কুলধারা

ভারতের একটি গ্রাম

কুলধারা ভারতের রাজস্থান রাজ্যের জয়সলমের জেলায় অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত গ্রাম। ত্রয়োদশ শতকের কাছাকাছি সময়ে পালিওয়াল ব্রাহ্মণেরা এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং সেসময়ে এটি একটি সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল। তবে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে কোনো এক অজানা কারণে পরিত্যক্ত হয়। সম্ভবত, জল সরবরাহ হ্রাস ছিল এর মূল কারণ। তবে ভূমিকম্পসহ স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, এই গ্রামের ধ্বংসের কারণ ছিলেন তৎকালীন জয়সলমের রাজ্যের মন্ত্রী সালিম সিং। গ্রামবাসীদের প্রতি তিনি কঠোর ও নৃশংস আচরণ করতেন। তাই সমস্ত গ্রামবাসী রাতারাতি গ্রাম ছেড়ে চলে যায় এবং অভিশাপও দেয়। বিগত প্রায় তিনশো বছর ধরে জনশূন্য এই অভিশপ্ত গ্রাম।[১]

কুলধারা
কুলধর
গ্রাম
ভূতের শহর
কুলধারা গ্রামে বাড়ির ধ্বংসাবশেষ
কুলধারা গ্রামে বাড়ির ধ্বংসাবশেষ
কুলধারা রাজস্থান-এ অবস্থিত
কুলধারা
কুলধারা
কুলধারা ভারত-এ অবস্থিত
কুলধারা
কুলধারা
ভারতের রাজস্থানে কুলধারার অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৬°৫২′১২″ উত্তর ৭০°৪৭′০৬″ পূর্ব / ২৬.৮৭০০০° উত্তর ৭০.৭৮৫০০° পূর্ব / 26.87000; 70.78500
দেশভারত
রাজ্যরাজস্থান
জেলাজয়সলমের
উচ্চতা২৬৬ মিটার (৮৭৩ ফুট)
সময় অঞ্চলIST (ইউটিসি+5:30)

প্রায় পাঁচশো বছর ধরে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু কুলধারা গ্রাম রাতারাতি ভৌতিক গ্রামে পরিণত হয়।[২] তবে রাজস্থান সরকার ২০১০-দশকে গ্রামটিকে একটি ট্যুরিস্ট স্পট বা ভ্রমণ-গন্তব্য হিসাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ইদানীং গ্রামটি পর্যটনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়।[২]

ভূগোল সম্পাদনা

কুলধারা গ্রামটি মরুশহর স্বর্ণনগরী জয়সলমের থেকে সড়ক পথে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।[২] গ্রামটি উত্তর-দক্ষিণে ৮৬১ মিটার দৈর্ঘ্যে এবং ২৬১ মিটার প্রস্থে বিস্তৃত ছিল। পূর্বদিকে ছিল ক্ষীণ কাঁকনি নদী। গ্রামের পশ্চিমদিক বেষ্টিত ছিল মানব সৃষ্ট দেওয়ালে। গ্রামের মধ্যে তিনটি অনুদৈর্ঘ্যে বিস্তৃত রাস্তা আড়াআড়ি সংকীর্ণ বহুগলি পথে যুক্ত ছিল। [৩] জনপদে ছিল একটি দেবতার মন্দির।

প্রতিষ্ঠা সম্পাদনা

থর মরুভূমির কোলে কুলধারার পত্তন হয়েছিল ত্রয়োদশ শতকে তৎকালীন পালি রাজ্য থেকে আসা পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের দ্বারা। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মী চাঁদ রচিত গ্রন্থ তারিখ-ই-জয়সলমের অনুসারে 'কড়হান' নামে এক ব্রাহ্মণ এখানে এসে প্রথম বসত তৈরি করেন।[২] তিনি গ্রামে 'উধানসার' নামে একটি পুকুর খনন করেন।[৩]

গ্রামটির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া গেছে তিনটি সমাধিক্ষেত্র এবং ৬০০ টির বেশি বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং বেশ কয়েকটি 'দেবালী' বা স্মৃতিস্তম্ভ [৪] এদের মধ্যে দুটি দেবালী শিলালিপি নির্দেশ করে যে গ্রামটিতে ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে বসতি স্থাপিত হয়েছিল। এই শিলালিপিগুলি ভাট্টিক সংবতে ( যা ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া একটি বর্ষপঞ্জী বা ক্যালেন্ডার) দু'জন বাসিন্দার মৃত্যুর তারিখ যথাক্রমে ১২৩৫ এবং ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দ নির্দেশ করে। [৫]

জনসংখ্যা সম্পাদনা

 
একটি কার্টহুইল

জনসংখ্যা সম্পাদনা

কুলধারা ও তার উপকণ্ঠে আরও ৮৩ টি গ্রামে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। তবে বাকি গ্রামগুলির নাম আর পাওয়া যায় না। [২] তাই গ্রামের ৪১০টি বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষসহ [৩] আরও ২০০ টি বাড়িঘর ছিল গ্রামের উপকণ্ঠে নিম্ন জনপদে।[৬]

লক্ষ্মী চাঁদের তাওয়ারিখ-ই-জয়সালমি গ্রন্থে গ্রামের পরিবারের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, সেই অনুসারে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সৈয়দ আলী নাদিম রেজাভি ৪০০ টি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘরের সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে জনসংখ্যা ১৫৮৮ অনুমান করেন। ব্রিটিশ প্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত জেমস টড 'দ্য বেস্ট ইনফরমেড নেটিভস' তথ্যের ভিত্তিতে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কুলধারার ২০০ টি পরিবারের জনসংখ্যা ৮০০ জন হিসাবে উল্লেখ করেন। নানা কারণে ইতিমধ্যে পালিওয়াল সম্প্রদায়ের বহু মানুষ কুলধারা ছেড়ে যেতে শুরু করে। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে গ্রামের ১১৭ টি বাড়িঘরে জনসংখ্যা কমে ৩৭ জন হয়। [৭]

সামাজিক গঠন- সম্পাদনা

গ্রামের বেশ কিছু দেবালী শিলালিপিতে আবার "পালিওয়াল" শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র বাসিন্দাদের ব্রাহ্মণ ("ব্রাহ্মণ" বা "বামন") বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। আবার বেশ কিছু শিলালিপিতে বাসিন্দাদের 'কুলধর' বা 'কালধর' বর্ণের অন্তর্গত বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। তদানুসারে অনুমিত হয় যে, 'কুলধারা' ছিল পালিওয়াল ব্রাহ্মণদের মধ্যে একটি জাতিগোষ্ঠী এবং এই বর্ণের নামেই গ্রামের নামকরণ করা হয়েছিল। [৮]

কিছু শিলালিপিতে বাসিন্দাদের জাত ও গোত্রের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। শিলালিপিতে উল্লিখিত অন্যান্য জাতিগুলি হল- হরজাল, হারজালু, হারজালুনি, মুদ্গল, জিসুতিয়া, লোহার্থী, লাহথি, লাখর, সাহারান, জাগ, কালসার এবং মহাজালার ইত্যাদি।

উল্লিখিত গোত্রগুলি হল অসমার, সুতধন, গর্গবী এবং গগো।

একটি শিলালিপিতে গোনালী নামে একজন ব্রাহ্মণের বংশ (পরিবারের বংশ) উল্লেখ রয়েছে। পালিওয়াল ব্রাহ্মণ ছাড়াও, একটি শিলালিপিতে ধানমগ এবং সুজো গোপালনা নামে দুই স্থপতি সূত্রধরের উল্লেখ রয়েছে । এই শিলালিপিগুলি আরো দেখায় যে, ব্রাহ্মণ বাসিন্দারা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্তর্বিবাহ করত, যদিও জাতি বা উপজাতি হতো বাইরের।কটি শিলালিপিতে গোনালী নামে একজন ব্রাহ্মণের কুল (পরিবারের বংশ) উল্লেখ রয়েছে। পালিওয়াল ব্রাহ্মণ ছাড়াও, শিলালিপিতে ধানমগ এবং সুজো গোপালনা নামে দুই সূত্রধরের (স্থপতি) উল্লেখ রয়েছে। শিলালিপিগুলি নির্দেশ করে যে ব্রাহ্মণ বাসিন্দারা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ করেছিলেন, যদিও জাতি বা উপ-বর্ণগুলি বহির্বিবাহী ছিল। [৮]

সংস্কৃতি সম্পাদনা

 
কুলধারা মন্দিরের ভিতরে একটি স্তম্ভের উপর শিলালিপি

ধর্ম সম্পাদনা

 
কুলধারায় ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এক মন্দির

কুলধারা গ্রামের বাসিন্দারা ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। সেকারণে গ্রামের প্রধান মন্দিরে বিষ্ণু ও মহিষাসুর মর্দিনীর ভাস্কর্য প্রদর্শিত হত। বেশিরভাগ শিলালিপিতে গণেশের আমন্ত্রণ দিয়ে শুরু হয়, যার ক্ষুদ্র ভাস্কর্যগুলিও প্রবেশদ্বারে প্রদর্শিত হয়। স্থানীয় গ্রামবাসীরা ষাঁড় ও ঘোড়ার বাহনের দেবতার পূজা করতেন। [৯]

পোশাক-পরিচ্ছদ- সম্পাদনা

যদি কুলধারার 'দেবালী'র মূর্তিগুলিকে সমসাময়িক ফ্যাশনের এক ধারা হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে দেখা যায় যে কুলধারার পুরুষরা কোমরবন্ধ (এক ধরনের কোমর বেল্ট ) সহ মুঘল ধাঁচের পাগড়ি এবং জামা (টিউনিকের মতো পোশাক) পরতেন। তারা সাধারণত দাড়ি রাখতেন, গলায় মালা পরতেন এবং খঞ্জর (খঞ্জর) সঙ্গে নিতেন। মহিলারা টিউনিক বা লেহেঙ্গা পরতেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ গলায় মালা তথা নেকলেস পরতেন। [৯]

অর্থনীতি সম্পাদনা

গ্রামবাসীরা বেশিরভাগই ছিল কৃষি ব্যবসায়ী, ব্যাংকার এবং কৃষক। তারা সূক্ষ্ম মাটির তৈরি অলংকৃত মৃৎপাত্র ব্যবহার করত। [৬]

কৃষি কাজের জন্য গ্রামবাসীরা কাঁকনি নদী বা কিছু কূপ থেকে জল সেচ করতেন। তারা জলসেচের জন্য কৃত্রিম পদ্ধতি 'খাদিন' এর ব্যবহার করত। খাদিনে তিনদিক বেষ্টিত করে যে জল সঞ্চয় করে রাখা হত তা বাষ্পীভূত হয়ে গেলে অবশিষ্ট মাটি জোয়ার , গমছোলা চাষের উপযুক্ত হত। কুলধারার দক্ষিণে একটি আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং দুই কিলোমিটার চওড়া খাদিন বিদ্যমান ছিল [১০]

'কাঁকনি' ছিল মূলত মৌসুমী নদী। কুলধারার কাছে দুটি শাখায় প্রবাহিত হয়েছে। প্রথম শাখাটি "মাসুরাদী নদী" এবং অন্যটি এক ড্রেন বা নালা। কাঁকনী শুকিয়ে গেলে, গ্রামবাসীরা বাড়িঘর থেকে দূরের কোন কূপ হতে ভূগর্ভস্থ জল আনত। এই রকম এক কূপের নিকটস্থ স্তম্ভের শিলালিপিতে উল্লিখিত ছিল যে, কুলধারা গ্রামের এক ব্রাহ্মণ তেজপাল ১৮১৫ ভাট্টিক সম্বত (১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে) তিনি কূপটি চালু করেন। [১১]

কিংবদন্তি সম্পাদনা

কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, কেবলমাত্র জলের সমস্যার কারণে মানুষ এখানকার গ্রাম ছেড়ে যায়নি। গ্রামটি পরিত্যক্ত হওয়ার নেপথ্যে ছিল বহু জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি। সেই রকম এক কাহিনী বলে, জয়সলমের রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী সালিম সিংয়ের কঠোর ব্যবহার ও নৃশংসতার কারণে গ্রামবাসীরা গ্রাম পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে কথিত আছে, কুলধারা এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল, প্রচুর সংখ্যক লোক বসবাস করত। গ্রামের প্রধানের এক অতীব সুন্দর কন্যাও ছিল। এই খবর কুলধারা গ্রাম থেকে সারা জয়সলমের রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। সালিম সিং যখন এই কথা জানতে পারেন, তখন তিনি সেই সুন্দরী মেয়েটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং তিনি গ্রামবাসীদের উপর চাপ দিতে থাকেন। সালিম সিং চেয়েছিলেন তিনি প্রধানের মেয়েকে বিবাহ করবেন কিন্তু গ্রামের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষেরা কন্যার বিবাহ দিয়ে কোনোমতেই তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে চাননি। এই কারণে গ্রামপ্রধান একদিন রাতে সভা ডেকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে, তারা রাতারাতি গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন, নইলে সালিম সিং জোরজবরদস্তি করে মেয়েটিকে বিবাহ করবে। তারপর, ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের রাখী পূর্ণিমার রাতে [২] সমস্ত গ্রামবাসী পুরো গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে যায় এবং চলে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীরা অভিশাপ দিয়েছিল যে এখানে আর কেউ বসতি করতে পারবে না, বর্তমানে রাজস্থানের জয়সলমের এই গ্রামটিকে তাই অভিশপ্ত গ্রাম বলা হয়।

অনেকে আবার কুলধারা গ্রামের প্রধানের কন্যার সঙ্গে সালিম সিংয়ের কাহিনিতে প্রেমের অনুষঙ্গ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের দাবি, সালিম সিং প্রধানের কন্যার প্রেমে পড়েন। কন্যাও সালিম'কে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। তিনি সৈন্য পাঠিয়ে কন্যাটিকে হরণ করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি গ্রামবাসীরা। কিন্ত গ্রামবাসীরা এক রাত সময় চেয়ে নেন। বলেন পরের দিন এলে তাদের হাতে কন্যাকে তুলে দেওয়া হবে। তাই এলাকা ছাড়ার আগে পরিবারের সম্মানরক্ষায় ওই কন্যাটিকে খুন করেন তাঁরা। সেই থেকে ওই মেয়েটিক অতৃপ্ত আত্মা গ্রামটিতে ঘুরে বেড়ায় বলে কাহিনি প্রচলিত রয়েছে।[১২]

প্রায় পাঁচশো বছর ধরে কুলধারায় গড়ে ওঠা মানুষের বসতি রাতারাতি জনশূন্য হয়ে যায় এবং ভৌতিক গ্রামে পরিণত হয়। দিল্লির 'ইন্ডিয়ান প্যারানর্মাল সোসাইটি'র সূত্র অনুসারে, রাতভর কুলধারা গ্রামে এখনও নানা অলৌলিক ঘটনা ঘটে চলে। আচমকাই নাকি কমে যায় তাপমাত্রা। রাতের অন্ধকার চিরে শোনা যায় আর্ত চিৎকার। বিশ্বাসীদের ধারণা, কুলধারার অতীত-বাসিন্দাদের আত্মা এখনও এই গ্রামের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

অন্যান্য তথ্য সম্পাদনা

 
কুলধারার ধ্বংসাবশেষ

ঊনিশ শতকের মধ্যে, কুলধারা গ্রাম অজানা কারণে জনশূন্য হয়ে পড়ে। তবে বিশ শতকে সম্ভাব্য কারণগুলির মধ্যে মূলত জলের অভাব এবং সেই সঙ্গে জয়সলমের রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী সালিম সিং-এর কঠোর ব্যবহার ও নৃশংস আচরণ গুরুত্ব পেয়েছে। [১৩][১৩]ঐতিহাসিক তথ্য ও গবেষকদের বড় অংশের বিশ্বাস খরার কারণেই জনহীন হয়ে পড়ে কুলধারা ও তার সংলগ্ন ৮৩ টি গ্রাম।

