চারুলতা

১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র

চারুলতা সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ১৯৬৪ সালের বাংলা ভাষার ভারতীয় নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নষ্টনীড় গল্প অবলম্বনে এর চিত্রনাট্য লিখেন সত্যজিৎ রায়।[] এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্য মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায় ও শ্যামল ঘোষাল। সার্থক চিত্রায়নের খাতিরে এতে মূল গল্পে খানিকটা পরিবর্তন করা হয়েছে। এটি সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য হয় এবং প্রায়ই সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় তালিকাভুক্ত হয়ে থাকে।

চারুলতা
চারুলতা চলচ্চিত্রের একটি পোস্টার
পরিচালকসত্যজিৎ রায়
চিত্রনাট্যকারসত্যজিৎ রায়
উৎসরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক 
নষ্টনীড়
শ্রেষ্ঠাংশেসৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
মাধবী মুখোপাধ্যায়
শৈলেন মুখোপাধ্যায়
শ্যামল ঘোষাল
সুরকারসত্যজিৎ রায়
চিত্রগ্রাহকসুব্রত মিত্র
সম্পাদকদুলাল দত্ত
প্রযোজনা
কোম্পানি
আরডি বনশল অ্যান্ড কোং
পরিবেশকএডওয়ার্ড হ্যারিসন
মুক্তি
  • ১৭ এপ্রিল ১৯৬৪ (1964-04-17)
স্থিতিকাল১১৭ মিনিট
দেশভারত
ভাষাবাংলা

চলচ্চিত্রটি ১৯৬৪ সালের ১৭ই এপ্রিল মুক্তি পায়। এটি ১২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য রাষ্ট্রপতির স্বর্ণ পদক[]২৮তম বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক (সত্যজিৎ) শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (শৈলেন) ও শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (মাধবী)-সহ ১০টি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে।[]

পটভূমি

সম্পাদনা

১৮৭৯ সালের উচ্চবিত্ত এক বাঙালি পরিবারকে কেন্দ্র করে এর কাহিনী রচিত হয়েছে। পরিবারের কর্তা ভূপতি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তার বাড়িতেই "Sentinnel" নামে পত্রিকাটির কাজ শুরু হয়। পত্রিকার কাজে দিনরাত মগ্ন থাকায় সদ্য যৌবনে পদার্পণকারী স্ত্রীর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়ার সময় পাননা। স্ত্রী চারুলতার সময় কাটে একা একা। অবসরে চারু সাহিত্য চর্চা করে সময় কাটায়। স্ত্রীর নিঃসঙ্গতা স্বাভাবিকভাবেই ভূপতির চোখে পড়ে। তাই চারুর ভাই উমাপদকে চিঠি লিখে সস্ত্রীক চলে আসার জন্য বলেন। উমাপদকে নিজের পত্রিকার ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। উমাপদর স্ত্রী মন্দাকিনীর সাথে চারুর চরিত্রের আকাশ-পাতাল ফারাক। তাই চারুর নিঃসঙ্গতা খুব কমই প্রশমিত হয়। এমন সময় আগমন ঘটে ভূপতির পিসতুতো ভাই অমলের।

অমলের সাথে চারুর সম্পর্ক আগে থেকেই বেশ ঘনিষ্ঠ। তবে প্রথম দিকে তাদের সম্পর্কে বৌঠান-ঠাকুরপোর স্বাভাবিকতা ছাড়া অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। ভূপতি অমলকে নিজ স্ত্রীর মধ্যে লুক্কায়িত সাহিত্যিক প্রতিভা বের করে আনার দায়িত্ব দেয়। এর সাথে তার পত্রিকার শুদ্ধতা করার কাজে লাগানোরও চেষ্টা করে। অবশ্য সাহিত্য চর্চা ছাড়া অন্য কিছুতে অমলের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এর মধ্যে উমাপদর মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে ভূপতি তাকে পত্রিকার আর্থিক দিকটার সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে দেয়। চারুর ভাই বলেই হয়তো উমাপদকে অবিশ্বাস করার প্রশ্ন উঠেনি। চারু অবশ্য তার ভাই সম্বন্ধে এতোটা বিশ্বাসী ছিল বলে মনে হয়না।

