ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য

বাঙালি কল্পবিজ্ঞান লেখক ও শিশু সাহিত্যিক

ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য (১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ – ৩ জুন ১৯৯০) ছিলেন একজন বাঙালি কল্পবিজ্ঞান লেখক ও শিশু সাহিত্যিক।[১][২] পেশায় রসায়নের অধ্যাপক হয়েও সাহিত্যানুরাগে কলম ধরেন বিজ্ঞান বিষয়ক গল্প ও প্রবন্ধ রচনায়। কল্পবিজ্ঞান ও শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানে পুরস্কৃত হয়েছেন।

ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
জন্ম(১৯০৯-০২-০১)১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯
মৃত্যু৩ জুন ১৯৯০(1990-06-03) (বয়স ৮১)
জাতীয়তাভারতীয়
নাগরিকত্বভারতীয়
পেশাঅধ্যাপক
পরিচিতির কারণকল্পবিজ্ঞান লেখক ও শিশু সাহিত্যিক
পিতা-মাতাবিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য (পিতা)
পুরস্কারভুবনেশ্বরী পদক
বিদ্যাসাগর পুরস্কার

জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা ফেব্রুয়ারি বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। পিতা বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য ছিলেন জেলা ম্যাজিসেট্রট এবং সুসাহিত্যক। তার পাঁচ পুত্রের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ। জ্যেষ্ঠপুত্র হেমেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন বারাণসী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের রিডার এবং দ্বিতীয় পুত্র মনোরঞ্জন (১৯০৩-১৯৩৯) ছিলেন রিপন কলেজ তথা বর্তমানের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। পিতার বদলির চাকরির কারণে তাকে বাল্যকালে বহু বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে হয়। শেষে কলকাতার সাউথ সাবার্বণ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক হন। এরপর ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত রসায়নে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এসসি পাশ করেন। তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং হেমেন্দ্রকুমার সেনের অধীনে গবেষণা করেছিলেন।[৩]

কর্মজীবন সম্পাদনা

রসায়নে এম.এসসি পাশের পর তিনি অধ্যাপনার ডাক পেলেও প্রথমদিকে তা' প্রত্যাখ্যান করে পুস্তক ব্যবসা শুরু করেন। পরে ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হলে আশুতোষ কলেজে এবং তারপর যোগমায়া দেবী কলেজে রসায়নে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সহকর্মী অধ্যাপক বিশ্বমোহন মুখোপাধ্যায়ের সাথে যৌথভাবে রচনা করেন এলিমেন্টস অব কেমিস্ট্রি (রসায়নের উপাদানসমূহ)।[৩]

সুসাহিত্যক পিতাকে অনুসরণ করে ছোটবেলা থেকেই তিনি অল্পবিস্তর লেখালেখি করতেন। প্রথমে কবিতা রচনা করতেন। পরে শিক্ষকদের পরামর্শে গদ্যসাহিত্যে এবং সবশেষে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনায় শিশুদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ে এবং বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনী রচনায় সিদ্ধহস্ত হন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর বাংলায় ১৯২৫-২৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে প্রেমেন্দ্র মিত্র তার জন্মস্থান বারাণসী চলে যান। সেখানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হেমেন্দ্রনারায়ণের কাছে ঘুরতে যাওয়া মনোরঞ্জন ও ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ দুই ভাইয়ের সঙ্গে। তারাই মিলিতভাবে স্থির করেন যে তারা তিনজনে ছোটদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা লিখবেন। সেই মত প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা পিঁপড়ে পুরাণ প্রকাশিত হয় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে রামধনু পত্রিকায়। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণেরও বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প কাশ্মীরী রহস্য প্রকাশিত হয় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ওই পত্রিকাতেই। তবে ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ বিজ্ঞানভিত্তিক রচনায় মূল প্রেরণা পান অধ্যাপক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, কবিশেখর কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের এবং সারা জীবনই ছোটদের সাহিত্য নিয়ে মেতে ছিলেন। তার বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে "রামধনু", "শিশুসাথী", "শুকতারা", "সন্দেশ", "কিশোর ভারতী", "কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান", "আনন্দমেলা" প্রভৃতি পত্রিকায়।[৩] স্বনামে লেখার পাশাপাশি তিনি 'কৌটিল্য' ও 'রসোদর শর্মা' ছদ্মনামও কখনো কখনো ব্যবহার করতেন।[১]

তিনি পঁচিশটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য রচিত গ্রন্থ গুলি হল ―

  • বিজ্ঞান বুড়ো
  • বিজ্ঞানের জয়যাত্রা
  • আবিষ্কারের গল্প
  • ধূমকেতু
  • লুপ্তধন
  • মেঘনাদ
  • বারোদীঘির রায়বাড়ি

শিল্পী পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে পাঁচ খণ্ডের ছোটোদের বিশ্বকোষ সম্পাদনা ছিল তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।[২]

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তার পিতৃ-প্রতিষ্ঠিত শিশুদের মাসিক পত্রিকা রামধনু-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু দিন। প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বৎসরে পিতার ইচ্ছায় তার অগ্রজ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য পত্রিকাটির সম্পাদনা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ আমৃত্যু ওই পত্রিকা সম্পাদনা করেন।[১]

পুরস্কার ও সম্মাননা সম্পাদনা

শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনেশ্বরী পদক লাভ করেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফটিক স্মৃতি পুরস্কার ও ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়াও তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত বিজ্ঞান পুরস্কার-ও লাভ করেছিলেন।[১]

জীবনাবসান সম্পাদনা

১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৩রা জুন ৮১ বৎসর বয়সে কল্পবিজ্ঞান লেখক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ১০০,১০১, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. শিশিরকুমার দাশ (২০১৯)। সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। পৃষ্ঠা ৫৯। আইএসবিএন 978-81-7955-007-9 
  3. "ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য - কল্পবিজ্ঞানের এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায় - কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-৩১