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, গ্রামের বেশিরভাগ কূপ শুকিয়ে যায়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, শুধুমাত্র ধাপ-কূপ এবং আরও দুটি গভীর কূপ কার্যকর ছিল।[২] ঐতিহাসিক সৈয়দ আলী নাদিম রেজাভী যখন ১৯৯০ -এর দশকে গ্রামটি জরিপ করেন, তখন ওই স্থানে শুকনো নদীর তলদেশের কিছু অংশে স্থির জল অবশিষ্ট ছিল। জলাভাবে কমে যায় কৃষিফলন। তার উপর স্থানীয় রাজপুত শাসক তথা জয়সালমের রাজ্যের রাজস্বের হার কমেনি, বরং অত্যধিক কর আরোপিত হয়েছিল। গ্রামবাসীদের পক্ষে তা মেটানো সম্ভব হয়নি। এই সমস্ত কারণেই গ্রামটি পরিত্যক্ত হয়েছিল।

ঐতিহাসিক নথিতেও গ্রামের জনসংখ্যা যে ধীরে ধীরে হ্রাসের পেয়েছে তা উল্লিখিত হয়েছে। ১৭-১৮ শতকে গ্রামের এর আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১,৫৮৮; ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে সেই সংখ্যা নেমে আসে ৮০০ তে এবং ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩৭ এ। [৭]

কারেন্ট সায়েন্সে কারেন্ট সায়েন্স নামক এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত এ.বি রায় ও অন্যান্যদের ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের একটি সমীক্ষায় জানা যায় যে, কুলধারা এবং অন্যান্য পার্শ্ববর্তী পালিওয়াল গ্রাম (যেমন খাভা) ভূমিকম্পের কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। লেখকদের মতে, এই গ্রামের বাড়িঘরের ভেঙ্গে পড়া ছাদ, লিন্টেল এবং স্তম্ভ ইত্যাদি ভূমিকম্পেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কুলধারা গ্রামের সমস্ত বাড়ির চাল ভেঙ্গে গেলেও দেওয়াল পড়ে যায়নি। [১২] আবহাওয়া বা ক্ষয়ের মত স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে নষ্ট হয়নি। [১৪] তারা আরো বলেছেন যে তাদের তত্ত্বটি, সাম্প্রতিককালের টেকটোনিক কার্যকলাপের প্রমাণ এবং এই অঞ্চলে সংঘটিত কয়েকটি ভূস্তরের বড়সড় চ্যুতির পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করেছে।[১৫]

পর্যটন সম্পাদনা

 
কুলধারা হেরিটেজ রিসোর্ট সাইনবোর্ড

গ্রামটির সম্পর্কে কিংবদন্তি ছিল তড়িঘড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় অভিশাপ দিয়ে যায় পালিওয়াল ব্রাহ্মণেরা এই বলে যে, আর কোনদিন এই গ্রামে মানুষের বসতি হবে না। আর জনশ্রুতি হল, যারা গ্রামে পুনরায় জনবসতি করার চেষ্টা করেছিল তারা অলৌকিক কার্যকলাপের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। তাই বিগত তিনশো বছর ধরে গ্রামটি জনবসতিহীন থেকে যায় [১৬] এবং গ্রামটি একটি ভুতুড়ে গ্রাম হিসাবে পরিচিত হয়।[১৭] সেকারণে গ্রামে যাওয়ার অনুমতিও ছিল না।

পরবর্তীকালে রাজস্থান সরকার দাবি করেছে যে, এখানে কোনো ভূতের বাস নেই, তাই সরকার সবার জন্য উন্মুক্ত করেছে [১৮] এবং ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রামটিকে একটি পর্যটন গন্তব্যের মর্যাদা প্রদান করে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ এখন এখানে বেড়াতে আসেন। শুধু স্থানীয় মানুষ নয়, দেশ-বিদেশের মানুষও এখানে আসেন। [১৯]অন্যদিকে ভূতের গল্প  পর্যটকদের আকর্ষণ করতে শুরু করে। এলাকার আশেপাশের স্থানীয় বাসিন্দারা ভূতের গল্পে বিশ্বাস করে না, কিন্তু পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য সেগুলি প্রচার করে। [২০] ২০১০ দশকের গোড়ার দিকে, 'ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল সোসাইটি'র গৌরব তিওয়ারি দাবি করেন যে, তিনি কুলধারায় অলৌকিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেছেন। সোসাইটির আঠারো জন সদস্য দলের সঙ্গে আরও বারো জন গ্রামে একটি রাত কাটান। রাতের অন্ধকার চিরে শোনেন আর্ত চিৎকার, চলমান ছায়ার রাতভর অলৌকিক ঘটনা।