অমল চারুর সাথে সাহিত্য চর্চা শুরু করে তার মধ্যের লুক্কায়িত প্রতিভার স্ফূরণ ঘটানোর জন্য। এর সাথে শুরু হয় অমল, চারুলতা ও মন্দাকিনীর পারষ্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন। একান্ত আলোচনা আর মেলামেশা থেকে সহজেই বোঝা যায় চারুর সাথে অমলের সম্পর্ক কেবল বৌঠান-ঠাকুরপোর নয়, এর মধ্যে অন্য কিছুও রয়েছে। ওদিকে মন্দাকিনীও কিছুটা দুর্বল থাকে অমলের প্রতি। তাই অমলের সাথে মন্দার কথাবার্ত বা মেলামেশা সহ্য করতে পারেনি চারু। সে অমলকে দেখাতে চেয়েছে মন্দার চেয়ে সে কতোটা গুণবতী। অমলের লেখা পত্রিকায় ছাপা হবার পর সেও সেই পত্রিকায় লেখা পাঠায়। চারুর লেখাও ছাপা হয় এবং দেখা যায় সাহিত্যিক প্রতিভা অমলের চেয়ে চারুরই বেশি। ইতোমধ্যে অমলের বিয়ের প্রস্তাব আসে বর্ধমান থেকে। বিয়ের পর শ্বশুর জামাইকে বিলেত পাঠাবেন। এক মাস সময় চেয়ে নেয় অমল। সাথে সাথে রাজি না হওয়ায় চারু সাময়িকভাবে স্বস্তি বোধ করে। চারুর আচরণ দেখে অমল অচিরেই বুঝতে পারে দাদার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে তাকে সরে পড়তে হবে।

উমাপদ বিশ্বাসঘাতকতা করে। পত্রিকার দেনা ২৭০০ টাকার মধ্যে মাত্র ৩০০ টাকা পরিশোধ করে বাকিটা নিয়ে সরে পড়ে। পত্রিকা অচল হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে ভূপতি। চারু অমলকে জানায়, কিছুতেই যেন সে বাড়ি ছেড়ে না যায়। কিন্তু অমল সে রাতেই দাদার উদ্দেশ্য একটা ছোট চিঠি রেখে পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। পত্রিকা ছেড়ে স্ত্রীর দিকে মনোযোগী হয় ভূপতি। বেড়াতে যায় সমুদ্রের ধারে। সেখানেই স্ত্রীর সাথে তার অনেক আলাপ হয়, একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য তারা মনস্থির করে যার বাংলা ও ইংরেজি দুই অংশই থাকবে। বাংলা অংশে চারু লেখালেখি করবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়ে অমলের চিঠি পায় তারা। সে বর্তমানে মাদ্রাজে এক বন্ধুর বাড়িতে আছে আর বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভালোভাবেই চিন্তা করছে। বিয়ে করে ফেলাটা হয়তো সময়ের ব্যাপার মাত্র। চিঠি না পড়েই কান্নায় ভেঙে পড়ে চারু যা দেখে ফেলে ভুপতি। ভাইয়ের সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক তাকে অশান্তিতে ফেলে দেয়। তাদের মিল হওয়াটা তখন অসম্ভবের পর্যায়ে, সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বিচ্ছেদও অস্বাভাবিক । শেষ পর্যন্ত তাদের হাত মেলেনি। তাদের মিলন না বিচ্ছেদ হবে তা মুখ্য নয়। সেই দিনটি বা সে সময়টিতে তাদের নীড় যে ভেঙে গেছে চলচ্চিত্রে তা-ই মুখ্যভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

চরিত্রায়ন

সম্পাদনা

সংরক্ষণ

সম্পাদনা

একাডেমি ফিল্ম আর্কাইভ ১৯৯৬ সালে চারুলতা চলচ্চিত্রটি সংরক্ষণ করে।[]

পুরস্কার

সম্পাদনা
বছর পুরস্কার বিভাগ মনোনীত ফলাফল সূত্র.
১৯৬৫ ১৫তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য স্বর্ণ ভল্লুক সত্যজিৎ রায় মনোনীত []
শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে রৌপ্য ভল্লুক বিজয়ী
ওসিআইসি পুরস্কার বিজয়ী
১২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য রাষ্ট্রপতির স্বর্ণ পদক সত্যজিৎ রায়, আর ডি বনশল বিজয়ী []
২৮তম বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার শ্রেষ্ঠ ভারতীয় চলচ্চিত্র চারুলতা বিজয়ী []
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শৈলেন মুখোপাধ্যায় বিজয়ী
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় বিজয়ী
শ্রেষ্ঠ পরিচালক সত্যজিৎ রায় বিজয়ী
শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিজয়ী
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক বিজয়ী
শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্র বিজয়ী
শ্রেষ্ঠ চিত্রসম্পাদক দুলাল দত্ত বিজয়ী
শ্রেষ্ঠ শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত বিজয়ী
শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক নৃপেন পাল বিজয়ী
১৯৬৮ বায়াদোলিদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব গোল্ডেন স্পাইক সত্যজিৎ রায় মনোনীত

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. বিশ্বাস, মৈনাক। "Writing on the Screen: Satyajit Ray's Adaptation of Tagore"। ২৩ মে ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  2. "12th National Film Awards"। ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০২৪ 
  3. "28th Annual BFJA Awards"। বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। ৮ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০২৪ 
  4. "Preserved Projects"একাডেমি ফিল্ম আর্কাইভ। ১৫ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০২৪ 
  5. "Berlinale 1965: Prize Winners"বার্লিনালে। ১৯ মার্চ ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০২৪ 

প্রাসঙ্গিক অধ্যয়ন

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা

টেমপ্লেট:শ্রেষ্ঠ ভারতীয় চলচ্চিত্র বিভাগে বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার