চারুচন্দ্র সান্যাল

ডাঃ চারুচন্দ্র সান্যাল (২৩ জুলাই ১৮৯৭ - ১২ জুলাই ১৯৮০) ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও লোকসংস্কৃতিবিদ। [১] পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের বিশেষকরে জলপাইগুড়ি জেলার সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি নিয়ে যারা বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করেছেন তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতিচর্চার জনক হিসাবে পরিচিতি ছিল তার। সেখানকার রাজবংশীদের নিয়ে পুস্তক রচনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তাকে রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করেন।

চারুচন্দ্র সান্যাল
জন্ম(১৮৯৭-০৭-২৩)২৩ জুলাই ১৮৯৭
জলপাইগুড়ি ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) ভারত
মৃত্যু১২ জুলাই ১৯৮০(1980-07-12) (বয়স ৮২)
পিতা-মাতাজয়চন্দ্র সান্যাল (পিতা)
পুরস্কাররবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬৮)

জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

চারুচন্দ্র সান্যালের জন্ম ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গে তার পিতা জয়চন্দ্র সান্যালের কর্মস্থল জলপাইগুড়িতে। বিদ্যালয়ের পাঠ জলপাইগুড়ির জিলা স্কুলে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশের পর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং আই.এ পাশের পর শারীরবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এসসি পাশ করেন। কলেজে পড়াশোনার সময়ই তিনি গান্ধীবাদী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর কন্যাকে বিবাহ করেন।

শ্বশুরের প্রভাবেই তিনি ডাক্তারী পরীক্ষা অসমাপ্ত রেখে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং এক মাসের কারাদণ্ড ভোগ করেন। এরপর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দেও ছাত্রসম্মেলনে রাজদ্রোহমূলক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য গ্রেফতার হন এবং এক বছরের কারাদণ্ড হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের লবণ সত্যাগ্রহ ও ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নিয়েও কারাবাস করেছেন তিনি। এই সময়েই তিনি কমিউনিজমে আকৃষ্ট হন এবং কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বাংলা ভাষায় - সাম্যবাদীর আদর্শ নামে অনুবাদ করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

ডাক্তারী পড়ার সময়ই চারুচন্দ্র জাতীয় আয়ুর্বিজ্ঞান বিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি পড়ার সময় ও অধ্যাপনাকালেই চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলি চিকিৎসা ক্ষেত্রে ও পাঠ্যপুস্তক হিসাবেও বিবেচিত হয়। গ্রন্থগুলি হল-

  • কালাজ্বরের চিকিৎসায় কুইনাইন প্রয়োগে - ফারদার পশিবিলিটিজ অব কুইনাইন স্টাডি
  • ল্যাবরেটরি এসেনশিয়ালস্ অফ সাইকোলজিক্যাল কেমিস্ট্রি

এছাড়াও তার লেখা 'ইন্টাভেনাস আইওডিন ইন সেপটিক ফিভারস্', 'বেঙ্গল ডায়েটারি', 'কালাজ্বর' ইত্যাদি প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে 'ক্যালকাটা মেডিক্যাল রিভিউ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতিচর্চায় চারুচন্দ্র বিশেষ অবদান রেখেছেন। আলিপুরদুয়ারের অতি ক্ষুদ্র জনজাতি - টোটোদের নিয়ে তার লেখা দ্য টোটোজ শীর্ষক প্রবন্ধ এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হলে তাদের কথা বিশ্বের সভ্য জগত জানতে পারে। উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও আদিবাসীদের নিয়েও কয়েকখানি পুস্তক রচনা করেছেন। সেগুলি হল -

  • রাজবংশীজ অফ নর্থ বেঙ্গল (১৯৬৫), দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা, বাংলা সংস্করণ উত্তরবঙ্গের বাজবংশী আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৫০৪০-৮৩৮-৪
  • দ্য মেচেস অ্যান্ড দ্য টোটোস, টু সাব-হিমালয়ান ট্রাইবস অফ নর্থ বেঙ্গল (১৯৭৩), উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
  • দ্য লিমবাস
  • জলপাইগুড়ি জেলার একশো বছরের ইতিহাস

চারুচন্দ্র সান্যাল ১৯৩২ খ্রি হতে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে জলপাইগুড়ি জেলার খাদ্যসমস্যা নিয়েও তিনি নিজের সম্পাদিত "জনমত" পত্রিকায় তালিকাভিত্তিক সুচিন্তিত আলোচনা করেছেন। উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তা নদী সম্পর্কে তার বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে জিওগ্রাফিক্যাল ম্যাগাজিনে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে এবং কোচবিহার রাজ্যকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে চারুচন্দ্র সান্যালের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি কয়েকটি চা কোম্পানি পরিচালক হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পুরানো শ্রমিক শোষণনীতির বিরোধী ছিলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে চা বাগান মালিকদের সংগঠনে শ্রমিকদের নায্য দাবী নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করেন। তার অনেকগুলিই পরবর্তীকালে বাস্তবায়িত হয়েছিল। তিনি কংগ্রেস নেতা ও তৎকালীন বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন।

সম্মাননা সম্পাদনা

মৃত্যু সম্পাদনা

ডাঃ চারুচন্দ্র সান্যাল ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ২১৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