বয়সে প্রায় ০ ডাইঅপ্টারে পৌঁছায়।[১১] এর ফলে চোখ প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপযোজন ক্ষমতাহীন হয়ে যায়। এই অবস্থায় চোখের ফোকাস স্থায়ীভাবে স্থির হয়ে যায়। চোখ নিকট ও দূরবর্তী উভয় বস্তুর ক্ষেত্রেই উপযোজন করতে পারে না।[১১]
চিকিৎসা
সম্পাদনাচালশে রোগীদের চশমায় পড়ার জন্য উত্তল লেন্স ব্যবহার করা হয়। তবে দূরের ও কাছের উভয় বস্তু দেখার জন্য বাইফোকাল বা দ্বিকেন্দ্রী চশমা ব্যবহার করতে হয় যার উপরের অংশ দূরবর্তী বস্তুকে ও নিচের অংশ নিকটবর্তী বস্তুকে ফোকাস করে।[১২] কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করেও এই ত্রুটি দূর করা যায়। মাল্টিফোকাল কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করে নিকট ও দূরবর্তী উভয় ত্রুটিই দূর করা সম্ভব। কেউ কেউ এক চোখে নিকটবর্তী ও আরেক চোখে দূরবর্তী বস্তু দেখার জন্য ভিন্ন ভিন্ন লেন্স ব্যবহার করেন যা মনোভিশন পদ্ধতি নামে পরিচিত। ল্যাসিক শল্য চিকিৎসার সাহায্যে বহুকেন্দ্রিক কর্নিয়া তৈরির মাধ্যমে চালশের চিকিৎসা করা সম্ভব।[১৩] PresbyLASIK এমনই একটি প্রক্রিয়া, তবে ব্যক্তিভেদে এর ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং কারো কারো ক্ষেত্রে দৃষ্টির সৌক্ষ্ম্য বা তীক্ষ্ণতা কমে যায়।[১৪] সময়ের সাথে সাথে চোখের পরিবর্তন ঘটে যা প্রতিসরণ শল্যচিকিৎসার অন্যতম একটি উদ্বেগ।[১৩]
মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন পাইলোকারপিন নামক একটি চোখের ড্রপ চালশের চিকিৎসায় ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।[১৫]
ব্যুৎপত্তি
সম্পাদনাপ্রেজবিয়োপিয়া (presbyopia) শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ πρέσβυς presbys যার অর্থ "বৃদ্ধ" ও ὤψ ōps থেকে যার অর্থ "দৃষ্টি" (GEN ὠπός ōpos)[১৬][১৭]).
গবেষণা
সম্পাদনাচালশের চিকিৎসায় তারারন্ধ্র সংকুচিত করে এমন চোখের ড্রপ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।[১৮] লেন্সের স্থিতিস্থাপকতা ধরে রাখবে এমন ড্রপ নিয়েও গবেষণা চলছে।[১৯]
ইতিহাস
সম্পাদনাখ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে অ্যারিস্টটলের লেখনীতে চালশে ত্রুটির উল্লেখ পাওয়া যায়।[২০] ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে চশমায় লেন্সের ব্যবহার শুরু হয়।[২০]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ "Facts About Presbyopia"। NEI। অক্টোবর ২০১০। ৪ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ ক খ Pérez-Prados, Roque; Piñero, David P; Pérez-Cambrodí, Rafael J; Madrid-Costa, David (মার্চ ২০১৭)। "Soft multifocal simultaneous image contact lenses: a review"। Clinical and Experimental Optometry। 100 (2): 107–127। এসটুসিআইডি 205049139। ডিওআই:10.1111/cxo.12488। পিএমআইডি 27800638।
- ↑ ক খ Fricke, Timothy R.; Tahhan, Nina; Resnikoff, Serge; Papas, Eric; Burnett, Anthea; Ho, Suit May; Naduvilath, Thomas; Naidoo, Kovin S. (অক্টোবর ২০১৮)। "Global Prevalence of Presbyopia and Vision Impairment from Uncorrected Presbyopia"। Ophthalmology। 125 (10): 1492–1499। ডিওআই:10.1016/j.ophtha.2018.04.013 । পিএমআইডি 29753495।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ Khurana, AK (সেপ্টেম্বর ২০০৮)। "Asthenopia, anomalies of accommodation and convergence"। Theory and practice of optics and refraction (2nd সংস্করণ)। Elsevier। পৃষ্ঠা 100–107। আইএসবিএন 978-81-312-1132-8।
- ↑ "PresbyLASIK - EyeWiki"। eyewiki.aao.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-২৭।
- ↑ "Presbyopia: Patient Information"। Marquette, MI: Eye Associates of Marquette। ২০০৮। ২ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১০-৩১।
- ↑ García Serrano, JL; López Raya, R; Mylonopoulos Caripidis, T (নভে ২০০২)। "Variables related to the first presbyopia correction"। Archivos de la Sociedad Española de Oftalmología। 77 (11): 597–604। আইএসএসএন 0365-6691। পিএমআইডি 12410405। ৭ অক্টোবর ২০১১ তারিখে মূল (Free full text) থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ Pathai, S; Shiels, PG; Lawn, SD; Cook, C; Gilbert, C (মার্চ ২০১৩)। "The eye as a model of ageing in translational research--molecular, epigenetic and clinical aspects."। Ageing Research Reviews। 12 (2): 490–508। এসটুসিআইডি 26015190। ডিওআই:10.1016/j.arr.2012.11.002। পিএমআইডি 23274270।
- ↑ Katz, Debora M. (২০১৫)। Physics for Scientists and Engineers: Foundations and Connections, Advance Edition (ইংরেজি ভাষায়)। Cengage Learning। আইএসবিএন 978-1-305-53720-0।
- ↑ Barrett, Kim E.; Barman, Susan M.; Brooks, Heddwen L.; Yuan, Jason। Ganong's Review of Medical Physiology (26 সংস্করণ)। পৃষ্ঠা 449। আইএসবিএন 978-1-26-012241-1।
- ↑ ক খ E. Hall, John। Guyton and Hall Textbook of Medical Physiology (13 সংস্করণ)। Elsevier। পৃষ্ঠা 640। আইএসবিএন 978-1-4557-7016-8।
- ↑ Li, G; Mathine, DL; Valley, P; Ayräs, P; Haddock, JN; Giridhar, MS; Williby, G; Schwiegerling, J; ও অন্যান্য (এপ্রিল ২০০৬)। "Switchable electro-optic diffractive lens with high efficiency for ophthalmic applications"। Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America। 103 (16): 6100–4। আইএসএসএন 0027-8424। ডিওআই:10.1073/pnas.0600850103 । পিএমআইডি 16597675। পিএমসি 1458838 । বিবকোড:2006PNAS..103.6100L।
- ↑ ক খ Kim, Tae-im; del Barrio, Jorge L Alió; Wilkins, Mark; Cochener, Beatrice; Ang, Marcus (মে ২০১৯)। "Refractive surgery"। The Lancet। 393 (10185): 2085–2098। এসটুসিআইডি 4474834। ডিওআই:10.1016/S0140-6736(18)33209-4। পিএমআইডি 31106754।
- ↑ Pallikaris IG, Panagopoulou SI (জুলাই ২০১৫)। "PresbyLASIK approach for the correction of presbyopia"। Current Opinion in Ophthalmology। 26 (4): 265–72। এসটুসিআইডি 35434343। ডিওআই:10.1097/icu.0000000000000162। পিএমআইডি 26058023।
- ↑ Moyer, Melinda Wenner (২০২১-১২-১৪)। "New Eye Drops Offer an Alternative to Reading Glasses"। The New York Times (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0362-4331। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৫।
- ↑ "Presbyopia"। Dictionary.reference.com। ১২ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৪-১৯।
- ↑ "Presbyopia"। Etymonline.com। ১৮ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৫-০৪।
- ↑ Dick, HB (জুলাই ২০১৯)। "Small-aperture strategies for the correction of presbyopia."। Current Opinion in Ophthalmology। 30 (4): 236–242। এসটুসিআইডি 139101960। ডিওআই:10.1097/ICU.0000000000000576। পিএমআইডি 31033734।
- ↑ Korenfeld, Michael S.; Robertson, Stella M.; Stein, Jerry M.; Evans, David G.; Rauchman, Steven H.; Sall, Kenneth N.; Venkataraman, Subha; Chen, Bee-Lian; Wuttke, Mark; Burns, William (২৯ জানুয়ারি ২০২১)। "Topical lipoic acid choline ester eye drop for improvement of near visual acuity in subjects with presbyopia: a safety and preliminary efficacy trial"। Eye। 35 (12): 3292–3301। ডিওআই:10.1038/s41433-020-01391-z । পিএমআইডি 33514891
|pmid=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। পিএমসি 8602643|pmc=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। - ↑ ক খ Wade, Nicholas J.; Wade, Nicholas (২০০০)। A Natural History of Vision (ইংরেজি ভাষায়)। MIT Press। পৃষ্ঠা 50। আইএসবিএন 9780262731294। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- "Presbyopia" at MedLinePlus Medical Encyclopedia
শ্রেণীবিন্যাস | |
---|---|
বহিঃস্থ তথ্যসংস্থান |