২০০৬ খ্রিস্টাব্দ, রাজস্থান সরকার বোটানিক্যাল গবেষণার জন্য এখানে "জুরাসিক ক্যাকটাস পার্ক" স্থাপন করে।[২১]পর্যটন উন্নয়নের জন্য জিন্দাল স্টিল ওয়ার্কসের সহায়তায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে এক পরিকল্পনায় একটি ক্যাফে, একটি লাউঞ্জ, একটি লোক-নৃত্য পরিবেশন এলাকা, রাত্রিযাপনের কটেজ এবং দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য নানা বিপনী স্থাপনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। [২২] বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (Archaeological Survey of India) বা ASI এই এলাকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে।[১২]

 
পর্যটন গন্তব্যে কুলধারার রক্ষণাবেক্ষণের কিছু অংশ

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে সম্পাদনা

২০১০ খ্রিস্টাব্দে কুলধারা গ্রামের লোককাহিনীর উপর নির্ভর করে বলিউডে কালো - দ্য ডেজার্ট উইচ নামে একটি হিন্দি ভাষার ফিচার ফিল্ম নির্মিত হয়। [২৩][২৪] ছবিটি গ্রামের লোককাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল।

২০২৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় নির্মিত গোয়েন্দা চলচ্চিত্র দ্য একেন: রুদ্ধস্বাস রাজস্থানের-এর শুটিং হয়েছিল এই গ্রামে।

আরো দেখুন সম্পাদনা

  • ভারতে কথিত ভূতুড়ে অবস্থানের তালিকা
  • আকাল উড ফসিল পার্ক
  • মরুভূমি জাতীয় উদ্যান
  • কানোই রাজকুমারী রত্নাবতী বালিকা বিদ্যালয়
  • স্যাম বালির টিলা সাফারি এবং রিসর্ট

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. न्यूज़ १८ (२०१६)। "ये हैं देश का सबसे डरावना गांव, जो गया वो अकेला"। 9 जनवरी 2017 তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 9 जनवरी 2017  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ=, |আর্কাইভের-তারিখ= (সাহায্য)
  2. "ইতিহাস, জনশ্রুতির মিশেল, অতীতের বর্ধিষ্ণু গ্রাম কুলধারা আজ কেন পরিত্যক্ত জানেন?"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৫ 
  3. S.Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 312।
  4. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 315।
  5. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 313-314।
  6. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 320।
  7. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 321।
  8. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 314।
  9. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 319।
  10. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 322।
  11. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 321-322।
  12. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; eis নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  13. S. Ali Nadeem Rezavi 1995, পৃ. 323-324।
  14. A. B. Roy 2017, পৃ. 403।
  15. A. B. Roy 2017, পৃ. 404।
  16. Samonway Duttagupta (১৮ ডিসেম্বর ২০১৫)। "Jaisalmer's 'haunted' village to be developed and opened for tourists"। India Today। 
  17. "Kuldhara-the ghost village"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০২-১৫ 
  18. "200 साल पुराने प्राचीन गांव कुलधरा की बदलेगी (হিন্দিতে)"ईनाडुइंडिया। 9 जनवरी 2017 তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 9 जनवरी 2017  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ=, |আর্কাইভের-তারিখ= (সাহায্য)
  19. राजस्थान टूरिज़्म। "कुलधरा: राजस्थान के जैसलमेर का एक रहस्यमयी गाँव - राजस्थान टूरिज़्म (হিন্দিতে)"। 23 दिसंबर 2016 তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 9 जनवरी 2017  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ=, |আর্কাইভের-তারিখ= (সাহায্য)
  20. Deepika Mahendra (১৯ মে ২০১৪)। "The 'haunted' ruins of Kuldhara, where ghost stories mean big bucks"। News 18। 
  21. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Deepika_bucks নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  22. Rachna Singh (৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। "Game for night out at 'haunted' Kuldhara?"The Times of India 
  23. "Kulbhata"www.filmfestivals.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-১৪ 
  24. "FIRST LOOK: INDIA'S FIRST CREATURE FILM: KAALO, THE DESERT WITCH"www.filmfestivals.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-১৪ 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা